ইংরেজি বিদ্যায় বাঙালির হালচাল
বাঙালি ইংরেজি শিখতে শুরু করেছে কবে থেকে? নিশ্চয়ই যখন থেকে ইংরেজি শিক্ষাটা তার বৈষয়িক স্বার্থের অনুকূল রূপে দেখা দিয়েছে।
সে সময়টা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ। ১৭৫৭-তে পলাশীর ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার অবসান ঘটলো যদিও, তবু এদেশে ইংরেজের রাজত্ব গুছিয়ে নিতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল অবশ্যই। তাই, তখনই ইংরেজের ভাষা এ দেশে রাজভাষা হয়ে ওঠেনি এবং বাঙালি সন্তানদের পক্ষেও রাজানুগ্রহ লাভের জন্য ইংরেজি ভাষা রপ্ত করার প্রয়োজন দেখা দেয়নি। ১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল যে, পুরোনো কেতায় আর জীবন চলবে না; ইংরেজ আর এখন শুধু বণিক নয়- রীতিমতো বণিকরাজ, সে বণিকরাজের প্রসাদভোগী হওয়ার জন্য তার ভাষাটা আয়ত্ত করা প্রজাকুলের একান্ত প্রয়োজন।
প্রয়াত সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষ বাংলার ইংরেজি শিক্ষার ইতিহাস সন্ধান করতে গিয়ে রামকমল সেন-বিরচিত ইংরেজি-বাংলা অভিধানটির শরণাপন্ন হন। সে অভিধানটির প্রকাশকাল ১৮৩৪ সাল। এর ভূমিকায় বাঙালির ইংরেজি শিক্ষার প্রাথমিক প্রয়াস সম্পর্কে অনেক মূল্যবান তথ্য সংযোজিত হয়েছে। রামকমল সেনই জানিয়েছেন, ‘In 1774 the Supreme Court was established here, and from this period a knowledge of the English language appeared to be desirable and necessary.’
কেদারনাথ মজুমদার এ বিষয়ে তার ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’-এ লিখেছেন, ‘১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হইলে একজন ইংরেজি ও পারস্য ভাষা অভিজ্ঞ দ্বিভাষিকের প্রয়োজন হয়। বঙ্গদেশে তখন ইংরেজি ভাষাভিজ লোকের একান্ত অভাব ছিল। সুপ্রিম কোর্টের প্রথম জজ সার ইলাইজা ইম্পি তাহার সহযাত্রী বিলাত প্রত্যাগত দিল্লি নিবাসী গণেশরাম দাসকে এই কার্যে নিযুক্ত করেন। পশ্চিম প্রদেশবাসী গণেশরামের এইরূপ সমাদর দেখিয়া বাঙালির মধ্যে ইংরেজি শিখিবার ভাব প্রবল হইয়া ওঠে। চাকরি প্রত্যাশী বাঙালি তখন পাদরী Kiernandler নিকট যাইয়া ইংরেজি শিখিতে লাগিলেন, অনেকে তাহাদের ছেলেদিগকে ইংরেজি শিখিবার জন্য উক্ত পাদরীর সেই দরিদ্র স্কুলে প্রেরণ করিতে লাগিলেন। অনেক বড়লোকও ইংরেজ সমাজে মিশিবার প্রত্যাশায় নিজ নিজ চেষ্টায় ইংরেজি ভাষা শিক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে সুপ্রিম কোর্ট স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতার বাঙালি সমাজের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার ভাব জাগরিত দেখা যাইতে লাগিল।’
তখনকার সেই ‘ঈপ্সিত ও প্রয়োজনীয়’ ইংরেজি ভাষা শিখে নিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাহেব অ্যাটর্নি ও অ্যাডভোকেটদের বাঙালি কেরানিরা। ঠিক ভাষা শিক্ষা বলতে যা বোঝায় তা তাদের আয়ত্তে আসেনি। ইংরেজি দরখাস্ত লেখার কিছু গৎ তারা আয়ত্ত করেছিলেন; Yes, no, Very wel-এর মতো কয়েকটি শব্দ দিয়ে সাহেবদের সঙ্গে ভাব-বিনিময়ের কাজটা তারা কোনো রকমে চালিয়ে যেতে পারতেন। অথচ, ওইটুকু ইংরেজি বিদ্যার বদৌলতেই তারা অনেক মর্যাদাবান হয়ে উঠেছিলেন। কলিকাতা নগরীতে তারাই হয়ে গেলেন ইংরেজির শিক্ষক।
ইংরেজির শিক্ষকতা করা মানে কয়েকটি শব্দ-শিখানো। খাতার মধ্যে তারা ইংরেজি শব্দ ও তার বাংলা অর্থ লিখে রাখতেন। যিনি যত বেশি ইংরেজি শব্দের মজুত গড়ে তুলতে পারতেন তিনিই তত বেশ ইংরেজি-নবীশ বলে খ্যাত হতেন, শিক্ষক হিসেবে তার কদরও তত বেশি বেড়ে যেত। অভিধানকার রামকমল সেনের মতে রাম রাম মিশ্র নামক একজন ব্রাহ্মণই বাঙালিদের মধ্যে প্রথম ইংরেজি ভাষায় মোটামুটি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। অনেক ছাত্রকেই তিনি ইংরেজি শিক্ষা দিয়েছিলেন। রামরামের পর পরই যারা ইংরেজি শিক্ষিত রূপে খ্যাতি অর্জন করেন তাদের মধ্যে ছিলেন রাম নারায়ণ মিশ্র, আনন্দীরাম দাস, রামলোচন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু প্রমুখ বাঙালি বাবু। এরও পর ভবানী দত্ত ও শিবু দত্তের মতো কয়েকজন কলিকাতাবাসী ভদ্রলোক ইংরেজি-শিক্ষিত পণ্ডিত হয়ে ওঠেন। ওই পণ্ডিতদের বিদ্যাও Spelling Book & Word Book -এর বেশি ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
তবুও, ওই বিদ্যা নিয়েই তারা ইংরেজি শিখানোর স্কুল গড়ে তোলেন এবং সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষেই ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নিতেন মাসিক ৪ টাকা থেকে ১৬ টাকা হারে। ইংরেজি ‘শব্দব্রহ্ম’-সাধনার জন্য রীতিমতো পদ্য রচিত হয়েছিল, ছাত্ররা পরম নিষ্ঠায় বীজমন্ত্র আয়ত্ত করার মতো করে সেই পদ্য মুখস্থ করতো,
‘ফিলসফার বিজ্ঞলোক প্লাউম্যান চাষা।
পাম্পকিন লাউকুমড়ো কিউকম্বার শসা।’
এমনভাবে পদ্য পড়ে শব্দ শিখেই ইংরেজের অফিসে বাঙালিদের চাকরির সংস্থান হলো, যার শব্দের পুঁজি যত বেশি, চাকরির জন্য সে-ই তত বেশি যোগ্য বলে বিবেচিত হলো। সেই যোগ্যতা নিয়ে চাকরি করে নির্ধারিত বেতনের অতিরিক্তই তারা রোজগার করতো। সেই অতিরিক্ত রোজগারের পথটা নিশ্চয়ই সনাতন নৈতিকতা সম্মত ছিল না, সোজা কথায়, চৌর্যের পথই অবলম্বন করতো তারা। তবুও, ধরা পড়লে সেই চৌর্যের বৈধতা প্রমাণ করে দেয়ার প্রয়াস পেত তাদের শব্দসর্বস্ব ইংরেজি জ্ঞান দিয়েই।
এক বাঙালি চাকুরে নাকি সাহেব-মনিবের ঘোড়ার দানা চুরি করে বিক্রি করে দিত। একদিন তো সাহেব তার এই অপকর্ম হাতেনাতে ধরে ফেলে কৈফিয়ৎ তলব করলেন, ‘হোয়াই আর ইউ সো ডিজ-অনেস্ট?’ কৈফিয়ৎ যেন বাঙালি বাবুর একেবারে জিভের আগাতেই জমা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব: ‘মাই হাউজ মর্নিং এন্ড ইভনিং টুয়েন্টি টুয়েন্টি ফর্টি লিস্ ফল, লিফ্ট মানি, হাউ ম্যানেজ? দেয়ারফোর ডিজ-অনেস্ট।’
বাংলা বাক্যরীতির সকাল-বিকাল কুড়ি কুড়ি চল্লিশটি পাতা, পড়ে-র যে-শাব্দিক তর্জমা বাঙালি বাবুটি পেশ করেছিল, সাহেবের তা কতটুকু বোধগম্য হয়েছিল- আমরা জানি না। কিন্তু আমরা এটুকু জানি যে, এই ‘ডিজ অনেস্ট বাঙালি বাবুরা এভাবেই চাকরিতে শনৈঃশনৈঃ উন্নতি করে যাচ্ছিল, এবং উনিশ শতকের গোড়াতেই কলিকাতা নগরীকে কেন্দ্র করে তারা রীতিমতো ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। এদের সন্তানদের কিন্তু কেবল শব্দসর্বস্ব ইংরেজি বিদ্যাতে সন্তুষ্ট থাকতে হয়নি, হিন্দু কলেজের ছাত্র হয়ে অনেকেই তারা ইংরেজি বিদ্যুতের ইংরেজকেই চ্যালেঞ্জ করার মতো যোগ্যতার অধিকারী হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৩১ সালের ২ মে তারিখের ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় অত্যন্ত সঠিকভাবেই লেখা হয়েছিল,
‘কথিত আছে ঢেঁকি যন্ত্রের বিবরণ কোন মুৎসুদ্দী ইংরাজি ভাষায় তরজমা করিয়াছিলেন, টু মেন ধাপুড় ধুপুড় ওয়ান মেন সেঁকে দেয়, ইত্যাদি। হইতে পারে ইংরেজদিগের প্রথমাধিকার সময়ে তদ্ভাষায় বহুতর লোক সুশিক্ষিত হইতে পারেন নাই কিন্তু ইহা অবশই স্বীকার করিতে হইবে যে তাহারা ক্ষমতাপন্ন লোক ছিলেন এবং কর্ম উত্তমরূপে নির্বাহ করিয়াছেন। অপর তৎপর দ্বিতীয় শ্রেণিতে গণ্য যে সকল মুৎসদ্দি হইলেন তাহাদিগের মধ্যে অনেকেই ইংরেজি বিদ্যায় বিলক্ষণ পারগ ইহা দেশ বিখ্যাত আছে...।’
কিন্তু যারা ‘ইংরেজি বিদ্যায় বিলক্ষণ পারগ’ হলেন, কর্মক্ষেত্রে তারাও তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা পেলেন না। ১৮৩৩ সালের আগে কোনো বাঙালি, তা তিনি যত ইংরেজি জ্ঞান ও অন্য অনেক বিষয়ে কুশলী হোন না কেন, চাকরিতে সেরেস্তাদারের চেয়ে বড় কোনো পদমর্যাদাতেই উন্নীত হতে পারতেন না। ১৮৩৩-এর পর অবস্থার সামান্য উন্নতি হলো, বাঙালি চাকুরের জন্য সর্বোচ্চ পদরূপে নির্ধারিত হলো ডেপুটি কালেক্টরি। প্রথম দিকে সে চাকরি লাভও খুবই আয়াস সাধ্য ছিল, রাজনারায়ণ বসুর মতো কৃতবিদ্য ব্যক্তি পর্যন্ত অনেক তদ্বির করেও তা পাননি। ভালো চাকরির প্রলোভনেই ইংরেজি শিক্ষায় তনু-মন-প্রাণ সমর্পণ করেছিলেন যারা, বাঞ্ছিত সেই চাকরি না পেয়ে তারা যে ইংরেজি ও ইংরেজের ওপরই ক্ষুব্ধ ও অভিমানাহত হয়ে উঠবেন- তেমনটিই তো স্বাভাবিক। সেকালের ইংরেজি শিক্ষিত হতাশ বাঙালির সেই ক্ষোভ ও অভিমানই ফুটে উঠেছিল রাজনারায়ণ বসুর লেখায়।
‘... দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদিগের ইংরাজ রাজপুরুষেরা আমাদিগের ন্যায্য আশা পূরণ করেন না।... ইংরেজি শিক্ষার দ্বারা আমাদিগের হৃদয়ে উচ্চ উচ্চ বাসনার উদ্রেক হইতেছে; কিন্তু রাজ-পুরুষেরা আমাদিগের সেই সকল বাসনা পূর্ণ করিতেছেন না। আমরা গভর্নমেন্টের দোষ সকল বিলক্ষণ বুঝিতে পারিতেছি; কিন্তু আমাদিগের হাত-পা বাঁধা, সে সকল দোষ সংশোধন বিষয়ে আমাদিগের কোনো কথাই চলে না। গ্রিক পুরাণে লিখিত আছে যে, ট্যাপ্টেলাস নামক এক ব্যক্তি নরকে একটি অদ্ভুত শাস্তি প্রাপ্ত হইয়াছিল। পিপাসায় আকুল, যেমন সে স্রোতের জল পান করিতে যায়, তেমনি জল তার ওষ্ঠদ্বয় হইতে পলায়ন করে। আমাদের দশা সেইরূপ হইয়াছে। আমরা যখন মনে করি যে, রাজ সম্বন্ধীয় কোন সুখ লাভ করিলাম, অমনি সেই সুখ আমাদিগের নিকট হইতে পলায়ন করে। আমরা ইংরাজি শিক্ষা না করিতাম; এ বিড়ম্বনা অপেক্ষা সে বরং ভালো ছিল।’
এই অভিমান থেকেই নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি বিজাতীয় ইংরেজির পরিবর্তে আপন মাতৃভাষার দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়ে ইংরেজিতেই যারা ভাব প্রকাশে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাদের কেউ কেউ এখন বাংলায় কথোপকথন রপ্ত করতে চাইলেন, ‘গুড নাইট-এর বদলে ‘সুরজনী’ বলে বিদায় সন্তাষ জ্ঞাপনের প্রয়াস পেলেন। এমন সমিতিও গড়ে উঠেছিল যেখানে আলাপ-আলোচনার সময় মুখ ফসকে ইংরেজি শব্দ বেরিয়ে গেলে রীতিমতো জরিমানা দিতে হতো, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেকালের কলিকাতার ইংরেজি-শিক্ষিত কতবিদ্য যুবকদের মুখ থেকে এমন এক অদ্ভুত বাংলা ভাষা নির্গত হতো যে, তাকে বাংলা বলে শনাক্ত করা কঠিন, বড়জোর ‘ঈঙ্গবঙ্গ ভাষা’ বলা যেতে পারে। ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ নামক গ্রন্থে কেদারনাথ মজুমদার উনিশ শতকের তিরিশের দশকের কোনো একটি পত্রিকা থেকে এ-রকমই একটি ‘ঈঙ্গবঙ্গ’ বক্তৃতার নমুনা উদ্ধৃত করেছেন,
‘বেঙ্গলের কি সোসিএল কি পলিটিকেল কি রিলিজিয়াস ম্যাটার, যে দিকেই যে পয়েন্ট অব ভিউ থেকেই দেখা যাউক না কেন সকলেতেই কেমন একটি রিভলিউশন উপস্থিত হইয়াছে এটি বেশ সহজে মার্ক করা যায়। বেঙ্গলী লিটেরেচারে যে সাধারণ নিয়মের কিছু, অন্যথা হইতেছে না ইহা নহে। অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় (অবকোর্স আমরা কনফেস করিতে বাধ্য) ইহাতেও ভয়ংকর রিভলিউশন উপস্থিত। আক্ষেপের বিষয় সকলের গতি এক ডাইরেকশনে। সেই এক বিলিতি জিনিসের ইমিটেশন। কেন? কেন আমরা নেশনালটি ত্যাগ করে ফরেনারদের কাছে ভিক্ষাপাত্র হাতে করে দাঁড়াইব। আমাদের ওয়ান্ট কিসের? আমাদের কি থট্ট্স নাই? না আমাদের আইডিয়া সকল প্রিয় বাঙ্গালা ভাষায় এক্সপ্রেস করিবার শক্তি নাই? আছে, আছে, আমাদের এ সেমফুল জীবনে উপস্থিত সম্ভ্রান্ত জেন্টেলম্যান ও লেডিস সমীপে আমার এই বিনীত প্রার্থনা যে, আমি অদ্যকার মিটিংয়ে এই একটি রিজলিউশন মুভ করিতে প্রস্তাব করি যে আমরা ন্যাশনাল লিস্টেচর ডিফেন্স ফান্ড নামক একটি ফান্ড স্থাপন করিয়া তদ্বারায় আমাদের ন্যাশনাল লিস্টেচরের রাইট রক্ষা করি।’
কেদারনাথ মজুমদার উল্লেখ করেছেন যে, বক্তৃতাটি উদ্ধৃত করে সেই সাময়িক পত্রিকা ‘বঙ্গভাষা’র জবানিতে একটি টিপ্পনি জুড়ে দিয়েছিল। বঙ্গসন্তানের মুখে এ-রকম বঙ্গভাষা শুনে ভাষাজননী নেপথ্য থেকে বলছেন,
‘আমারই শ্রাদ্ধ করি মোর সুতগণ
করিছে কেমন দেখ উন্নতি সাধন!’
আসলে, নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ ইংরেজি বিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে দেশের পুরো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেশের ভাষা থেকেও তাদের বিচ্ছিন্নতা ঘটে। ভাষা চিন্তা ধারক। চিন্তা যদি দেশীয় পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তবে দেশীয় ভাষার সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা অনিবার্য। আবার, বিদেশি ঔপনিবেশিক প্রভুর বিমাতা-সুলভ আচরণ সম্পর্কে সচেতনতা জাগে যখন, তখনও ওই নাগরিক গোষ্ঠীটির পক্ষে সেই বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে দেশের জনগণের ভাষায় অবলীলায় ভাব প্রকাশ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা ছাড়া, নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজ তো গণবিচ্ছিন্নতার নিরসন ঘটাতেও চায় না। তারা বরং সে বিচ্ছিন্নতাকে পুরোপুরি বহাল রেখে জনগণের শাসক হয়ে থাকতে চায়; কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের উপলব্ধিতে আসে যে, বিদেশি শাসকরা দেশীয় ওই উচ্চাকাক্সক্ষী গোষ্ঠীটির আকাক্সক্ষা চরিতার্থতার পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে রাখবেই। এই প্রতিবন্ধকতার মুখেই বিদেশি শাসকদের দেশীলয় প্রতিদ্বন্দ্বীরা আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই চালাতে চায় দেশীয় ভাষাকে ঢাল রূপে ব্যবহার করে। তাদের এই দেশীয় ভাষাপ্রীতি আন্তরিক নয় মোটেই।
অবশ্যি এ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে যারা শিল্পপ্রতিভাসম্পন্ন, অর্থাৎ আপন বক্ষে অলৌকিক আমাদের অপার বেদনাভার বহন করে যারা- তারা বিদেশি ভাবার নির্মোগজেক নিজেদের বেশি দিন আবদ্ধ করে রাখতে পারেন না। মাইকেল মধুসূদনের মতো তাদের সবাইকেই ‘মাতৃভাষা রূপ খনি পূর্ণ মণিজালে’র শরণ নিতে হয়; কিন্তু সাহিত্য-ভারতীর সেবক নন যারা, তাদের ও-সবের বালাই থাকে না। উনিশ শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ইংরেজ প্রভুর সঙ্গে মান-অভিমানের পালা গাইতে গিয়ে তারা এক ধরনের ‘ঈঙ্গবঙ্গ ভাষা’-চর্চার খেয়াল খেলা খেললেও পরবর্তী দশকগুলোতে প্রভুর ভাষাকেই বিষয়-কর্মের বাহন করে নিলেন প্রায়-নিদ্বির্ধায়। ১৮৭২ সালে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রের সূচনায় বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙালিদের সম্বন্ধে যথার্থই লিখেছিলেন,
‘লেখাপড়ার কথা দূরে থাক, নব্যসম্প্রদায়ের মধ্যে কোন কাজই বাঙ্গালায় হয় না। বিদ্যালোচনা ইংরাজিতে। সাধারণের কার্য, মিটিং, লেকচর, প্রোসিডিংস্ সমুদয় ইংরাজিতে। যদি উভয় পক্ষ ইংরাজি জানেন, তবে কথোপকথনও ইংরাজিতে হয়; কখনো যোল আনা, কখনো বার আনা ইংরাজি। কথোপকথন যাহাই হউক, পত্রলেখা কখনই বাঙ্গালায় হয় না। আমরা কখনও দেখি নাই যে, যেখানে উভয় পক্ষ ইংরাজির কিছু জানেন, যেখানে বাঙ্গালায় পত্র লেখা হইয়াছে। আমাদিগের এখনও ভরসা আছে যে, আগৌণে দুর্গোৎসবের মন্ত্রাদিও ইংরাজিতে পঠিত হইবে। ইহাতে কিছুই বিস্ময়ের নাই। ইংরাজি একে রাজভাষা, অর্থোপার্জনের ভাষা, তাহাতে আবার বহুবিদ্যার আধার, এক্ষণে আমাদের জ্ঞানোপার্জনের একমাত্র সোপান: এবং বাঙালিরা তাহার আশৈশব অনুশীলন করিয়া দ্বিতীয় ভাষার স্থানভুক্ত করিয়াছেন। এক্ষণে ইংরাজিতে না বলিলে ইংরাজে বুঝে না: ইংরাজে না বুঝিলে ইংরাজের কাছে মানমর্যাদা হয় না; ইংরাজের কাছে মানমর্যাদা না থাকিলে কোথাও থাকে না, অথবা থাকা না-থাকা সমান। ইংরাজ যাহা না শুনিল, তাহা অরণ্যে রোধন; ইংরাজ যাহা না দেখিল, তাহা ভস্মে ঘৃত।’
নতুন মধ্যবিত্ত বাঙালির ইংরেজির সঙ্গে গ্রন্থিবন্ধনের বৈষয়িক ভিত্তি ও বাস্তব অবস্থাটি বঙ্কিমচন্দ্র ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এ বাস্তবের রূপান্তর কামনাও তার চিত্তকে উদ্বেল করেছিল? তার দ্বিধাহীন উপলব্ধি: ‘যত দিন না সুশিক্ষিত জ্ঞানবন্ত বাঙালিরা বাঙ্গালা ভাষায় আপন উক্তিসকল বিন্যস্ত করিবেন, ততদিন বাঙালির উন্নতির সম্ভাবনা নাই।’
অথচ, জাতীয় চেতনা উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা ‘জাতীয় কংগ্রেসে’র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের সভা-সম্মেলনে বিজাতীয় ভাষাই ছিল বলা ও লেখার মাধ্যম। এ ব্যাপারে প্রথম প্রতিবাদ আসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে। অর্থাৎ এখানেও দেখি মাতৃভাষার মর্যাদা নিয়ে চিন্তাভাবনা মূলত সাহিত্যভারতীর হৃদয়বান সেবকদেরই, বৈষয়িক বুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষিত বাঙালির এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই নেই। রবীন্দ্রনাথ বার বার বহু প্রসঙ্গে মাতৃভাষার সুষ্ঠু চর্চার আবশ্যকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মাতৃভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রয়োজন সম্পর্কে যুক্তি উত্থাপন করেছেন; কিন্তু কী আশ্চর্য, ইংরেজ দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের চৈতন্যের আলোকে বাঙালির চিত্তলোকের জাগরণ ঘটতে পারলো না, ইংরেজ-রাজত্বের অবসানেও ইংরেজি-রাজত্বের অবসান হলো না।
ইংরেজের রাজত্ব গেল, বাংলা দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত আর পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য হলো। ভারতে রাজাভাষা ইংরেজি পরিবর্তে হিন্দির অধিষ্কার ঘোষিত হলো, রাষ্ট্র-বিধায়করা রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করলেন উর্দু নামক একটি সংকর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে। বহুভাষী বিশাল ভারতে ইংরেজির স্থান বাংলার দখলে এলো না- সাহিত্য-সম্পদের সারা ভারতে তার কোনো জুড়ি না থাকা সত্ত্বেও না। ভারতীয় বাঙালিরা বরং হিন্দু প্রতিরোধের অস্ত্র রূপে ইংরেজিকেই আরো বেশি করে আশ্রয় করলো, ইংরেজ তাড়িয়েও জীবনের সর্বস্তরে বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীন হলো যে- সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমাজ, তারা অবশ্যি ভারতীয় বাঙালি বাঙালিদের মতো এতো সহজে আপন মাতৃভাষার অধিকার ছেড়ে দিল না। ভাষার জন্য প্রাণ আত্মাহুতি দিয়ে তারা শুরু করল এমন এক কর্মযজ্ঞ, যার চূড়ান্ত ফলশ্রুতিতে তারা উপনীত হলো স্বাধীনতার পরম আকাক্সিক্ষত স্বর্গে।
বাংলা ভাষা-ভাষী জনগণ বাঙালির যে স্বাধীন রাষ্ট্রটির নাম পৃথিবীর মানচিত্রে স্বর্ণের অক্ষরে লিখে দিল, সেখানে তো আর বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে কোনো বাধা থাকারই কথা নয়। কারণ, বাংলাদেশ এক ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র, এ রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে অন্য কারো অধিকারে হস্তক্ষেপ না করেই। তবু, তেমন একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়ের পর অনেকটি বছর অতিক্লান্ত হয়ে গেলেও কি সে রাষ্ট্রের নাগরিককুল আপন ভাষায় আত্মবিকাশের নির্বাধ অধিকার পেয়ে গেছে? পায়নি যে, সে সত্য তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট; কিন্তু কেন পায়নি?
স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে অফিসের কাজকর্মে বাংলা ব্যবহারের উৎসাহ বেশ ব্যাপক হয়ে ওঠে। উৎসাহটা আসে মূলত নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দিক থেকে। পরিভাষার অভাব কিংবা টাইপরাইটার যন্ত্রের অপ্রতুলতা তাদের নিরুদ্যম করতে পারেনি; কিন্তু উপরতলার আমলা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও সমাজের বিভিন্ন হোমড়াচোমড়াদের বাংলা ব্যবহারে শুধু আন্তরিকতারই অভাব ছিল না, ছিল অনীহা ও বিরুদ্ধতাও। কারণ ওদের প্রায় সবারই মস্তিষ্ককোষ সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন, জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে তারা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেরই প্রতিভু-প্রীতম হয়ে বিরাজিত। মাতৃভাষার মাধ্যমে দেশের সব মানুষের চিত্তজাগরণ সাম্রাজ্যবাদ বা তার প্রতিভূদের স্বার্থের অনুকূল হতে পারে না স্বাভাবিকভাবেই।
স্বাধীনোত্তর কালের প্রথম দিকে তাদের কিছুটা ভয়ে ভয়ে থেকে রেখে ঢেকে চলতে হলেও মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানেই অবস্থা তাদের অনুকূলে এসে যায়, সাম্রাজ্যবাদের থাবা খুব শক্ত হয়ে এদেশের বুকে চেপে বসে স্বাধীনতাকেই বিদ্রুপ করতে থাকে। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের দেশীয় প্রহরীদের আর ভয়ডর বা সংকোচ বলে কিছু থাকে না, নির্বাধে ও প্রবল প্রতাপে তারা বিদেশি ইংরেজি দিয়ে স্বদেশি সমাজকে পূর্ব’বৎ শাসন করতে থাকে। ইংরেজি বিদ্যা আয়ত্তকারী মুষ্টিমেয় বাঙালিই শাসক বাংলাদেশি হয়ে স্বাধীনতার স্বাদু ফল আস্বাদন করে যাচ্ছে। আর, ইংরেজি-বিদ্যাহীন অপরিমেয় বাঙালিকে উপনিষ দোঙপক্ষিদ্বয়ের দ্বিতীয়টির মতো প্রথমটির আহার করা দেখেই তৃপ্তি পেতে হচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রের সর্বত্র বাংলার প্রয়োগ আবশ্যিক বলে ঘোষিত হওয়ার পরও প্রকৃত অবস্থার তেমন কোনো হেরফের হচ্ছে না।
এ অবস্থার অবসানের কি কোনোই পথ নেই?
সে পথের অনুসন্ধানে গিয়ে আমরা অবশ্যই ইংরেজি বিদ্বেষকে সম্বল করতে চাই না। আমরা বরং শতবর্ষ পর্বেকার বঙ্কিমচন্দ্রের মতো এখনও বলল ‘আমরা ইংরাজি বা ইংরাজের দ্বেষক নহি। ইহা বলিতে পারে যে, ইংরাজ হইতে এদেশের যত উপকার হইয়াছে, ইংরাজি শিক্ষাই তাহার মধ্যে প্রধান। অনন্ত রত্নপ্রসূতা ইংরাজি ভাষার যত অনুশীলন হয়, ততই লাভ।’
ইংরেজি ভাষার মধ্যস্থতাতেই বাঙালি ইউরোপীয় রেপেমাম জিস্দার সঙ্গে যুদ্ধ হতে পেরেছিল, বুর্জোয়া বিপ্লবের ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছিল, নতুন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও বিজ্ঞান-চেনার সংস্পর্শে আসতে পেরেছিল,- এসব কথা আমরা কিছুতেই ভুলে যেতে পারি না এবং এখনও যে আমরা ইংরেজির সাঁকো বেয়েই আন্তর্জাতিক জ্ঞানভাণ্ডারের নাগাল পেতে পারি, সে সত্যের দিক থেকেও মুখ ফিরিয়ে রাখা চলে না; কিন্তু সে সঙ্গে এ কথাও তো বিস্মৃত হতে পারি না যে, বিজাতীয় ভাষা যত সমৃদ্ধই হোক না কেন তা দিয়ে জাতীয় আত্মবিকাশ কোনো মতেই সম্ভব নয়। জাতীয় আত্মবিকাশের জন্য সবার আগে প্রয়োজন সব রকম দৃশ্য অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদী নিগড় থেকে মুক্তি। সাম্রাজ্যবাদের হাতে বাঙালির নিগ্রহ জুটেছে প্রচুর; বাঙালি-যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেনি, তা-ও নয়; কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হতে পেরেছে খুব কম বাঙালিই।
যে নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজি শিখে কখনও কায়মনোবাক্যে ইংরেজের সেবা করেছে, কখনও ইংরেজের সঙ্গে অভিমান করে ইংরেজি বর্জনের মহড়া দেখিয়েছে, কখনওবা প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার পরিচয় রেখেছে, বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তাদের একটা বড় অংশেরই সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে যে কোনো মাথাব্যথা রইলো না, বরং সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থের সঙ্গেই যে তাদের স্বার্থবোধ এক তারে বাঁধা সে বিষয়টিতে আমরা আগেই লক্ষ্য করেছি।
আর যারা সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মোটামুটি মোহমুক্ত তাদেরও অনেকেরই এর চরিত্র সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। কাজেই এদের কাউকে দিয়েই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম হচ্ছে না। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম ছাড়া দেশটির প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতাও হবে না। প্রকৃত স্বাধীনতা ছাড়া দেশ কোনো দিক দিয়েই স্বনির্ভর হয় না, স্বনির্ভরতা আসে না স্বভাষার ক্ষেত্রেও। স্বভাষার মাধ্যমে আতাবিকাশের বৈষয়িক ও মানসিক ভিত্তি যে আপ্তাব্দী-প্রাচীন। ধর্ম তুলতে পারিনি, তার প্রমাণ মেলে অজস্র ইংরেজি কেতার বিদ্যর জন্ম হয়েছিল শিক্ষার সর্ববিষয়ে ও সর্বস্তরে বাংলা মাধ্যমের বিস্তার না ঘটার মধ্যে। সমর্পণ করে বাংলা ও বাঙালির প্রকৃত স্বাধীনতা যারা চায়, তাদের প্রত্যেকেরই গতিরাষ্ট্রের বিষয়ের প্রকৃত নিদান সন্ধান করতে হবে।
স্বভাষা-প্রীতি যাতে পরভাষা-বিদ্যেকটি জনয়িতা না হয় সেদিকে যেমন দৃষ্টি রাখা দরকার তেমনি দরকার পরভাষারুর দাস্য থেকে মুক্তি। বাঙালি একদিন যে ইংরেজি বিদ্যা শিখেছিল নিতান্তই ক্ষুদ্র বৈষয়িক স্বার্থের তাগিদে সে বিদ্যাকে প্রয়োগ করতে হবে চিত্তের সম্পদ বৃদ্ধির কাজে। এর জন্য শুধু সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামই যথেষ্ট নয়, বিজ্ঞানসম্মত শ্রেণিচেতনা ও আন্তর্জাতিকতা বোধের বিস্তারও একান্ত প্রয়োজন। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী ঘোলাজলের ডোবার মধ্যে যে বৃহৎ ও মহৎ কিছুই লভ্য নয়,- একথা সর্বদা স্মর্তব্য। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দিয়ে শুরু করে আমরা স্বাধীন মাতৃভূমি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছি; সে ভূমিতে মাতৃভাষার মর্যাদা যতটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকে খাট করে দেখবো না আমরা নিশ্চয়ই, আবার আত্ম-প্রসাদের মৌতাতে মজে ঘোলাজলের ডোবাতেও আবদ্ধ হয়ে থাকবো না-‘চরৈবেতি’ মন্ত্রের সাধক হতে হবে আমাদের?
যতীন সরকার: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে