ঝুঁকিতে হরমুজ প্রণালি: বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খল হুমকিতে
ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধ যতই বিপজ্জনক দিকে মোড় নিচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতি ততই বিপাকে পড়ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে হরমুজ প্রণালি নিয়ে। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে কী হবে? উত্তরটা হয়তো সহজেই পাওয়া যাবে; কিন্তু তা অত্যন্ত ভীতিকর। এক হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলেই বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির জন্য বিরাট এক ধাক্কার সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে কোটি কোটি মানুষের জন্য বিধ্বংসী পরিণতি হতে পারে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে, যারা একদিকে বর্ধনশীল বটেই; কিন্তু যে কোনো মুহূর্তেই ভেঙেও পড়তে পারে।
ইরান-ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা আর আঞ্চলিক বিরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দুই দেশেরই প্রক্সি বাহিনী। মিত্র বাহিনীর যেমন, প্রতিপক্ষেরও তেমন বিশাল নেটওয়ার্ক রয়েছে। এতদিন অভিযান চলেছিল গোপনে; কিন্তু এখন তা সরাসরি শুরু হয়ে গেছে এবং এই যুদ্ধ যে দীর্ঘস্থায়ী হবে তাও বোঝা যাচ্ছে।
হরমুজ প্রণালি ইরান ও ওমানের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা এক সংকীর্ণ জলপথ। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানিবাহী পথগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয় এই প্রণালি। বৈশ্বিক তেলের ২০ শতাংশেরও বেশি এই পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল। বিশ্বের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এখান দিয়ে যায়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার এবং ইরাকের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের তেল ও গ্যাস রপ্তানির জন্য এই পথের ওপর নির্ভর করে। এই জ্বালানি সবকিছুর জন্য জ্বালানি হিসেবে কাজ করে- ভিয়েতনামের কারখানা এবং জার্মানির গাড়ি থেকে শুরু করে জাপানে ঘরবাড়ি গরম করা এবং ভারতে স্মার্টফোন চালানো পর্যন্ত।
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই হুমকি দিয়ে আসছে যে, যদি তাদের ওপর আক্রমণ করা হয় বা তাদের অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা করা হয় তাহলে তারা হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিবে। আর ইরান যদি সত্যি হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয় তাহলে তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে বাড়তে পারে ১৫০ ডলারের বেশি। নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি। জ্বালানি ও পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি সরবরাহ শৃঙ্খলে বিপর্যয় নেমে আসবে। এই সংকট আরও গভীর হলে যুক্তরাষ্ট্র, উপসাগরীয় দেশগুলোর নৌবাহিনী ও আন্তর্জাতিক তেলবাহী ট্যাংকারগুলোর মধ্যে সামুদ্রিক সংঘাতেরও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে- যার প্রভাব কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, ছড়িয়ে পড়বে গোটা বিশ্বে।
তবে, সব দেশই সমানভাবে ঝুঁকিপূর্ণ নয়। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলো সবচেয়ে কঠোর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে থাকতে পারে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড এবং উপসাগরীয় দেশগুলো। ইউরোপ এবং চীনেও এর প্রভাব পড়বে। তবে প্রাথমিক দুর্যোগ কাটানোর মতো শক্ত অবস্থান তাদের রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে তাছাড়া তারা চাইলে বিভিন্ন উৎস থেকেও তেল আমদানি করতে পারে।
আসল ভোগান্তি হবে সাধারণ মানুষেরই। তেলের দাম বাড়লে খাবারের দামও বাড়বে আর তার সরাসরি প্রভাব পড়বে দরিদ্র মানুষের পাতে। অনেক শিশু হয়তো দিনে একবেলার খাবারও পাবে না। অনেক পরিবার গ্যাস বা বিদ্যুৎ চালানোর সামর্থ্য হারাবে। ছোট ব্যবসাগুলো টিকে থাকতে না পেরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ পরিবহন ও কাঁচামালের খরচ বহন করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না। কারখানা ও কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমবে, বেকার হয়ে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর ছবি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। মানবিক দিক দিয়ে এই সংকটের ঢেউ হয়তো কোভিড-১৯ মহামারির চেয়েও বেশি ও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ সাধারণ মানুষের হাতে না থাকলেও, এর ক্ষতি কমানোর দায়িত্ব এখনই নিতে হবে বিশ্বনেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর। সংকট সামাল দিতে হলে একযোগে নিতে হবে তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ। স্বল্পমেয়াদি করণীয়গুলোর মধ্যে রয়েছে কূটনৈতিকভাবে উত্তেজনা প্রশমন, জরুরি তেল মজুত (স্ট্র্যাটেজিক রিজার্ভ) ব্যবহার এবং জ্বালানি ও পরিবহনসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে ভর্তুকি প্রদান। অন্যদিকে, দীর্ঘমেয়াদে নজর দিতে হবে জ্বালানির বৈচিত্র্যকরণে, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে আঞ্চলিক বিনিয়োগে এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও টেকসই ও স্থিতিশীল করে তোলার দিকে। তবেই এই সংকটের অভিঘাত কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব।
এই সংকট আমাদের মনে করিয়ে দেয়- আজকের দুনিয়ায় দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ মানেই বহু দেশের জন্য বিপর্যয়। আর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষ। এখনই জেগে উঠতে হবে বিশ্বকে। যুদ্ধ বন্ধের জন্য তীব্র প্রতিবাদ করতে হবে। শুধু যুদ্ধ ঠেকাতে নয়, বরং যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে মানবতাকে রক্ষা করতেও। হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে কেবল তেলের ট্যাঙ্কার চলাই থামবে না, থেমে যাবে মানুষের জীবনচক্র।
কে এম জয়নুল আবেদীন: অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে