Views Bangladesh Logo

বর্ণমালার শরীরে প্রতিরোধের আগুন জ্বালানো কবি

মাদের জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে শ্রেষ্ঠ অর্জন আর কিছুই নেই। স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য কবিতা। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমকে দুর্দান্ত ও নান্দনিকরূপে কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন কবি শামসুর রাহমান। যেসব কবিতার অবস্থান মানুষের মুখে মুখে, স্লোগানে, প্ল্যাকার্ডে, দেয়াল লিখনে, ব্যানারে, ফেস্টুনে। যেমন ‘স্বাধীনতা তুমি/রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।’ অথবা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?/তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা, সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো/সিঁথির সিঁদুর গেল হরিদাসীর’ কিংবা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ কবিতাগুলো উচ্চারণ করলে বোঝা যায়, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-আবেগ কতটা গভীর কবি শামসুর রাহমানের। সেসবের রূপ কবি দিয়েছেন তার কবিতায়।

তিনি লিখেছেন, ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে/দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক এই বাংলায়/তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’ এ কারণেই বলা হয়ে থাকে, বাঙালির জাতীয় ইতিহাসের আবেগের সঙ্গে যেন প্রায় পায়ে পা মিলিয়ে এগিয়েছে শামসুর রাহমানের কবিতা। বাঙালির আবেগ ও স্বপ্ন সবচেয়ে নিপুণভাবে ধরা দিয়েছে তার কবিতায়।

কবিতার প্রতি কতটা নিবেদিত কবি, বোঝায় যায় তার সামগ্রিক কাব্যিক জীবন থেকে। কবির চলাফেরা, আড্ডা, পোশাক, স্টাইল সব কিছুতেই ফুটে উঠত কবিতার প্রতিচ্ছবি। তার কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক। তিনি লিখেছেন, ‘বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি/ দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?/ বৃক্ষ বলে আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়/ যদি মিশে যেতে পারো, তবে হয়তো বা পেয়ে যাবে একটি কবিতা!’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি লিখেছিলেন ‘ইলেকট্রার গান।’ ধর্মীয় রাজনীতির মেরূকরণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, এরশাদের স্বৈরাচারী সরকারের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যু হলে লিখলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়।’ শহীদ আসাদের মৃত্যুর পর লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট।’ এক কথায় বলা যায়, তার কবিতা লিফলেট হয়ে মানুষের হাতে হাতে ফিরেছে; বহু পঙ্ক্তি রাতারাতি পেয়েছে প্রবচনের লোকপ্রিয়তা; উঠে এসেছে পোস্টারে, প্ল্যাকার্ডে, দেয়াললিখনে। জাতীয় চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে তার সৃষ্টির সুর। শব্দের ভেতর দিয়ে যিনি গড়েছিলেন স্বাধীনতার অনন্ত প্রবেশপথ; যিনি বর্ণমালার শরীরে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়েছিলেন।

২৩ অক্টোবর ১৯২৯। ঢাকার মাহুতটুলি তখনো আলো ছায়ায় ঘেরা পুরোনো শহরের অন্তরঙ্গ এলাকা। সেখানেই জন্ম নিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। তার চোখে ছিল প্রশ্ন, আর মনে ছিল শব্দের আলোকসন্ধান। তার বেড়ে ওঠা ছিল পারিপার্শ্বিক জীবন থেকে আহরিত সাহিত্য চেতনার এক প্রস্তুতি। স্কুলজীবন থেকেই কবিতার প্রতি আকর্ষণ।

ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন করেছেন। এর ভেতর দিয়েই তিনি ছুঁয়ে দেখেছেন কাব্যভুবনের বহুপ্রান্ত। বাংলা কবিতার এক বাঁকবদলের অংশ হয়ে ওঠেন শামসুর রাহমান। ১৯৪৯ সালে তার প্রথম কবিতা ছাপা হয় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায়। এরপর ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে।’ কাব্যিক ভাষায় ব্যক্তিগত আর রাজনৈতিক সত্তার মিলনে তিনি নির্মাণ করেন নাগরিক আত্মজিজ্ঞাসার এক নতুন ভূগোল।

শামসুর রাহমান ছিলেন কবিতার বাইরে সাংবাদিকতার জগতে এক দীপ্ত কণ্ঠস্বর। দৈনিক বাংলা, বিচিত্রা, উত্তরাধিকার- প্রতিটি পরিসরেই তার কলম ছিল গভীর, বিশ্লেষণধর্মী এবং বিবেক সচেতন। ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সময়ও তার কবিতা কখনো নীরব থাকেনি। মৌলবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও স্বৈরতন্ত্রের বিপরীতে তিনি ছিলেন স্পষ্ট সত্যকথনের পক্ষপাতী।

তিনি অর্জন করেছিলেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অজস্র সম্মাননা; কিন্তু সব পুরস্কারকে ছাপিয়ে শামসুর রাহমানের সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি- তার কবিতা সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফেরে। জাতীয় চেতনার সঙ্গে মিশে গেছে তার সৃষ্টির সুর। কবির মতে, সাহিত্য কেবল সৃজন নয়, দায়বদ্ধতাও। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন- প্রেম মানে দায়, স্বাধীনতা মানে প্রতিরোধ আর কবিতা মানে প্রত্যয়ের উচ্চারণ। তিনি বিশ্বাস করতেন, কবিতা মানুষের মজ্জায় না পৌঁছালে, তা শব্দের খেলাই থেকে যায়।

শামসুর রহমান বলা হয়ে থাকে নাগরিক কবি। রাজধানী ঢাকা তার বেড়ে ওঠা। ঢাকার অলিগলি, রাজপথ থেকে পুরোনো বইয়ের বাজার তার প্রিয় ছিল খুব। ‘আমার ঢাকা’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘অনেক বছর আগেকার কথা। তখন বাংলাবাজারে বেশ কিছু পুরোনো বইয়ের দোকান ছিল। সেসব দোকানে নানা ধরনের পুরোনো বই পাওয়া যেত। জীর্ণ, কীটদষ্ট পাতা, কিন্তু মূল্যবান বই। কোনো কোনো বইয়ের প্রথম সংস্করণ, দুর্লভ বই। এক অর্থে খুবই দামি বই, অথচ সুলভ দাম। মনে পড়ে, দান্তে গ্যাব্রিয়েল রসেটির বড় বড় কাব্যসংকলন কিনেছিলাম দেড় টাকা দিয়ে।’

ঢাকায় কবির প্রিয় আড্ডাস্থল বিউটি বোর্ডিং যেমন তার কবিতাভাষা লাভ করেছে, তেমনি মধুর ক্যানটিনও উদ্ভাসিত হয়ে এসেছে স্মৃতির পটে, তিনি লিখেছেন, ‘মধুদার কেন্টিনের চা, শিঙাড়া, ডিমের পোচ খাননি এমন ছাত্রের সংখ্যা বিরল। যারা কোনো দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না, তাদের অনেকেই এখানে এসেছেন কোনো না কোনো কাজে। অনেকে এমনিতেই এসেছেন সেই পরিবেশের একটু স্পর্শ নিতে, ঘ্রাণ পেতে।’

২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট, আজকের এই দিন। সেদিন থেকে পৃথিবীতে তার অনুপস্থিতি। গানের মতো, কবিতার মতো, ছায়ার মতো ছিল তার চলে যাওয়া; কিন্তু চলে গিয়েও থেকে গেছেন বাংলা কবিতার পাতায়, কিশোরের দ্রোহে, তরুণীর প্রেমে, বিপ্লবীর রক্তাক্ত স্বপ্নে। তিনি আছেন কবিতার পঙক্তিতে, দেশপ্রেম, দ্রোহ, প্রেম ও নিঃশব্দ প্রতিবাদে।

শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: তরুণ লেখক ও সাংবাদিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ