বিভুরঞ্জনের শেষ বার্তায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার করুণ কাহিনি
কিছু মৃত্যুর সংবাদ মানুষকে ঘন শীতল কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন করে। কিছু মৃত্যুর সংবাদ শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে। কিছু মৃত্যুর সংবাদ বুকের ভেতর বাষ্প জমিয়ে প্রকৃতপক্ষেই বুকটাকে ভারী করে তোলো। সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের মৃত্যু সংবাদ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে অনেকটা এমনই ছিল। শুক্রবার সন্ধ্যায় গুণী এই সাংবাদিকের মৃত্যু সংবাদ শোনার আগে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলাম তার শেষ ‘খোলা চিঠি’। যে চিঠিতে তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের এক নিষ্ঠুর চিত্র তুলে ধরে গেছেন। জীবন শেষ করার বিদায়বেলায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এই জগৎটা কতটা ভ্রাতিবিলাশে আচ্ছন্ন, ফাঁপা, অতি আবেগি, অপেশাদার, যাতে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক সাংবাদিকের জীবন।
এ ছাড়া ‘খোলা চিঠি’তে আছে রাজনৈতিক পালাবদলে কীভাবে একটি মানুষের জীবন দুর্ষিসহ হয়ে ওঠে তার নিষ্ঠুর চিত্র। ‘খোলা চিঠি’টি পড়ার পরই ভাবছিলাম, বিভুরঞ্জন দাদা আমাদের মাঝে আছেন তো! কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম মানুষটি যাতে হারিয়ে না যান। আমার প্রার্থনা কাজে লাগেনি। খুব সম্ভবত এই চিঠিটি প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগেই স্ত্রী-সন্তান-পরিবার-পরিজন-সহকর্মীসহ অনেকের প্রার্থনাকে পাশ কাটিয়ে মেঘনার জলে পাওয়া গেলো সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার।
জীবনের শেষ জবানবন্দি ‘খোলা চিঠি’টি একটি অনলাইন পোর্টালে বিভুরঞ্জন সরকার পাঠিয়েছিলেন ২১ আগস্ট সকাল সোয়া ৯টায়। যার বার্তায় তিনি লিখেছিলেন “জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।” লেখাটি ওই অনলাইন প্রকাশ করে ২২ আগস্ট বিকেল ৫টা ২৩ মিনিটে। হৃদয়ে গভীরে প্রবলভাবে আঘাত করা এই বিদায়ী বার্তাটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশার নগ্ন, মর্মস্পর্শী ও করুণ চিত্র তুলে ধরেছে, যা বিবেচনায় নেওয়া খুব জরুরি। কারণ আমাদের হয়তো জানা নেই বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশায় অনেকেই হয়তো বিভুরঞ্জন সরকারের মতো ‘খোলা চিঠি’ লিখে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের পরিকল্পনা করছেন। এই মৃত্যুগুলো ঠেকানোর দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ, আপনার আমার সবার।
‘সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়’
নিজের শেষ লেখায় সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার একটি বাক্যকে অমরত্ব দিয়ে গেলেন। যে লাইনটি বাংলাদেশের সাংবাদিক অঙ্গনে বহুকাল চর্চিত হবে। ‘সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়’- মাত্র পাঁচ শব্দের এই বাক্যটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার বিষয়টি নতুন করে সামনে আনল। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। কেন স্বৈরাচারমুক্ত নতুন বাংলাদেশে একজন সাংবাদিককে নিজের মত প্রকাশের জন্য গুমড়ে গুমড়ে মরতে হবে। জীবনের শেষ চিঠিতে বিভুরঞ্জন তুল ধরেছেন গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সাংবাদিকতার চিত্র। তার ভাষায় বর্তমানে গণমাধ্যমের অবস্থা ‘আরও কাহিল হয়েছে’। তিনি প্রধান উপদেষ্টার কথাও উল্লেখ করেছেন। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস মন খুলে কথা বলার, সমালোচনা করার স্বাধীনতার অঙ্গীকার করেছিলেন। সে বিষয়টি উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেস বিভাগের কথা গভীর আক্ষেপের সাথে তুলে ধরেছেন বিভুরঞ্জন সরকার।
জীবনের শেষ লেখায় তিনি লিখেছেন, “মিডিয়ার যারা নির্বাহী দায়িত্ব পালন করেন তারা সবাই আতঙ্কে থাকেন সব সময়। কখন কোন খবর বা লেখার জন্য ফোন আসে। তুলে নিতে হয় লেখা বা খবর! এর মধ্যে আমার একটি লেখার জন্য ‘আজকের পত্রিকা’র অনলাইন বিভাগকে লালচোখ দেখানো হয়েছে। মাজহারুল ইসলাম বাবলার একটি লেখার জন্যও চোটপাট করা হয়েছে।” যে লেখায় ছিল শেখ হাসিনার দিল্লি যাওয়া, মেটিকুলাস ডিজাইনে হত্যাসহ নানা প্রসঙ্গ। এই বিষয়গুলো বর্তমান ক্ষমতা কাঠামোর যে পছন্দ হওয়ার কথা নয়- তা বলাই বাহুল্য। নিজের শেষ কর্মস্থল ‘আজকের পত্রিকা’র সম্পাদকীয় বিভাগে স্বাধীনভাবে কাজ করতে গিয়ে চরমভাবে নিগৃহীত ও অপমানিত হয়েছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার। এমনকি তার সাথে কথা বলা বন্ধ করেছিলেন ‘আজকের পত্রিকা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। শেষ বার্তায় উপেক্ষাকারী সম্পাদককে ‘সজ্জন’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলে গেছেন সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ‘চাপে ছিলেন’। তো এই চাপ কে বা কারা দেন বা দিয়েছেন তাঁদের চিনতে-জানতে কি খুব কষ্ট হওয়ার কথা।
আর্থিক অনিশ্চয়তার করুণ কাহিনি
বিভুরঞ্জন সরকারের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার বেশ দীর্ঘ। তিনি সারাজীবন সাংবাদিকতায় করে গেছেন। সর্ব শেষ কর্মস্থল ‘আজকের পত্রিকা’য় কাজ করছিলেন চার বছর ধরে। সেখানে বাড়েনি তার বেতন, হয়নি পদোন্নতি। কর্মস্থলে বেতন বৈষম্য ছিল চরম। তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আজকের পত্রিকা’য় তার বিভাগীয় প্রধানের বেতন ছিল তার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। সারা জীবন সাংবাদিকতায় পার করে দেওয়া বিভুরঞ্জন সরকারের আর্থিক অনটন ছিল চরম। তিনি শেষ বার্তায় লিখেছেন ‘যদি ওই বেতনের শেষ কর্মস্থলে বিভাগীয় প্রধানের একটি চাকরি পেতাম তাহলেও হয়তো সংসার চালানোর জন্য নিয়মিত ধার-দেনা করার পেশাটি আমাকে বেছে নিতে হতো না! অন্যসব খরচের হিসাব বাদ দিয়ে মাসে আমার একার ওষুধের ব্যয় ২০-২২ হাজার টাকা। বাড়িয়ে নয়, একটু কমিয়েই হয়তো বললাম! আমার আর্থরাইটিস, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদরোগসহ কত যে রোগ! আর্থরাইটিস ও লিভারের চিকিৎসার জন্য কত যে ধারদেনা করতে হয়েছে। আমার ছেলেও অসুস্থ, ওরও নিয়মিত চিকিৎসাব্যয় আছে। তাই ধার-দেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
একবার চিন্তু করে দেখুন, কী নিদারুণ আর্থিক অনটন ও হতাশার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতে হয়েছে সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারকে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার আরেক নগ্ন রূপ তিনি উন্মোচন করে গেছেন। বাংলাদেশের অনেক সংবাদমাধ্যম লেখার বিনিময়ে সম্মানী দেন না অথবা সম্মানী দিতে অকল্পনীয় বিলম্ব করে থাকে। লেখককে মূল্যায়ন করেন না। সে বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি লিখে গেলেন ‘নামে-বেনামে হাজার হাজার লেখা লিখেছি। সম্মানী কিন্তু পেয়েছি খুবই কম। কোনো কোনো পত্রিকা তো কয়েক বছর লেখার পরও একটা টাকা দেওয়ার গরজ বোধ করেনি। সেদিক থেকে অনলাইনগুলো অনেক ভালো। একটি বড় অনলাইনের কাছেও আমার মোটা টাকা এখনো পাওনা আছে।’ যেসব সংবাদমাধ্যমের কাছে বিভুরঞ্জন সরকারের এখন অনেক টাকা পাওনা তারা হয়তো এখন আক্ষেপ করে মানবতার খাতিরে টাকাগুলো দেবেন। কিন্তু এই টাকাগুলো কিছুদিন আগে পেলে হয়তো তার জীবন বেঁচে যেতো।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের কঠিন বাস্তবতা ও ট্যাগিংয়ের ভয়াবহতা
পাঁচ আগস্ট ২০২৪ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অনেক উত্থান-পতন চলছে। এর ধারাবাহিকতায় অনেক অপরাধী, দুর্বৃত্ত যেমন নানা ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হচ্ছেন ঠিক তেমনি ভয়াবত মব সহিংসতা ও জাতি-ধর্মগত বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। অনেকেই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। নিয়ম- শৃঙ্খলা ও বিবেচনাবোধের বাইরে অনেক ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে সীমাহীন নৈরাজ্য। জীবনের শেষ চিঠিতে পরিবর্তিত বাস্তবতার সেই চিত্র তুলে ধরে গেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। যা তার জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল।
তিনি লিখে গেছেন “শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনো বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখে।” এ ছাড়া নতুন বাংলাদেশে তার সন্তানদের চাকুরি, পরীক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ নেতিবাচক পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে তাও অভিমানের সাথে তুলে ধরেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। যে পরিস্থিতিতে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
সাংবাদিকতা পেশায় সুবিধাবাদের ভয়াবহ চিত্র
জীবনের শেষ লেখায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পেশার আরেকটি নীতিবাচক দিক উন্মোচন করে গেছেন সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার। কর্তৃত্বপরায়ণ শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অনেক সাংবাদিক আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়েছেন। কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, জায়গা-জমি করেছেন। কেউ কেউ স্তূতিমূলক গ্রন্থ লিখেও টাকা কামিয়েছেন বিস্তর। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান করেও, পেশাদার সাংবাদিকতা করেও তিনি কখনও শেখ হাসিনার নেক নজরে পড়তে পারেননি। এমনকি সাহায্যের আবেদন করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ তার অনেক সহকর্মী সাংবাদিকরা এখন অনেক সচ্ছল। অনেকেই বাড়ি-গাড়ির মালিক। অনেকের সন্তানই পড়াশোনা করেন ইউরোপ আমেরিকায়। পেশাদার সাংবাদিক জীবনের শেষ বেলায় যে চিত্র তুলে ধরে গেলেন তা রীতিমতো ভীতিকর।
সাংবাদিক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে একটি আপ্তবাক্য সারাজীবন জপে গেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, সাংবাদিকতা মানে সাহস। সত্য প্রকাশ মানে জীবনের ঝুঁকি নেয়ার নাম। জীবনের শেষ লেখায় তিনি লিখে গেছেন, ‘সত্য লিখতে হলে কখনো কখনো ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য হারাতে হয়। আমি তেমন স্বাচ্ছন্দ্য চাইনি কখনো। তবে সারাজীবন হাত পেতে চলতে হবে এটাও চাইনি।’
শেষ লেখায় নিজেকে অতি ক্ষুদ্র মানুষ হিসেবে দাবি করে গেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। অন্যের বিদ্বেষের প্রতিও সম্মান জানিয়ে গেছেন। তবে যাওয়ার বেলায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতার চিত্র তুলে গেলেন তা রীতিমতো ভীতিকর, রোমহর্ষক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা পরিসরের সংস্কার প্রয়োজন, আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। তা না হলে আরও অনেক বিভুরঞ্জন সরকার পরিণতি দেখতে হবে অদূর ভবিষ্যতে। আর কোনো সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের ভাগ্যবরণ করুক- তা কাম্য হতে পারে না। কোন অবস্থাতেই না।
রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে