এক কিডনির গ্রাম
এতই মর্মান্তিক এই খবর যে, শুনলেই চমকে উঠবেন এমন ভয়ানক ব্যাপারও ঘটে এই দুনিয়ায়! তাও এই বাংলাদেশে! পৃথিবীতে যুদ্ধ-হানাহানি-রক্তপাত হয় যা মানুষকে ব্যথিত করে। যুদ্ধে-দুর্ভিক্ষে-বন্যায়-খড়ায়-নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে-দুর্বিপাকে অসংখ্য মানুষ মারা যায় তাও মানুষকে কাঁদায়; কিন্তু যদি শুনেন একটি গ্রাম চিহ্নিত হয় ‘এক কিডনির গ্রাম’ হিসেবে তাতে আপনি শুধু হতবাকই হবেন না, মানুষের এই সভ্যতা নিয়েই আপনি চিন্তিত হবেন।
আপনি শুনলে হয়তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারবেন না- মাত্র তিন লাখ, সাড়ে তিন লাখ টাকার জন্য মানুষ তার শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিক্রি করে দিচ্ছে। এক কিডনি দিয়ে বেঁচে থাকা যায়, প্রয়োজনে প্রিয়জনের জীবন বাঁচাতে অনেকে তার একটি কিডনি দান করেন। অনেকে আবার একটি কিডনি বেচে দেন স্রেফ দরিদ্র্তার কারণে- এরকম খবর আমাদের অজানা নয়; কিন্তু একটি গ্রামের ৬ হাজার মানুষের মধ্যে গড়ে ৩৫ জনের মধ্যে একজন যদি একটি করে কিডনি বেচে দেন তাহলে তা শুধু অবিশ্বাস্য না, একেবারেই কেঁপে ওঠার মতো সংবাদ মনে হয়।
এমনই এক ভয়াবহ ব্যাপার ঘটেছে বাংলাদেশের জয়পুরহাটের কালাইহাটের বাইগুনি গ্রামে। গ্রামটি এখন এক কিডনির গ্রাম হিসেবে পরিচিত। কারণ এখানকার অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন কিডনি বিক্রি করে। গ্রামটি এতই দরিদ্রকবলিত যে, অভাবের তাড়নায় এখানকার মানুষ কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ সালের পর থেকে গ্রামটিতে কিডনি পাচার একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তেমনি এক কিডনি বিক্রেতা সফিরুদ্দিন (ছদ্মনাম), বয়স ৪৫। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ভারতে গিয়ে তিনি তার কিডনি বিক্রি করেন ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। তিনি ভেবেছিলেন ওই টাকা দিয়ে তার টানাপোড়েনের সংসারটাকে একটু টেনে তুলতে পারবেন। তিন ছেলেমেয়ের জন্য একটু ভালো আহার জুটাতে পারবেন। ঘরটা ঠিক করতে পারবেন। হায়, টাকা শেষ হয়ে গেছে, ঘরটাও আর মেরামত করা হয়নি। কিডনি বিক্রি করে যে মূল্য তিনি পেয়েছেন তা শেষ। আর যে মূল্য দিয়েছেন তা রয়ে গেছে তার সারা শরীরের অসহ্য ব্যথায়। এখন ব্যথা শুধু তাকে সেই স্মৃতিই মনে করিয়ে দেয় তার শরীরের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ তিনি হারিয়েছেন!
তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে। এখন একটি হিমাগারে দিনমজুরের কাজ করেন। সারাক্ষণ শারীরিক দুর্বলতা ও ব্যথা নিয়ে ভারী কাজ করাও তার পক্ষে অসম্ভব হচ্ছে এখন। আল-জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘কিডনি বেচেছিলাম যাতে আমার পরিবার একটু ভালো করে খেয়েপরে বাঁচতে পারে। স্ত্রী আর সন্তানদের জন্য সবই করেছি।’
সে সময় এটাই তার কাছে মনে হয়েছিল ভালো বুদ্ধি। পরবর্তীতে কী ধরনের জটিলতা হতে পারে, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে এটা তার মনে হয়নি। যে দালালের মারফত কিডনি বিক্রি হয়েছে সেও বুঝিয়েছে এ তো মামুলি ব্যাপার। কোনো বিপদের চেয়ে এটা বরং একটা বড় সুযোগ!
মেডিকেল ভিসা দিয়ে দালালরা তাকে ভারতে নিয়ে যায়। সব ব্যবস্থা তারাই করে। কাকে তিনি কিডনি দিয়েছেন এটা সফিরুদ্দিন জানেন না। ভারতের আইন অনুযায়ী, কেবলমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যেই অঙ্গদানের অনুমতি রয়েছে। অথবা বিশেষ সরকারি অনুমোদনের মাধ্যমে এটি করা যায়; কিন্তু পাচারকারীরা এই নিয়মগুলো ফাঁকি দিতে সবকিছুই জাল করে। পারিবারিক বংশতালিকা, হাসপাতালের নথিপত্র, এমনকি ডিএনএ পরীক্ষাও।
দক্ষিণ এশিয়ায় অঙ্গ পাচার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গ প্রতিস্থাপনবিষয়ক টাস্কফোর্সের সদস্য। তিনি জানান, ‘সাধারণত অঙ্গ বিক্রেতার নাম বদলে ফেলা হয় এবং একজন আইনজীবীর সিলমোহরসহ নোটারি সার্টিফিকেট তৈরি করা হয় যাতে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে মিথ্যা পারিবারিক সম্পর্ক প্রমাণ করা যায়। জাল জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে প্রমাণ দেখানো হয় যে দাতা আসলে গ্রহীতার বোন, মেয়ে বা অন্য কোনো আত্মীয়। এতে করে অঙ্গদানকে সহানুভূতির প্রকাশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, অথচ এর পেছনে থাকে পাচারচক্রের সুচারু কারসাজি।’
সফিরুদ্দিনের গল্প আলাদা কিছু নয়। জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামে কিডনি বিক্রি এতটাই সাধারণ ঘটনা যে এলাকাটি এখন স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘এক কিডনির গ্রাম’ নামে। মাত্র ছয় হাজারেরও কম মানুষ বসবাসকারী এই গ্রাম ও তার আশপাশের অঞ্চল কিডনি পাচারচক্রের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল গ্লোবাল হেলথে ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, কালাই উপজেলার প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের একজন কিডনি বিক্রি করেছেন।
কালাই দেশের অন্যতম দরিদ্র এলাকা। এখানকার অধিকাংশ দাতা তরুণ বা মধ্যবয়সী পুরুষ, যারা দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে দালালদের ফাঁদে পড়েন। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৩ শতাংশ দাতা দারিদ্র্যকেই কিডনি বিক্রির প্রধান কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, ঋণ শোধ, মাদকাসক্তি কিংবা জুয়ার অভ্যাস থেকেও তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।
সফিরুদ্দিন জানান, অস্ত্রোপচারের আগে দালালরা তার পাসপোর্ট নিয়ে যায় এবং আর ফেরত দেয়নি। এমনকি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যে ওষুধগুলো খাওয়ার কথা ছিল, সেগুলোও তিনি পাননি।
অস্ত্রোপচারের পর দালালরা অনেক সময় দাতার পাসপোর্ট ও চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র রেখে দেয়, যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে এবং দাতারা পরবর্তীতে চিকিৎসা সুবিধাও না পান। এতে তারা ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েন।
এভাবে সংগৃহীত কিডনিগুলো বিক্রি হয় বাংলাদেশ ও ভারতের ধনী রোগীদের কাছে, যারা আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘ অপেক্ষা ও কঠোর নিয়ম এড়িয়ে দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপন চান। ভারতে ২০২৩ সালে মাত্র ১৩ হাজার ৬০০টি কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ চূড়ান্ত পর্যায়ের কিডনি রোগে আক্রান্ত হন।
আল জাজিরা বাংলাদেশের একাধিক কিডনি দাতার সঙ্গে কথা বলেছে। সবাই জানিয়েছেন, দারিদ্র্যই তাদের কিডনি বিক্রির পথে ঠেলে দিয়েছে। এই বাণিজ্যের পেছনে রয়েছে এক নির্মম বাস্তবতা: দারিদ্র্য।
সফিরুদ্দিনের মতোই আরেক ভুক্তভোগী জ্যোৎস্না বেগম, ৪৫। ২০১২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়ে নিয়ে তিনি কঠোর জীবন সংগ্রামে পড়েন। তার বাড়ি কালাই উপজেলার বিনাই গ্রামে। অভাব থেকে বাঁচতে প্রথমে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন পোশাক কারখানায় কাজ করতে। ঢাকায় এসে তার পরিচয় হয় বেলাল নামে একজনের সঙ্গে, তারা বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা এক দালালচক্রের খপ্পরে পড়েন। ২০১৯ সালে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ভারতে গিয়ে একটি করে কিডনি বিক্রি করে দেন। ‘এটা ছিল জীবনের বড় একটা ভুল’ জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘দালাল প্রথমে বলেছিল ৫ লাখ টাকা দিবে, পরে বলেছিল ৭ লাখ দিবে; কিন্তু কিডনি নেয়ার পর দেয় মাত্র ৩ লাখ টাকা।’
বেলালও তার কিডনির জন্য ৩ লাখ টাকা পায়, আর টাকা পাওয়ার পর জ্যোৎস্না বেগমকে ছেড়ে দিয়ে আরেক নারীকে বিয়ে করেন। এখন জ্যোৎস্না বেগম শারীরিক ও মানসিক ব্যথায় সারাক্ষণ কাতর। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ভারী কাজ করতে পারি না। বাঁচতে হয় ওষুধ খেয়ে। ওষুধ কেনার টাকাও থাকে না হাতে।’
জ্যোৎস্না বেগম ও সফিরুদ্দিনের এখন রাতে ঘুম আসে না। বিছানায় শুয়ে কাতরান আর ভাবেন, কী ভুল তারা করেছেন। দালালের খপ্পরে পরে মূল্যবান অঙ্গ হারিয়েছেন। যে-মূল্য পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি মূল্য এখন দিতে হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণাবোধের মধ্য দিয়ে।
সীমান্তের ওপারে ভারতেও কিডনি পাচার নিয়ে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী; কিন্তু ওই অঞ্চলের দরিদ্রতা দূর করা না গেলে এই ভয়াবহ চক্র থেকে অসহায় মানুষকে মুক্তি দেয়া যাবে না।
আল-জাজিরায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে