স্কুলের কোচিং বন্ধ করতে হলে চাই শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন
স্কুলের কোচিং বাণিজ্য নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই কথাবার্তা হচ্ছে। বিগত সরকারের সময় থেকে কোচিং বন্ধের সর্বাত্মক চেষ্টা চলেছে। কোচিং বন্ধের জন্য পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আনা হয়েছিল; কিন্তু সরকারের অনেক চেষ্টার পরও কোচিং নির্মূল করা যায়নি। সম্প্রতি কোচিং সেন্টারগুলো আবার গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। শুধু আলাদা কোচিং সেন্টার নয়, খোদ স্কুলেই ক্লাস শেষে কোচিং পড়িয়ে থাকেন স্কুলের শিক্ষকরা। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং সেন্টার নির্ভরতা কেন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক অরাজক পরিস্থিতি নিয়েই কথা বলতে হবে। জানা গেছে, এটা প্রায় সবারই জানা যে, শিক্ষকদের চাপে বাধ্য হয়েই অনেক শিক্ষার্থীকে কোচিং করতে হয়।
মাঝখানে কোচিং বাণিজ্যের বিষয়টি অনেক দিন আলোচনার বাইরে ছিল। সম্প্রতি আবার আলোচনা ফিরে এসেছে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর থেকে। গত মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) সকাল ১০টার দিকে দিয়াবাড়ি গোলচত্বরে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবারের সদস্যরা মানববন্ধন করেন। অভিভাবকরা ৯ দফা দাবি জানান। তাদের দ্বিতীয় দফা হলো, সারা বাংলাদেশে মাইলস্টোন স্কুলসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। তার কারণ, তাদের অভিযোগ, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যত শিশু মারা গেছে, সবাই কোচিং-এর শিক্ষার্থী।
এটা আমরা ইতোমধ্যে জানি, স্কুল ছুটির পর যেসব শিক্ষার্থী কোচিং-এর জন্য অপেক্ষা করছিল বিমান দুর্ঘটনায় তারাই মারা গেছে। অভিভাবকরা বলছেন, এ স্কুলে কোচিংয়ের জন্য খুবই প্রেসার দেয়া হতো। কোচিং পড়তে গেলেই শিক্ষকরা আদর করতেন। কোচিংয়ে না গেলে পরীক্ষায় খারাপ করবে বলে ভয় দেখানো হতো, কোচিংয়ে দেয়ার জন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এক ধরনের মানসিক টর্চার করা হতো। নিরুপায় হয়েই অভিভাবরা সন্তানদের কোচিংয়ে দিতে বাধ্য হতেন। আর কোচিং ফি-ও স্কুলের বেতনের চেয়ে প্রায় তিনগুণ বেশি। এই আয়ের পুরোটাই যায় ওই শিক্ষকদের পকেটে।
এই চিত্র পুরো বাংলাদেশেই কম- বেশি একরকম। বিশেষ করে শহরাঞ্চলেই কোচিং-এর দৌরাত্ম্য বেশি। এখন উপজেলা পর্যায়েও কোচিং বাণিজ্য শুরু হয়েছে পুরো দমে। এর কারণ কী? এর জন্য কি শুধু শিক্ষকরাই দায়ী? সারা দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের জীবন তারা জিম্মি করে ফেলবেন এত ক্ষমতা তারা কোথায় পান? আসলে কোচিংয়ের প্রতি অভিভাবকদেরও এক প্রকার নীরব সায় আছে। এর কারণ স্কুলের পাঠদানের প্রতি তারা আর আস্থা রাখেন না। দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, কোচিং বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার নৈরাজ্য পরিস্থিতিটা পরিষ্কার বোঝা যায়। শিক্ষকদের পেছনেও অনেক বড় বড় রাঘব বোয়াল নিশ্চয়ই জড়িত, যারা স্কুল কমিটির সঙ্গে আছেন। তাদের অগোচরে এত বড় এক কোচিং চক্র গড়ে উঠবে এটা অবিশ্বাস্য। তার মানে প্রশাসনও নিশ্চয়ই এ-ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সব জেনেও তারা চোখ বন্ধ করে থেকেছে, কানে তালা মেরে রেখেছে, কারণ স্পষ্টভাবেই বলা যায়, তারা পরিকল্পনা করে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে চেয়েছে।
এটা তো খুবই প্রাথমিক ও মৌলিক প্রশ্ন, যে, কোচিং থাকলে ক্লাসের কী দরকার? আদতে ক্লাস যেন আর দরকার নেই। স্কুল যেন শিক্ষার্থীদের আকর্ষণের বিজ্ঞাপন, আসল পাঠদান যেন এখন ওই কোচিংয়েই হয়। কোচিংয়েই যদি পাঠদান হবে তাহলে ক্লাসে হয় না কেন? তার মানে ওখানে ওই অর্থের লোভটাই বড়। তার মানে কোচিংয়ের নামে বিশাল সংখ্যক শিক্ষকরা যে আসলে এক দুর্নীতিগ্রস্তের সঙ্গে জড়িত এ বিষয়টাও তলিয়ে দেখার দরকার আছে।
তবে, আরও বিষয় আছে। অনেক কোচিং-য়ের শিক্ষকরা সরকারি কোনো স্কুলের সঙ্গে যুক্ত নন, বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। স্কুলশিক্ষকের ওপর আস্থার অভাব থেকে অভিভাবকরা বিকেলে-সন্ধ্যায় ওই সব কোচিং সেন্টারে পাঠান সন্তানদের। আবার কোচিংয়েরও প্রকারভেদ আছে। স্কুলের কোচিং আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচিং ঠিক এক বিষয় নয়। বিষয় যা-ই হোক, এর সঙ্গে যে বিপুল বাণিজ্য জড়িত এবং এর মধ্য দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক দুর্বলচিত্র বোঝা যায় তাও স্পষ্ট। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া আসলে এ অবস্থা থেকে বেরুনো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রথমে দরকার স্কুলগুলোতে দক্ষ শিক্ষক। তার জন্য শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক সংস্কার দরকার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে