Views Bangladesh Logo

ছোটগল্প

কাফন

Banu  Mushtaq

বানু মুশতাক

নারীর গভীর বেদনা অনুভব করে উপরের কথাগুলো লিখেছেন এবারের বুকার পুরস্কার বিজয়ী কথাশিল্পী বানু মুশতাক। বানু মুশতাক একজন ভারতীয় লেখক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী। ১৯৪৮ সালে কর্ণাটকের একটি ছোট শহরে মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি। ৭৭ বছর বয়সী বানু মুশতাক কান্নাড়া ভাষায় লেখালেখি করেন। ছোটগল্পের সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর জন্য বুকার পুস্কার-২০২৫ অর্জন করেছেন তিনি। কান্নাড়া ভাষায় লেখকদের মধ্যে তিনিই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি পেলেন।

বানু মুশতাকের ছোটগল্পের সংকলন কান্নাড়া ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি। ‘হার্ট ল্যাম্প’-এ ১২টি গল্প সংকলিত হয়েছে, যেগুলো ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। গল্পগুলোতে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম সমাজের দৈনন্দিন জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা-অনুভূতির গল্প প্রাধান্য পেয়েছে। তার ‘হার্ট ল্যাম্প’ছোটগল্পের সংকলন থেকে ‘দ্য শেরউড’ (The Shroud)গল্পটি বাংলা অনুবাদ করেছেন আতিফা নাওয়ার


মাঝে মাঝে সাজিয়া ফজরের নামাজের জন্য সময়মতো ঘুম থেকে উঠতে পারতো না। তখন সে তার উচ্চ রক্তচাপের জন্য খাওয়া জঘন্য ট্যাবলেটগুলোকে দোষ দিতো আর বলতো এগুলোই তার যত অশান্তির কারণ।

তার মা বলতেন, ‘এসব শয়তানের খেলা। শয়তান খুব ভোরে আসে, তোমার পা টিপে, কম্বলের আরাম জড়িয়ে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে নামাজ পড়া থেকে বিরত রাখে। তোমার তাকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে এবং ঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করার অভ্যাস করতে হবে।’ শয়তানকে ব্যক্তিগত চাকর ভেবে পা টেপানোর ব্যাপারটা সাজিয়ার কাছে বেশ রোমান্টিক লেগেছিল, তাই তাকে কয়েকবার লাথি মারার ভান করার চিন্তা করেই সে মজা পেত। এই কারণে দেরিতে ঘুম থেকে উঠে শয়তানকে দোষ দেওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল।

সেদিনও সে গভীর ঘুমে ছিল, আর ভোর হয়ে গেছে অনেক আগেই। সে অবাক হয়ে ঘুম থেকে উঠে নিজের দিকে তাকিয়ে ঠিক কোথায় আছে বুঝতে পারলো না, যদিও পাশে স্বামীর স্পর্শ পেল হাত বাড়াতেই। সে খেয়াল করলো যখন তার মাথা নিজের বালিশের ওপর, বিদেশ থেকে আনা কম্বলটি তার শরীরে জড়ানো, তখনই সে বুঝতে পারলো সে আসলে তার নিজের ঘরে আছে। বুঝতে পেরে সে খুশি হয়ে উঠল এবং তৃপ্তি বোধ করলো, চেনা পরিবেশে ঘুম থেকে উঠতে পারার তৃপ্তি।

কিন্তু এই তৃপ্তি তার বেশিক্ষণ থাকলো না। বাইরে কেউ একজন কাঁদছে শুনতে পেয়ে ধীরে ধীরে উঠে দরজার কাছে যেতে যেতে সে তার ছেলে ফরমান কার সঙ্গে যেন কথা বলছে শুনতে পেল। সে তাড়াহুড়ো করে বারান্দায় এসে দেখল আলতাফ দাঁড়িয়ে আছে, তাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছে। ফরমান তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। "যা হওয়ার তা তো হয়েছে," সে বলল, "এটা কারো হাতে নেই। চিন্তা করো না, বাড়ি যাও। আম্মি ঘুম থেকে উঠলে আমি তোমার বাড়িতে সবকিছু পৌঁছে দেব। সে এখন ঘুমিয়ে আছে, আমি তাকে জাগাবো না, তার শরীর খুব একটা ভালো নেই। ডাক্তার তাকে প্রচুর বিশ্রাম নিতে বলেছেন।"

“কিন্তু ভাইয়া, মসজিদের জামাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে আজ ভোর ৫টায় দাফন হবে। আর কেউ নেই অপেক্ষা করার মতো। তাই গোসল এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় শেষ করে ফেলতে হবে,” আলতাফ আবার বলল। ফরমান মেজাজ হারিয়ে বলল, “দেখো, তুমি আমার কাছে কোনো কাফনের কাপড় জমা রাখোনি। আম্মি হজ থেকে ফিরে এসেছে ছয়-সাত বছর হয়ে গেছে। এত বছর আগে ইয়াসিন বুয়া আম্মির কাছ থেকে তার কাফনের কাপড় চেয়ে নিল না কেন? অথবা এমন হতে পারে হয়তো সে এটা নিয়ে কোথাও রেখেছে। আরেকবার ভালো করে বাড়িতে খুঁজে দেখো তো!”

ছেলের পেছনে এসে দাঁড়ানো সাজিয়া চমকে উঠলো। "কি হচ্ছেটা কি এখানে?" সে ডাক দিয়ে বলে উঠল, "ফরমান, কার সঙ্গে কথা বলছো বেটা?" ফরমান তার মায়ের দিকে ফিরে তাকালো; তার মুখে অধৈর্য্যের ছাপ চেপে বসেছিল। সে মনে মনে ভাবলো, "এই মেয়ের জাত খেয়েপরে চুপচাপ নিজের চরকায় তেল দিতে দিতে পারে না! কোনো একটা ঝামেলায় না জড়ালে মনে হয় তাদের ভাত হজম হয় না।" কিন্তু সে তার বিরক্তি চেপে বলল, "ঘুমাতে যাও আম্মি। তুমি আবার উঠতে গেলে কেন? আলতাফ আছে এখানে। ইয়াসিন বুয়ার ছেলে। সে একটা কাফনের কাপড়ের কথা জানতে চাইছিল।"

মাথার ওপর হাজার বাজ পড়েছে মতো মনে হলো তার। সে উদ্বিগ্নভাবে এগিয়ে যুবকটির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাগী স্বরে জিজ্ঞাসা করল: “সাতসকালে এত হট্টগোল করছো কেন? কাফন কি কোথাও পালিয়ে যাবে? তোমার কি এতটুকু আক্কেল নেই কার বাড়িতে কখন আর কীজন্য যাবে?” ফরমানের যে এসব ব্যাপার মোটেই পছন্দ না এটা তার কাছে স্পষ্ট। আলতাফ তার গলার স্বর নিচু করে স্থির দৃষ্টিতে পিছনে তাকিয়ে বিষণ্ন হয়ে বলল, “চিক্কাম্মা, আম্মি আজ সকালে ফজরের নামাজের সময় ইন্তেকাল করেছেন। সেই কারণেই আমি কাফন চাইতে এসেছি।” খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সাজিয়া ভেঙে পড়ে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে কাছের একটি চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। অকল্পনীয়, অসম্ভব ঘটনাটি ঘটেছে। এখন কীভাবে এটার মুখোমুখি হবো? কীভাবে এর সমাধান করবো? এই চিন্তাগুলো তার নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ল। “হে খোদা, শেষ পর্যন্ত একি করলে তুমি,” সে বিলাপ করে উঠল।

যদিও সে চাইছিল না, তবুও তার মন চলে গেল সেই বিশেষ দিনে। সেদিন তার বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান ছিল। তার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবরা সবাই এসেছিল। সাজিয়া এবং তার স্বামী সুবহান হজে যাচ্ছিলেন। তারা ইতোমধ্যেই তাদের বেশিরভাগ নিকটাত্মীয় এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা করে ফেলেছিলেন। সবাইকে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করেছিলেন যে তাদের কোনো কথায় বা আচরণে দুঃখ বা কষ্ট দিয়ে থাকলে বা প্রিয়জনদের কোনো অভিযোগ থাকলে কিংবা তাদের স্বামী-স্ত্রীর নামে অনিচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে থাকা কোনো কানকথায়ও যদি আঘাত পেয়ে থাকে কেউ তাদের যেন ক্ষমা করে দেয়। আত্মীয়রা এই দম্পতির জন্য ভোজও আয়োজন করে, তাদের উভয়কেই সামর্থ্য অনুযায়ী পোশাক এবং উপহার দিল, তাদের ক্ষমা করে দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সাজিয়া এবং সুবহানকে অনুরোধ করেছিলেন কোনো অপরাধ করে থাকলে তারাও যেন তাদের ক্ষমা করে দেয়। পরস্পরের ভুলত্রুটি নিয়ম মেনে ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে এই ভেবে মনদিল হালকা করে খোশমেজাজে নিকটাত্মীয় আর বন্ধুরা তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়।

তবুও, তাদের হজযাত্রার যখন এক সপ্তাহ বাকি, তখনো অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। তারা স্বামী-স্ত্রী আত্মীয়দের মধ্যে যারা দূরে থাকে তাদের ফোন করে তাদের যে কোনো ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছিল। একটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিক সুবহান এবং বিশাল এক বাংলোর মালকিন সাজিয়া যাওয়ার আগে তাদের আত্মীয় পরিজন এবং বন্ধুদের সবার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করার সময় পাননি। সেই কারণেই তারা সকলকে একত্রিত করার জন্য একটি মেজবানের আয়োজন করলেন। পারস্পরিক ক্ষমা চাওয়ার রীতি সেখানেও জারি ছিল।

নিমন্ত্রিত না হয়েও মনে কোনোরকম দেমাগ বা বিদ্বেষ না রেখে যে এসেছিল সে হলো ইয়াসিন বুয়া। তার স্বামী বিয়ের তিন বছরের মধ্যে তাকে দুটি সন্তান দেয় এবং তারপর পেছনে ফিরেও তাকাননি। তিনি এপিএমসির উঠোনে কুলি হিসেবে কাজ করতেন, এবং একদিন, বোঝা টানার সময়, তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর ইয়াসিন বুয়া ইদ্দত পালন করেননি। খুব অল্পবয়সী সেই নারী তখন মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে বিভিন্ন বাড়ির সামনের উঠোনে বাসন ধোওয়া মাজা, ঝাড়ু এবং বাড়িঘর পরিষ্কার করার কাজ শুরু করে। বিয়ে, উৎসব, জন্মদিন অনুষ্ঠানের যত ঝুটঝামেলা এবং হুল্লোড় সহ্য করে একলাই সামলাত যাতে তার ছোট বাচ্চাদের পেট খালি না থাকে। ইদ্দতের সময়, সে মাথা ঢেকে ঘরে বসে ছিল না, প্রয়াত স্বামীর জন্য প্রার্থনা করেনি এবং শোকের বাধ্যতামূলক সবকিছু এড়িয়ে চলার সময়ও পালন করেনি। অনেকে নানান কথা শুনাতে ছাড়েনি তাকে। শত কাদা ছোড়াছুড়ি সত্ত্বেও, তার কাছে তার সন্তানদের মঙ্গল এবং ক্ষুধার্ত পেট বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার কঠোর পরিশ্রমের ফলেই তার সন্তানরা তাদের জীবন সুন্দর করে গড়ে তুলতে পেরেছে। কিছুদূর পড়াশোনা করেই তার মেয়ে ছোট মেয়েদের কুরআন পড়িয়ে টাকা আয় করত। ইয়াসিন বুয়া সেই টাকা নিজের বাঁচানো টাকার সঙ্গে জমিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয় এবং ছেলের সঙ্গে থাকত, যে কিনা পেশায় একজন অটোচালক। যখন তার হাড়গুলো ঠক ঠক শব্দ করতে শুরু করে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন তার হাতের শিরা ফুলে উঠতে শুরু করে, তখন সে অন্যের বাড়িতে কাজ করা কমিয়ে দেয়।

ছেলের বিয়ে দেওয়ার বেশ ইচ্ছা ছিল তার; কিন্তু এর চেয়েও আরেকটা বড় ইচ্ছা ছিল তার শরীর, মন এবং আত্মাজুড়ে। সারাদিন ধরে সে আকাঙ্ক্ষার আগুন জ্বলতো তার ভেতর। প্রতিটি পয়সা জমিয়ে রাখতেন তিনি কৃপণতা থেকে না, বরং অনিরাপদ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যখন সে তার ছেলের বিয়ের জন্য জমানো বান্ডিল থেকে কিছু টাকা বের করে নিজের জন্য কাফন কিনতে চাইল, তখন তার মনে হতে লাগল যেন সে অন্য কারো কাছ থেকে চুরি করেছে। এই অপরাধবোধ তাকে কুরে কুরে খেলো, অস্থির করে তুলল তাকে এবং তিন দিন ধরে টাকাগুলো তার আঁচলে বাঁধা রইলো; কিন্তু তার মাতৃত্বের টানও তার ব্যক্তিগত স্বপ্নের তীব্রতার কাছে হেরে গেলো। এক অদ্ভুত জেদ ইয়াসিন বুয়ার উৎসাহকে দ্বিগুণ করে দিল। সে তার শাড়ির আঁচলে বান্ডিলটি শক্ত করে ধরে দ্রুত সাজিয়ার বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখে অনেক মানুষ, অনুষ্ঠান, উৎসব...

তার কোনো নিমন্ত্রণ ছিল না। তাকে স্বাগত জানানোর জন্য দরজায় কেউ ছিল না বলার, ‘ওহ, তুমি এসেছো!’ কেউ ছিল না ডেকে বলবে, "আরে খেতে এসো", অথবা তাকে কোনো আতিথেয়তা দেখানোর জন্যও কেউ ছিল না। সে জীবনে কখনো জানল না কীভাবে আলাদা ভাবে সম্মানিত হতে হয় এবং সম্মানিত হওয়ার অনুভূতিটাই বা কি! অবশ্য সে কাউকে তাকে অসম্মান করারও সুযোগ দেয়নি। সে যতটা সম্ভব পারে খেটে গেছে। চীনামাটির বাসনগুলো ধোয়ার সময় তার হাত থেকে প্রায় পড়ে গিয়েছিল। বিরিয়ানির তেল এখন এত সহজে ধুলেও যায় না, তাই না? সবাই খাওয়া শেষ করার পর, সে সামনের উঠোনে সিমেন্টের ওপর বসে একগাল খেয়ে নিল। তার সমস্ত মনোযোগ সাজিয়ার দিকে। "কি ভাগ্যবান মহিলা, কি সৌভাগ্যবতী," সে নিজেকে বারবার বলল। সে ভাবছিল যে সাজিয়ার কখন ফুরসত মিলবে এবং কীভাবে সে তার ইচ্ছাটা বলবে, সে তাই ধৈর্য ধরে সাজিয়ার সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল।

সাজিয়া কখন একটু অবসর পাবে? অসংখ্য আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে শুভেচ্ছা এবং উপহার পেয়ে পেয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ যখন তাকে জড়িয়ে ধরে মঙ্গল কামনা করছিল, তখন তারা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলোও বলছিল এবং হজের সময় তাকে তাদের জন্য দোয়া করতে বলছিল। "সাজিয়া আপা, আমি আমার ছোট মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজে পাচ্ছি না। দয়া করে তার জন্য দোয়া করবেন," একজন অনুরোধ করল। অন্যজন বলল, "আমার ভাবী ক্যান্সারে আক্রান্ত। দয়া করে প্রার্থনা করবেন যেন সে দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠে।" "আমার ছেলে চাকরি পাচ্ছে না। সে অনেক কষ্টে আছে। দয়া করে তার জন্য দোয়া করবেন।" সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাবি-দাওয়ার তালিকা আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। সাজিয়া হাসিমুখে উত্তর দিতে থাকে, "ইনশাআল্লাহ, আমি তাদের জন্য দোয়া করব," এবং যদিও সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল, সে তা দেখায়নি এবং আনন্দচিত্তে হাসিমুখে সবাইকে বিদায় জানায়। যদিও মেজবান আয়োজন করা হয়েছিল দুপুরের খাবারের জন্য, তবুও সন্ধ্যা পর্যন্ত মেহমান আসতে থাকে। ইয়াসিন বুয়া থালাবাসন মেজে, পরিষ্কার করে, ঝাড়ু দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কবে তার পালা আসবে।

রাত প্রায় ১১টার দিকে, ক্লান্ত সাজিয়া যখন অবশেষে সোফায় বসে নরম কার্পেটের ওপর পা ছড়িয়ে বসল, তখন সে বসার ঘরের দরজার কাছে ইয়াসিন বুয়ার ছায়া দেখতে পেল। বুয়া চিন্তিত হয়ে বলল, "আহারে বেচারি! কি যে ক্লান্ত দেখাচ্ছে," এবং সাজিয়ার জন্য খারাপ লাগল তার। সে আঁচলে দুই হাত মুছে সাজিয়ার দিকে এমনভাবে পা টিপে টিপে গেলো যেন তার নোংরা এবং ফাটা গোড়ালি মূল্যবান কার্পেটের ওপর না পড়ে। "তুমি কখন এসেছ, বুয়া?" সাজিয়া অনিচ্ছা সহকারে জিজ্ঞেস করল।

সাজিয়ার সঙ্গে অবশেষে দেখা করতে পেরে সে অত্যন্ত খুশি, উত্তর দিল, “আমি অনেক আগে এসেছি, আপা।” “ওহ, তাই না? সারা সন্ধ্যা তোমাকে খুব কমই দেখেছি,” সাজিয়া বলল, এবং নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি খেয়েছ?” “হ্যাঁ, আপা। আপনার বাড়ির ভাত খেতে পেরেছি বলেই বেঁচে আছি এখনো। আপনি যা স্পর্শ করেন তাই যেন সোনায় পরিণত হয়। আপনার বাড়ি আরও ভরে উঠুক।” সাজিয়া তৃপ্ত বোধ করল। “এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, বুয়া। তুমি বাড়ি কীভাবে যাবে?” এই নারীসুলভ উদ্বেগের কথা শুনে সে উত্তর দিল, “আলতাফ বলেছে সে আমাকে তার অটোতে করে বাড়ি নিয়ে যাবে। সে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি চলে যাব।” সাজিয়া খেয়াল হলো যে ইয়াসিন বুয়া সারা দিন কোনো না কোনো কাজ করে গেছে। তাই সে জোর করে নিজেকে তার ঘরে টেনে নিয়ে কিছু টাকা বের করে আনল। “এটা রাখো বুয়া, তোমার খরচের জন্য কিছু টাকা। আমরা তিন দিন পরে হজে যাচ্ছি, এবং ৪৫ দিন পরে ফিরে আসব। আল্লাহ আমাদের হজ কবুল করুন। আমাদের জন্য দোয়া করিও।”

সে বুয়ার দুই হাত টেনে টাকাগুলো হাতের ওপর রাখলো। ইয়াসিন বুয়া অভিভূত হয়ে গেল। সাজিয়াকে তার মতো একজন হতদরিদ্রের সঙ্গেও এত আন্তরিক এবং করুণাময় আচরণ করতে দেখে তার চোখে পানি চলে এলো। সে সাজিয়ার কাছ থেকে টাকা নেয়নি। বরং, সে তার শাড়ির শেষ প্রান্তের দুই-তিনটি গিঁট খুলে কিছু ভাঙা নোট বের করে। সাজিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে সে অনুনয় করে বলে: "আপা, এখানে ৬ হাজার টাকা আছে। আপনি হজ করতে যাচ্ছেন। পবিত্র জমজমের পানিতে চুবিয়ে আমার জন্য একটা কাফন নিয়ে আসবেন। অন্তত সেই পবিত্র কাফনের জন্য হলেও যেন আমি বেহেশতে যেতে পারি।"

এক মুহূর্তের জন্য সাজিয়া বুঝতে পারল না কী বলবে। তখন এটা খুব একটা কঠিন কাজ বলে মনে হচ্ছিল না। "আরেহ, মাত্র তো একটা কাফন। একটু বেশি টাকা খরচ হলেও আমি এটা ওর জন্য আনতে পারব," সে মনে মনে ভাবল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটুও না ভেবে রাজি হয়ে গেল।

যখন নোটগুলো বুয়ার হাত থেকে তার নিজের হাতে এলো, তখনই সাজিয়া বুঝতে পারল, গরিবদের পকেট থেকে আসা টাকা ঠিক তাদের মতোই ছেঁড়া-ফাঁড়া, দুমড়ে মুচড়ে কুঁচকে যাওয়া, ভাঁজ পড়া, এবং আকারে ছোট। তখন তার মনে হলো গরিবদের কাছে যদি খাস্তা নোটও দেওয়া হয়, তবুও টাকাগুলো অদ্ভুত এবং কুৎসিত কিছুতে পরিণত হবে; এখন সে নিশ্চিত হয়ে গেল। "ঠিক আছে, বুয়া, তুমি যাও এখন আর আবার এসো ," বলে তাকে বিদায় জানাল। সাজিয়া তৎক্ষণাৎ বাথরুমে গিয়ে টাকাগুলো সিঙ্কের ওপরে রাখল এবং বিছানায় শুয়ে পড়ার আগে জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুয়ে ফেলল।

সাজিয়ার মনে ছিল না সে যে ইয়াসিন বুয়ার টাকা নিয়েছিল তা সিঙ্ক থেকে তুলেছিল কি না। হজ কমিটির আয়োজনে সকালের ফ্লাইটে উঠে মদিনা পৌঁছে গেল। নতুন পরিবেশ, ধর্মীয় স্থান পরিদর্শন এবং আট দিনের থাকাকালীন বাধ্যতামূলক ৪০ রাকাত নামাজের সঙ্গে কীভাবে যে সময় কেটে গেলো খেয়ালও করেনি। সুবহান তাকে কেনাকাটা করতে নিষেধ করেছিলেন। তবুও বিধিনিষেধের আর কি পরোয়া ছিল তার? সে বিশ্বাস করত যে নিয়ম তৈরি হয় ভাঙার জন্যই, এবং সে বিনা দ্বিধায় যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এক্ষেত্রেও ঘটনার ব্যতিক্রম হলো না।

সুবহান সাজিয়াকে নিয়তের কথা মনে করিয়ে দেয়। হজে যাওয়ার আগে, তারা হজ এবং নামাজের জন্য নিয়ত স্থির করে রেখেছিল। সুবহান তাকে বলেছিল যে হজ শেষে সে তার কেনাকাটা করতে পারবে, এবং তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে যে এই সময়ে কেনাকাটা করলে তাদের নিয়ত নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যখন তারা মক্কার উদ্দেশ্যে মদিনা ত্যাগ করে, তখন সাজিয়ার আবারও এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়। হজ পালন করতে গিয়ে সে তার গ্রাম এবং বাড়িকে একদমই ভুলে গিয়েছিল। মক্কায় থাকাকালীন অভিজ্ঞতা ছিল মনে রাখার মতো। ভারতের হজ কমিটি বেশ কয়েকটি ভবন ভাড়া নিয়েছিল। হাজিরা কে কোনো রুম পাবে তা কে কত ভাড়া দিচ্ছে সেভাবে ঠিক হতো। দুটি কক্ষের জন্য একটা বাথরুম, একটা ছোট রান্নাঘরে একটা গ্যাস সিলিন্ডার এবং একটি চুলা, একটি ফ্রিজ, একটি ওয়াশিং মেশিন এবং বাসিন্দাদের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগি করে থাকতে হতো। যেহেতু সাজিয়ার মায়ের পরিবারের চার সদস্যও তাদের সঙ্গে হজে এসেছিলেন, তাই তাদের জন্য একটি বড় রুম ঠিক করা হয়েছিল। যথারীতি, দলের মহিলারা রান্নার দেখাশোনা করতে লাগলো। এ ছাড়া তাদের নামাজ, কাবাঘর প্রদক্ষিণ, প্রার্থনা এবং অন্যান্য ধর্মীয় রীতি পালন করতে চলে যায় বেশিরভাগ সময়। হেরা গুহা পরিদর্শন করতে যায় তারা যেখানে রাসুল (সা.) প্রথম ওহি লাভ করেছিলেন, এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ পরিদর্শন ও নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করাতে তারা মূলত ব্যস্ত ছিল। সৌদি সরকার বড় বড় ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য দাতাদের মাধ্যমে বিশাল ট্রাক থেকে খাবারের প্যাকেট, জুস এবং পানির বোতল বিতরণ করে থাকে নামাজের পর হজযাত্রীদের কাছে। যেহেতু হজযাত্রীরা আল্লাহর মেহমান, তাই তারা বিশ্বাস করে হজযাত্রীদের সঙ্গে ভালো আচরণ করলে আল্লাহ খুশি হবেন। তাই, সকলেই এমন আচরণ করত যেন আতিথেয়তাই ওদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য।

সাজিয়া এবং তার দল হজের বাকি আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ করে এনেছিল। একদিন বিকেলে, সে নামাজ পড়ে কাবাঘর থেকে ফিরে এলো। না চাইতেও তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল, সম্ভবত প্রচণ্ড রোদের কারণে, অথবা খাবার খাওয়ার পরের আলসেমির কারণে। ভাতঘুম থেকে জেগে সে কিছুটা সতেজ বোধ করল। শীঘ্রই আসরের নামাজ পড়তে দলটিকে মসজিদ আল হারামে যেতে হবে। যখন সে ওজু করতে বাথরুমে গেল, তখন সে যা দেখতে পেল তা তাকে কিছুক্ষণের জন্য স্থবির করে দিল: পাশের ঘর থেকে জয়নব তাদের খাবার পানির ডিসপেনসার থেকে ১০ লিটারের বালতিতে পানি ঢালছিল। সাজিয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, "জয়নব, কী করছো তুমি?"

জয়নব চারপাশে তাকিয়ে বলল, "আমাকে কাফন ধুতে হবে।"

"তুমি কি বললে?" সাজিয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে জিজ্ঞেস করল। "তুমি পানি চুরি করছো। এটা কি ঠিক হচ্ছে? হজের সময়ও তুমি তোমার ছোটলোকি আচরণ ছাড়তে পারোনি।" সে চিৎকার করতে লাগলো এবং জয়নব দ্রুত বালতি নিয়ে তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। সাজিয়া বুঝতে পারলো কি হচ্ছে। সৌদি সরকার হজযাত্রীদের খাবার পানি সরবরাহের দায়িত্বে ছিল। পানি কোম্পানিগুলো বিশাল প্লাস্টিকের জারে করে তা আনেনি। পরিবর্তে, তারা কাবা কমপ্লেক্সের ভিতরের কূপ থেকে জমজমের জল ট্যাঙ্কারে ভরে দুই কক্ষের ভাগ করা ডিসপেনসারে ভর্তি করত। এতে ১০ থেকে ১৫ লিটার পানি থাকত এবং প্রতিদিন বিকেল ৩টার দিকে আবার ভরা হত। সাজিয়া খুব কমই এটি থেকে পানি পান করত। বেশিরভাগ রাতে সুবহান নামাজ থেকে ফেরার পথে খাওয়ার জন্য ৫ লিটারের বোতল কিনে আনত।

সাজিয়া রেগে গেল। জয়নবের উত্তর যেন তার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। তার সাহস দেখে হতাশ হয়ে সে ভাবলো জয়নব না জানি তার পানি চুরি করে কত কাফন ভিজিয়েছে। ইয়া আল্লাহ! সে কি তার পুরো পরিবারকে জমজমে ভেজা কাফনে শুইয়ে দেবে নাকি? সাজিয়া এই সব ভাবছিল, এবং সুবহান, স্ত্রীর জোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সাজিয়া হাসছে। সে কি কিছুক্ষণ আগে তার চিৎকার কল্পনা করেছিল কিনা বুঝতে না পেরে স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করল, "কি হলো সাজিয়া? এত হাসির কি হলো?" হাসতে হাসতে সে তাকে ঘটনাটি বলল, "ওগো, দেখো তো, এই লোকগুলো হজ করতে এসেও হজের মর্ম বোঝে না। হজে এসেও ছোটখাটো জিনিসের জন্য দুই নম্বরি করা লাগে এদের।" সে একটু হেসে উত্তর দিল, "তুমি কি আজই এটা জানলে নাকি? আমরা যেদিন এখানে এসেছি সেদিনই আমি এটা লক্ষ্য করেছি; কিন্তু তোমার মতো রাগ করে ঝগড়া করিনি। এই কারণেই আমি আমাদের ব্যবহারের জন্য পানি কিনতে শুরু করেছি। ছেড়ে দাও। এটা চেঁচামেচি করার মতো কিছু না।"

সাজিয়ার হঠাৎ বুয়ার কাফনের কথা মনে পড়ল। “হ্যাঁ গো! দেখো তো , আমাদের ইয়াসিন বুয়ার জন্য একটা কাফন কিনতে হবে। মাগরিবের নামাজের পরে চলো যাই,” সে তার প্রতিশ্রুতি মনে করে বলল, এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। সুবহান মাথা নেড়ে তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে গেল, কারণ দেরি হয়ে যাচ্ছিল। যেমনটি তারা ভেবেছিল, আল-হারামে পৌঁছে দেখে বেশ ভিড়, মহিলা এবং পুরুষরা রীতি অনুসারে আলাদাভাবে জড়ো হয়েছিল। তারা সকলেই মসজিদের স্তম্ভের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল, শ্রদ্ধার সঙ্গে হাত জোড় করে, মাথা নিচু করে। যেহেতু তারা দেরি করে ফেলেছিল, সাজিয়া এবং সুবহান মসজিদের বিস্তৃত চত্বরে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। চত্বরটিও খুব দ্রুত দেরিতে আসা অন্যান্য লোকদের দ্বারা ভরে গেল। সূর্য উঠলে এবং রোদের তাপ বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশাল ছাতাগুলো ছায়া দেওয়ার জন্য তাদের ডানা মেলে খুলে যেতো। সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডানাগুলো ভাঁজ হয়ে যেতো স্তম্ভের মতো- এই দৃশ্যটা সাজিয়াকে বেশ টানতো।

এশার নামাজের পর তারা কাবা কমপ্লেক্স থেকে ফিরে এলো। লাখ লাখ লোকের ভিড়ের মধ্যে বড় রাস্তার পাশে ফুটপাতের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুবহান বুঝতে পারছিল না যে সাজিয়ার জন্য ইয়াসিন বুয়াকে কিনে দেয়ার জন্য কাফনের দোকান কোথায় পাওয়া যাবে। সে তার স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে লাগলো, চিন্তিত ছিল যে যদি সে হারিয়ে যায় তাহলে তাকে আবার ভিড়ের ভিতর থেকে খুঁজে বের করতে হবে। সে তার স্ত্রীর হাত এবং কোমর হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কোনো লজ্জা বা দ্বিধা না করে। তাকে একটু ধীরলয়ে হাঁটতে হচ্ছিল তার স্ত্রীর সঙ্গে পা মেলাতে গিয়ে। তাকে টেনে ধরে রেখে সে প্রতিটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথমে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছিল যে তারা কাফন বিক্রি করে। তারপরও কাফন খুঁজতে গিয়ে, একটি কার্পেটের দোকান সাজিয়ার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিল। সেই দোকানের জিনিসপত্রের প্রতি সে এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়ল যে মনে হচ্ছিল সে কখনো এখান থেকে নড়বে না। সৌন্দর্য, নকশা, রঙ, বুনন তার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হল। স্বামীকে জিজ্ঞাসা না করেই সে একটা হাতে ধরে দাম দরাদরি করতে শুরু করে, আর সুবহানের তাকে কেনাকাটা থেকে বিরত রাখার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তার নিয়ত বা হজের উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যাবে, এইসব আবেগঘন কথাগুলো কেমন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। হজের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলে যত খুশি কেনাকাটা করতে পারবে এই প্রতিশ্রুতিতেও সে প্রভাবিত হয়নি। সে তাকে দোকান থেকে বের করে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো।

কেনাকাটা করতে করতে, সাজিয়ার মনে ইয়াসিন বুয়া এবং তার কাফনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু সেই চিন্তাও দ্রুতই হারিয়ে গেল এবং সে বিষয়টি পুরোপুরি ভুলে গেলো।

সবকিছু এবং সকলের কথা ভুলে সে তার পছন্দের তুর্কি কার্পেটে মজে গেল। বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে সুবহান দোকান সহকারীকে ফিসফিসিয়ে বলল, "আমরা কি এখানে কাফন পেতে পারি?" সহকারী তৎক্ষণাৎ প্লাস্টিকে মোড়ানো এবং মৃতদেহের মতো ভারী একটি কাফন বের করে আনল। সুবহান সাজিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করল। সে কার্পেটটি শক্ত করে ধরে রাখল এবং তার বাম হাত দিয়ে কাফনটি তোলার চেষ্টা করল। "বাব্বাহ, কি ভারী এটা! এটা বয়ে ফিরবো কীভাবে?" এমনভাবে সে বলল, মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে কার্পেটের দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনল।

অবশেষে, তার কেনাকাটা শেষ হল। সুবহান পকেট থেকে নোট বের করে বেরিয়ে গেল এবং দোকানদারের কারপেটটি কাঁধে রাখল। তারা সেখানে কোনো অটোরিকশা বা কুলি খুঁজে পেল না, তাই সে নিজেই কার্পেটটি টেনে নিল, এবং যদিও সে আশা করেছিল যে কেউ তাকে দেখতে পাবে না; কিন্তু ঠিকই পথে পরিচিত লোকদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। মাঝপথে, সাজিয়ারও খারাপ লাগছিল এবং কোমলভাবে জিজ্ঞাসা করল, "হ্যাঁ গো, খুব ভারী, তাই না?" সে একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। সাজিয়াকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে দেয়ার মতো রেগে গেল সে, কিন্তু খুব ধৈর্য ধরে সে তাদের রুমের এক কোণে শয়তানের গালিচাটি ফেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অন্য কোনো সময় হলে, রেগে গেলেও সে অন্তত তার দিকে তাকাতে পারত, হয়তো তাকে তিরস্কারও করত। কিন্তু যেহেতু এটি হজের সময়, এবং যেহেতু রুমের বাকিরা সবাই তার আত্মীয়, তাই সে নিজেকে শান্ত করল।

তাদের হজযাত্রা শেষ হলো। যদিও তারা হজের মাঝে করা ভুলগুলো নিয়ে কিছুটা চিন্তিত হলেও দুজনেই সব মিলিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। মিনা থেকে ফিরে আসার পর, সাজিয়া শয্যাশায়ী হলো, যা কিছুটা উদ্বেগের কারণ ছিল। রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় তাকে দুই দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। তাকে ছেড়ে দেওয়ার পরে একদিন বিশ্রাম নিতেই তার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে, কেনাকাটায় সময় নষ্ট করায় সে বিরক্ত ছিল। সুবহানের সামনে সে জোর দিয়ে বলেছিল যে তার শরীর ঠিক আছে এবং সে দ্রুতই ভালো বোধ করতে শুরু করে। সুবহান কেনাকাটা না করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ভেবেছিল। টাকা নিয়ে সে মোটেই চিন্তিত ছিল না, কিন্তু ফ্লাইটে অতিরিক্ত লাগেজ নিয়ে যে ঝামেলা হয় তা দেখে, সেই ফাঁদে পড়তে চায়নি। কিন্তু সে সাজিয়ার মন খারাপ হোক বা তার রক্তচাপ আবার দুম করে বেড়ে যাক তা চায়নি, তাই তার কেনাকাটা কমানোর সমস্ত পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেয়। সাজিয়াকে থামাবে এমন কেউ ছিল না।

কেনাকাটার জন্য তাড়াহুড়ো করতে করতে, সাজিয়ার মনে বারবার ইয়াসিন বুয়া এবং তার কাফনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং অবশেষে সেই চিন্তাও মিলিয়ে যেতে শুরু করল এবং শিগগির সে বিষয়টি পুরো ভুলে গেল। এই জাদুকরী জায়গায়, কাফনের মতো বিষণ্ন, ভারী জিনিস কতটা জায়গা দখল করে ফেলবে কে জানে... ওহ খোদা ... ভারতেও কি পাওয়া যায় না? আমাদের গ্রামেও কি পাব না? বলতে তো পারি যে আমি মক্কায় পাইনি। এহ্! হজ করে কী আমি এমন মিথ্যা বলতে পারি? সে "তওবা, তওবা," করে দুটি গালে হালকা করে চাপড় মারলো। কোনো মিথ্যা টিথ্যা বলবে না সে। সে আশা করেনি যে ইয়াসিন বুয়া এত বিরক্তিকর ইচ্ছা চাপিয়ে দিবে তার ওপর।

এখন, ইয়াসিন বুয়ার মৃত্যুর খবর শুনে, সাজিয়া বিচলিত হয়ে পড়ে, সেই অপূর্ণ ইচ্ছার পরিণতি সম্পর্কে ভেবে। হায়হায়, সে যদি জানত, তবে সে তার কথা রাখত, এমনকি যদি তাতে তার কিছুটা অসুবিধাও হত, হতো না হয়- এই ভেবে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়ে সে!

যখন তারা ফিরে এলো, তখন সে এত বেশি জিনিসপত্র কিনেছিল যে তার অতিরিক্ত জিনিসপত্র তাদের দলের অন্যদের লাগেজের সঙ্গে দিতে হয়েছিল। সবকিছু সামলে সুবহান ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সবাইকে দেয়ার জন্য ৫ লিটারের জমজমের পানির ক্যান, কয়েক কেজি খেজুর, আর এই জিনিসগুলো তো আর কম ছিল না! আর সাজিয়া বোরখা পরে হ্যান্ডব্যাগ ধরে স্বামীর কাছে ছোটখাটো সব ব্যাপারে ছুটে যাচ্ছিলো, যা সুবহানকে আরও বিরক্ত করে তুলল। অবশেষে, অনেক ঝামেলার পর, তারা তাদের সমস্ত ব্যাগ নিজেদের ফ্লাইটে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

তাদের ফিরে আসার এক মাস পরেও, সাজিয়া সকলের কাছে সবকিছু বিতরণ করে শেষ করে উঠতে পারেনি। প্রথম তিন দিন তো অসুস্থতা আর জেট ল্যাগের কারণে সে বিছানা থেকেই উঠতে পারেনি। এরপর সব প্যাকেট খোলা শুরু হয়। তারপর সে তার কাছের এবং প্রিয়জনদের জন্য কেনা সোনা এবং অন্যান্য দামি উপহার পাঠানোর ব্যবস্থা করে। মূল্যবান কার্পেটটি খুলে সে খুশি হয়ে ওঠে। সুবহানের কোনো প্রতিক্রিয়া সে লক্ষ্যও করেনি; দেখেওনি যে সে বিরক্ত হয়ে চলে গেছে। তারপর সে কাপড়, খেলনা ইত্যাদি যাদের জন্য কিনেছিল সবাইকে দেয়। তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং কিছু ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তাকে বলেছিল যে তারা বিশেষ নকশা এবং সুতির কাজের, নির্দিষ্ট রঙে, অমুক সূচিকর্ম দিয়ে এমন স্টাইলে কাটা বোরখা আনতে। কেউ কেউ তাকে টাকা দিয়েছিল। অন্যদের জন্য, সে নিজ দায়িত্বে বোরখা উপহার হিসেবে এনেছিল। বাকিদের জন্য, সে একটি জায়নামাজ, তসবি একমুঠো খেজুর আর এক বোতল জমজমের পানি পাঠিয়েছিল। যদিও সে নিজ হাতে সব কাজ করত না, তবুও তাকে সবকিছু তদারকি করতে হত, এবং এটাই তাকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। কাজ শেষ করতে করতে এক মাসেরও বেশি সময় কেটে গিয়েছিল।

একটি বিশ্বাস আছে যে হজ থেকে ফিরে আসা ব্যক্তিরা প্রচুর ইতিবাচক এবং আধ্যাত্মিক শক্তি রাখে। এই শক্তি যাতে নষ্ট না হয় এবং আল্লাহর কাছে দোয়া ফরমায়েশের জন্য ব্যবহৃত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য, মুসলমানরা প্রায় ৪০ দিন ধরে বাড়িতে থাকেন। এই রীতিটি তারা কঠোরভাবে পালন করেন মানতের মতো করে। সাজিয়াও এটি পালন করে। ইয়াসিন বুয়া কয়েকবার বাড়িতে এসেছিল নিয়ম করে এবং সে যে এসেছে তা না জানিয়েই ফেরত চলে যেত। সজল চোখের ইয়াসিন বুয়াকে বলা হতো প্রতিবার সাজিয়া হয় ঘুমিয়ে, নয়তো বিশ্রামে অথবা নামাজে, অন্যথায় কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত। একদিকে, সে তার কাফন দেখার জন্য খুব অধৈর্য ছিল। আবার অন্যদিকে, তিনি হজ থেকে ফিরে আসা সাজিয়ার কাছে দাঁড়িয়ে তার নিজের রুক্ষ হাতে সাজিয়ার হাত আঁকড়ে ধরার জন্য সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। অপেক্ষা করেছিলেন এই আশায় যে সাজিয়া হয়তো তার জন্যও কিছু উপহার নিয়ে এসেছে।

অবশেষে, সাজিয়া সামনে হাজির হলো, বুয়ার প্রতীক্ষা বুঝতে পেরে। তখন সে সবেমাত্র গোসল করে বের হয়েছে এবং চুলও আধভেজা ছিল। যখন সে বড়সড় ঢিলা আকাশি নীল চুড়িদার জামা পরে, মাথায় একটি মানানসই কাসুতি-সূচিকর্ম করা দোপাট্টা স্টাইল করে পরে বেরিয়ে এলো, তখন ইয়াসিন বুয়া খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। দৌড়ে গিয়ে সাজিয়ার হাত চোখের কাছে চেপে তার আনন্দের সীমা ছিল না। একজন হাজ্জিনের হাত স্পর্শ করার ফলে তার মনে হয়েছিল যেন সেও আধ্যাত্মিকভাবে পবিত্র হয়ে উঠেছে আর তার বাহুতে রোদ ঠিকরে পড়েছে। সাজিয়া তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অল্প কথা বললো। "কেমন আছো, বুয়া?" বলে সে দ্রুত তার ঘরে গিয়ে জায়নামাজ এবং তসবি এনে তাকে দিল: "এগুলো নাও, তোমার জন্য।" ইয়াসিন বুয়া যা দেখতে চেয়েছিল তা সেখানে ছিল না। সে ভেবেছিল সেই মুহূর্তে যেন জমজমের জলে ভেজা কাফন জড়িয়ে আল্লাহর কাছে যাত্রা করার ইচ্ছা তার পূরণ হবে। সে উপহার নেয়ার জন্য হাত বাড়ালো না, বরং অবিশ্বাসের চোখে সাজিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, এক মুহূর্তের জন্য হতাশায় অন্ধ হয়ে গেল। কিছুটা ভেতরের সাহস কাজে লাগিয়ে, সে সাজিয়াকে সম্বোধন করে, খুব স্পষ্টভাবে দৃঢ়স্বরে বললো: "আমি তো এগুলো চাই না। আমার কাফনটা আমাকে দাও।" এমন উত্তর সাজিয়া আশা করেনি, সে খুব রেগে গেল। রাগ লুকোনোর চেষ্টা না করে সে জোরে জোরে বুয়াকে ধমকে বললো, "ছি! কেউ কি জায়নামাজ নিতে না করে?" কিন্তু বুয়া এক ইঞ্চিও নড়লো না। সে তার অবস্থানে অটল রইলো। "আপনার শাশুড়ি হজ থেকে ফিরে আসার পর যে জায়নামাজ দিয়েছিলেন, তা আমার কাছে এখনো আছে। আমি সময় পেলেই তাতে নামাজ পড়ি। এত নতুন আর সুন্দর জায়নামাজ আমি কোথায় রাখবো? আর বাঁচবোই বা কতদিন? কত আর নামাজ পড়বো? সমাজে আমার দরকার নেই আর অবসর নিয়ে নির্বাসনে বনে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। এখন আমি শুধু কাফনটাই চাই।"

সাজিয়া আগে কখনো ইয়াসিন বুয়ার এমন রূপ দেখেনি। হাঁটতে হাঁটতে কোমর বাঁকিয়ে শ্রদ্ধায় বুয়া প্রতি মিনিটে আকাশের দিকে তাকিয়ে সাজিয়ার প্রশংসা করত, তার সৌন্দর্যের ওপর যেন কোনো বদনজর না পড়ে সেজন্য তার আঙুলের নখ ভেঙে দিত, সর্বদা তার মঙ্গল কামনা করত, “আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘায়ু করুক, তোমার ধন সম্পদ বাড়াক। তোমার পরিবার ভালো থাকুক, তোমার বিয়ে যেন টিকে থাকে। আল্লাহ তোমাকে বেহেশতে একটি প্রবাল দিয়ে তৈরি ঘর দেয়।” সেই বুয়া কই যে সবসময় তাকে আশীর্বাদ করত, সবসময় তার জন্য দোয়া করত? এই বুয়াকে তো সে চেনে না যে এত শক্ত হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে?

সাজিয়ার মেজাজ গরম হয়ে উঠল। সে ভুলে গেল যে সে সম্প্রতি হজ থেকে ফিরেছে। "কীসের কাফন, কোনো কাফন পরে মরে পড়ে থাকতে চাও? কেউ না কেউ তোমাকে কাফন দিবে। এত চেঁচামেচির কি আছে? তোমার কী হয়েছে, বুয়া? তুমি কি পাগল হয়ে গেছো? তুমি আমাকে কত টাকা দিয়েছিলে? তোমার মুখে তার ১০ গুণ বেশি ছুড়ে মারতে পারি। দাঁড়াও, এরপর থেকে আর তোমার মুখ দেখাতে আসবে না আমাকে ," সে জোরে চিৎকার করে বলল, এবং রেগেমেগে নিজের ঘরে ছুটে গেল। যখন সে ৫০০ টাকার দুটি নোট হাতে করে বের হয়ে আসলো, কোথাও ইয়াসিন বুয়াকে দেখতে পেল না। তার এত মেজাজ চড়েছিল যে সে বুয়াকে এত সহজে পার পেতে দেওয়ার পাত্রী নয়। সে দ্রুত পায়ে রান্নাঘরে গেল। উঠোনে গেল। কাছের খালের দিকে উঁকি দিল, কিন্তু যেদিকেই তাকাক না কেন, বুয়াকে কোথাও দেখতে পেল না। " জাহান্নামে যাক" ভেবে সে নোটগুলো চাপাত্রে ছুড়ে ফেলে সোফায় শুয়ে পড়ল। যেমনটা সাজিয়া চেয়েছিল, ইয়াসিন বুয়া আর তার চোখের সামনে এলো না। এটাকে বেশ একটা মুক্তি পাওয়া গেলো ভেবে, সে শান্তি ও তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। কিন্তু বুয়া এটা কীভাবে করতে পারল? মাঝে মাঝে তার মনে এই প্রশ্নটি জাগতো এবং তার স্মৃতিতে লুকিয়ে থাকা রাগও মাথাচাড়া দিয়ে উঠত; কিন্তু বুয়া যখন মুখ দেখাবেই না তখন সে কী করতে পারে? তাকে এভাবে চলতে দিবে? হয়তো সে রমজান বা বকরি ঈদে ভিক্ষা করার জন্য আসবে। সে আশা করেছিল যে বুয়া, পিঠ বাঁকিয়ে এতটুকুন হয়ে নতমুখে তার কাছে রমজানে ভিক্ষে নিতে আসবে। কিন্তু সে বুয়ার আত্মসম্মানবোধকে ধরতেই পারেনি। সে তার কাফনের দিকে একবার তাকানোর জন্য, একবার স্পর্শের জন্য এত আগ্রহী ছিল, যেন একজন কনে তার নিকাহ উপহারের জন্য অপেক্ষা করছে। গয়না এবং জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরেও সাজিয়া যেভাবে তার সঙ্গে দরিদ্রের মতো আচরণ করেছিল, তা তার মনে চিরস্থায়ী দাগ কাটে।

এমনকি সে ভয়ংকর দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি যে মৃত্যুর পরে বুয়া তাকে তাড়া করবে। হঠাৎ যন্ত্রণার ভারে সে ভেঙে পড়ে। তার এখন কী করা উচিত? তার কী করা উচিত নয়? বুয়া যদি এক লাখ টাকা দামের কাফন চেয়েও থাকে, সাজিয়া তাকে তা দিতে প্রস্তুত ছিল, কিন্তু এটাতো পবিত্র জমজমের পানিতে ভেজান মক্কার একটি কাফন, ইয়া আল্লাহ, কী করা উচিত? সে তার ভুল কীভাবে সংশোধন করবে, কি করবে না করবে বুঝতে না পেরে উদ্বিগ্নভাবে মোবাইল ফোন নিয়ে তাড়াহুড়ো করে ওপরের তলায় একটি খালি ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়। তার শরীরের তাপ বেড়ে গিয়েছিল বা কাঁপছিল, কেনই বা ঘামছিল, সে জানত না। কপাল খারাপ! এই দরিদ্র মহিলা যদি শেষ বিচারের দিনে তার আঁচল ধরে আল্লাহর কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে, এমনকি আমি যদি আমার সমস্ত সৎকর্মও সেখানে ঢেলে দেই, তবুও আমি দোষী থাকব, সাজিয়া শঙ্কিত হয়ে ভাবল। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে সে বুয়ার চেয়েও দরিদ্র, হতভাগা।


ওই কাফনটিই ছিল মৃত মহিলার শেষ ইচ্ছা। নইলে তার ছেলে কেন এটি খুঁজতে আসবে? কেন সে তার মৃত মায়ের হয়ে এটি চাইবে? যদিও সে মৃদুস্বরে চেয়েছে কিন্তু এটা স্পষ্ট যে সে মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। সে কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাবে? তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। যদি সে অন্য কোনো কাফন ব্যবহার করতে রাজি না হয়, তাহলে সেদিন তার দাফন হবে না। জামাত তার স্বামী এবং ছেলেকে মসজিদে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাদের হাত জোড় করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা কল্পনা করে সে ভীত হয়ে পড়ল। ফরমান অবশ্যই তাকে ছাড়বে না। সে তাকে নিষ্ঠুরভাবে অবজ্ঞা করবে ঠিক যতটা সে তাকে ভালোবাসে। তার চিন্তাভাবনা চিলের মতো এদিক-ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছিল। সে বসে কাঁদছিল যতক্ষণ না মনে হচ্ছিল তার আত্মা দুঃখে ফেটে যাবে, তার দমকে দমকে কান্না বেরিয়ে আসছে। এত কান্নার পর কি সে হালকা বোধ করছে? না। তীব্র দুঃখ তার গলায় আটকে আছে; এমনকি তার শত্রুদের জন্যও, সে খোদার কাছে এমন যন্ত্রণা চায়নি। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার।

এক-দুই ঘণ্টা একা বসে কাঁদতে কাঁদতে সে আশার আলো দেখতে পেল। নিচ থেকে সুবহানের কণ্ঠস্বর সে শুনতে পেল। সুবহান তাকে জোরে ডাকছিল। "সাজিয়া, সাজিয়া, আমার কাপড় কোথায়? আমার কলম কোথায়? আমার নাস্তা কি তৈরি?" যদিও সে তার কথা শুনতে পেল, তার কণ্ঠ থেকে স্বর বেরোল না। কিন্তু সাবা সরাসরি তাকে উত্তর দিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সে বলল, "আব্বাজি, আম্মি বাড়িতে নেই। খুব ভোরে খবর এলো যে কে যেন মারা গেছে। সে নিশ্চয়ই সেখানে গেছে।"

"কি? কে মারা গেছে? তোমাকে কে বলেছে?" সে জিজ্ঞাসা করল।

"ফরমান আমাকে বলল, আর নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেল। আম্মিও নিশ্চয়ই ওর সঙ্গেই গেছে," সে বলল। সাজিয়া স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সাবা যতই ভয়ঙ্কর হোক না কেন - পুত্রবধূ হওয়ার কারণে, তার চরিত্রে যত চালাকি ছিল- এসব শুনে সাজিয়া তার প্রতি একটু কোমল হলো। সে খাবার টেবিলে চীনামাটির পাত্রে সুবহানের জন্য রুটি সাজিয়ে দিল, রাঁধুনির তৈরি খাবার পরিবেশন করল। কিছুক্ষণ পর, সে শুনতে পেল সুবহানের গাড়ি চলে যাবার আওয়াজ গেটের দিকে এবং তারপর দেয়ালের ওপারে চলে যাবার। আর কান্নাকাটি করে লাভ নেই। এখন তার মনে হলো তাকে কিছু একটা করার চেষ্টা করতে হবে।

অন্য মানুষ মারা যাওয়ার সময় সাজিয়া এত বেশি চোখের জল ফেলেনি, এমনকি তার নিজের বাবাও জন্যও না। আবার, সেইসব সময় অসংখ্য মানুষ তাকে পানি খাওয়াতে, গোলাপ জলে ডুবানো তুলো দিয়ে চোখের জল মুছতে, তাকে শান্ত করতে, বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে, বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন একে অপরের ওপর ভর করে সাহায্য করতে ভিড় করেছিল। এই সব দেখে তার দুঃখ সহ্য হয়ে গিয়েছিল। তবে, এতিমের মতো একা ঘরের এক কোণে লুকিয়ে থেকেও সে চাপমুক্ত হতে পারলো না! এখনই তাকে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার পর, সে দ্রুত তার আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের ফোন করতে শুরু করে।

"আমি জমজমের পানিতে ভেজানো কাফন খুঁজছি -" প্রশ্নটি শেষ করার আগেই তারা উত্তর দিত, "হুম... এটা কি সাজিয়া? না, আমাদের বাড়িতে কাফন নেই। আমাদের মা হজে যাওয়ার সময় একটি এনেছিলেন, কিন্তু যারা চেয়েছিলেন এবং কাজটি শেষ করেছিলেন আমরা তাদের দিয়ে দিয়েছিলাম।" আরেকজন প্রতিক্রিয়া জানাল, "কি, তুমি কাফন চাও?" বলে সে কি হাসি। "আমরা আমাদের বাড়িতে কাফন রাখি না। আমরা কাউকে কাফন আনার প্রতিশ্রুতি দিই না। এটা বেশ ঝামেলার কাজ।" আরেকজন প্রতিক্রিয়া জানাল, "ওখান থেকে কাফনের কী দরকার? দাফনকাফন যদি এখান থেকে হয়? আমাদের কর্ম অনুসারেই আমরা পরকালে ফল পাই, তাই না?"

সবার কাছ থেকে "না" শোনার পর, সাজিয়া সাবার মাকে ফোন করে, যদিও সে তা করতে চাইছিল না, তার মন তাতে সায় দিচ্ছিল না। হ্যালো... হ্যালো... এর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে গেলে, সে তার মর্যাদা এবং আত্মসম্মানকে একপাশে রেখে মূল কথায় এসে পৌঁছায়। "মক্কা থেকে কি কোনো কাফন আনা হয়েছে তোমার?" সাবার মা সাজিয়াকে খুব একটা পছন্দ করত না। সাবার সঙ্গে নিয়মিত যা কথা হতো তাতে মনে হতো সাজিয়া একজন বিড়বিড়কারী রাক্ষস, একজন নিষ্ঠুর মহিলা যে তার পুত্রবধূর ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখে, একজন ডাইনি যে তাকে অনেক দুঃখ দিত, তার শান্তির পথে একটি অজগর। এই সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে, সাবার মা যে কোনো মূল্যে কাফনের ব্যবস্থা করতে ইচ্ছুক ছিল- যদি তা সাজিয়ার জন্যই হয়। জিজ্ঞাসা করল, "তুমি কাফন চাও?" এবং জোর দেওয়ার জন্য কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল, "কিন্তু তুমি এটা কেন চাও?" তার কথায় ব্যঙ্গাত্মক ভাব স্পষ্ট ছিল এবং সাজিয়া কোনো কথা না বলে ফোন কেটে দিল। তার নিজের বাপ-মায়ের বাড়ি থেকে শুরু করে, কাফনের জন্য অনুরোধটি তার সমস্ত আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। সে কল্পনাও করেনি যে সে এতটা অসহায় হয়ে পড়তে পারে কখনো এভাবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে।

কান্নাকাটি করে লাভ নেই বুঝতে পেরে, সে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কিছু খেয়ে ওষুধ খাবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু এসব করে তার সুস্থবোধ হলো না। হাল ছেড়ে দিয়ে সে ভাবতে লাগলো যে কাছাকাছি কোথাও থেকে কাফন কিনে বাড়িতে সংরক্ষিত জমজমের পানিতে ভিজিয়ে পাঠাবে কিনা; কিন্তু সেটা তো মক্কার কাফন হবে না। যে অতল গহ্বরে সে পড়ে যাচ্ছিল তাতে বিরক্ত হয়ে সে অসহায়ভাবে নিজেকে অভিশাপ দিল: "ওহ, সাজিয়া, তুই মর! অভিশপ্ত কোথাকার।" সেই মুহূর্তের দুঃখ, কষ্ট, মর্যাদা হারানো, অসহায়ত্ব এবং যন্ত্রণা ভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না।

বিকেল ৩টার দিকে ফরমান বাড়ি ফিরে এলো। খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে সে সাবাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আম্মি কোথায়?” সে বুঝতে পেরেছিলো যে তার শাশুড়ির মেজাজ খুব খারাপ তাই সে কিছুই বললো না, বরং সে সাজিয়ার ঘরের দিকে চোখ তুলে ইশারা করলো। ফরমান ছুটে ভেতরে ঢুকলো, এবং তার মা কোনো কথা না বলা সত্ত্বেও সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে সবকিছু বুঝতে পারলো। সে তার পাশে বসে হাত ধরে বললো, “আম্মি।” সাজিয়া কান্না করার জন্য একটা কাঁধ খুঁজে পেলো। সে যতই তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই লাগলো। সাবা অবাক হয়ে ভাবলো, আমার শাশুড়ি কি এতই সংবেদনশীল যে একটা কাজের লোকের মৃত্যুতে সে এত শোকাহত! সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল; ফরমান তার স্ত্রীকে ইশারা করে সরে যেতে বলল।

সকাল থেকে সে সাজিয়ার ওপর নারাজ। "ওর এই কথায় রাজি হওয়া উচিত ছিল না... কিন্তু রাজি যখন হলোই, সে কি তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারত না? একটা কাফন আনতে কী এমন হতো? সেটাও ওই বেচারির জন্য।" তার খুব খারাপ লাগছিল। "গত বছর যখন সাবা আর আমি ওমরাহ করতে গিয়েছিলাম, তখন আম্মি কি আমাদের এটা আনতে বলতে পারত না? আমিও তো এটা নিয়ে আসতে পারতাম।" কাফন আনা কেন এত বড় সমস্যা হয়ে উঠল, এই ভেবে সে প্রায় তাকে দোষারোপ করতে শুরু করতে যাবে, কি ভেবে একটু থেমে জোর করে নিজেকে শান্ত করে। মা কতটা কষ্ট পেয়েছে ভেবে তার জন্য দুঃখিত হয়ে সে বলল, “আম্মি, বাদ দাও, মাঝে মাঝে এমন ঘটে। ভুলে যাওয়ার কারণে হোক বা দুর্ভাগ্যের কারণে, এমন ঘটতেই পারে। এটাকে এত মনে নিও না। আর, আম্মি, আমি সকালে আলতাফের সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম, বুয়ার দাফনের সমস্ত অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরে এসেছি। আমি একটি কাফন, ধূপকাঠি, সুগন্ধি এবং অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র কিনেছি, তারপর কবরস্থানে তার পছন্দের জায়গায় কবর খনন করেছি এবং মৃতদেহের গোসলের ব্যবস্থা করেছি। আমি ভেবেছিলাম দুপুরের খাবার খাবো এবং তারপর তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। আমি জানি নাহলে তুমি শান্তিতে থাকবে না। আমার সঙ্গে দুপুরের খাবার খাও। তারপর আমরা শেষবারের মতো ইয়াসিন বুয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাব।”

সাজিয়ার কষ্ট আবার বেড়ে গেল। ফরমান তার সামনে খাবারের প্লেট এগিয়ে দিল। পেটে একটু ভাত পড়তেই সে সাবাকে বলল, "তোমাকে সঙ্গে আসতে হবে না, আম্মি এলেই যথেষ্ট," এবং তার মাকে ইয়াসিন বুয়ার বাড়িতে নিয়ে গেল। সে সেখানে যা ঘটতে চলেছে তার সবকিছু কল্পনা করেছিল। ইয়াসিন বুয়ার মুখ দেখার পর, সে আবার কেঁদে ফেলবে। সম্ভবত ইয়াসিন বুয়ার মেয়ে এবং ছেলের মতোই সাজিয়াও অনেক চোখের পানি ফেলেছে; কিন্তু তবুও সে নিজেকে ক্ষমা করতে চাচ্ছিল না। সে বুঝতে পারল যে এই শোক তার চলতে থাকবে।

যখন তারা ইয়াসিন বুয়ার বাড়িতে পৌঁছাল, তখন সবকিছু ঠিক যেমনটি সে ভেবেছে ঠিক তেমনই ঘটল। সাজিয়ার দুঃখের কোনো শেষ ছিল না, তার কান্নার কোনো খামতি ছিল না। যারা তার মুখ, তার লাল চোখ, তার ফোলা ঠোঁট দেখল তারা অবাক হয়ে গেল। অনেকেই সহানুভূতি দেখাল, ভেবে পেলো না যে তারা কখনো কোনো সম্ভ্রান্ত, ধনী পরিবারের কোনো মহিলাকে একজন চাকরের মৃত্যুতে এত শোক প্রকাশ করতে দেখেছে কিনা। কে জানে তাদের কী ধরনের সম্পর্ক ছিল, তারা খোদার ওপর ব্যাপারটা ছেড়ে দেয়ার আগে ভাবল। কেবল খোদাই জানেন। সাজিয়া একা সত্যটি জানত: এটি ইয়াসিন বুয়ার শেষকৃত্য ছিল না, বরং তার নিজের ছিল ।


গল্পটি নেওয়া হয়েছে বানু মুশতাকের 'হার্টল্যাম্প' (ও অন্যান্য গল্প এপ্রিল ২০২৫) গল্পসংকলন থেকে। কন্নড় ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তী। ইংরেজিতে গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে দ্য ডায়াল পত্রিকায়। বাংলায় অনুবাদ করেছেনআতিফা নাওয়ার।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ