বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা যত করা হবে, ততই তিনি উজ্জ্বল হবেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সামনাসামনি প্রথম দেখি ১৯৬৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, তখন আমি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি। আইয়ুব খান তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, মোনায়েম খান গভর্নর। বঙ্গবন্ধু সেদিন কিশোরগঞ্জে গিয়েছিলেন। কিশোরগঞ্জের রংমহল সিনেমা হলে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করছিলেন সামান্য কিছু মানুষ নিয়ে, সেই মানুষের সংখ্যাটা একশ হতে পারে। তার সঙ্গে সেদিন ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনসহ আরও কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। প্রথম তাকে দেখা, সাদা হাওয়াই শার্ট পরিহিত, প্যান্ট, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, লম্বা মানুষ।
তিনি যখন বক্তৃতা করছিলেন আমার মনে হয়েছিল, আমি যখন স্কুলে পড়তাম, ওই সময় গাইতাম ‘পাকসার জমিন সাদবা’ এর কোনো অর্থ বুঝতাম না; কিন্তু এটা মনে হতো-এটা পাকিস্তানের জাতীয় সংত। জিন্নাহ জাতির পিতা; কিন্তু সেদিনই যখন শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শুনলাম, সেখান থেকে আমি দুটো কথা শিখলাম- একটা হলো পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতিকে শোষণ করছে। দ্বিতীয়ত, আমরা বাঙালি জাতি, আমার সোনার বাংলা আজকে শ্মশান। সেই যে দুটি কথা শুনেছিলাম, আজ পর্যন্ত সেই দুটি কথা আমার মন থেকে বিদূরিত হয়নি এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেই দুটি কথা মন থেকে যাবে না।
বঙ্গবন্ধুকে দ্বিতীয়বার দেখেছি প্রায় ৩ বছর পর ১৯৬৭ সালে, যখন তিনি সিলেটের একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বাহাদুরাবাদ মেইল ট্রেনে ময়মনসিংহ যান, স্থানটি কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন।
১৯৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর তাকে আমি তৃতীয়বার দেখেছিলাম এবং সামনাসামনি কথা বলেছিলাম। তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর কিশোরগঞ্জের তৎকালীন নেতারা বিশেষ করে কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দীন আহমেদ আমাকে একটি চিঠি দিয়ে পাঠালেন বঙ্গবন্ধুর কাছে, যাতে কিশোরগঞ্জে একটি জনসভার তারিখ দেয়া হয়। কারণ সারা দেশ তখন পাগল ছিল বঙ্গবন্ধুকে তাদের এলাকায় নেয়ার জন্য। তখন ৫১ পুরানা পল্টনে ছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অফিস। কী রকম অফিস? যেখানে দোতলায় বসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আর তার পাশের রুমটিতে বসতেন তাজউদ্দীন আহমেদ। আমি প্রথম মহামানবের সামনে গেলাম। মহামানবের সামনে গিয়ে কোনো কথা বলতে পারলাম না। শুধু চিঠিটি দিয়ে বললাম, মহিউদ্দিন সাহেব চিঠিটা দিয়েছেন। চিঠিটি হাতে নিয়ে তিনি ১ সেকেন্ড দেখেই তাজউদ্দীন বলে দুটি ডাক দিলেন। তাজউদ্দীন তার রুম থেকে বের হয়ে আসলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দেখো তো, কিশোরগঞ্জের মহিউদ্দিন চিঠি লিখেছে জনসভার কোনো তারিখ দেয়া যায় কি না।’
বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, ‘তুই করিস কী?’ বললাম, ‘আমার নাম ফজলুর রহমান, এমএ পড়ি, ইকবাল হলে থাকি। আমি কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ও ১১ দফা আন্দোলনের নেতা ছিলাম ইত্যাদি।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘ও তাই নাকি? কই থাকিস?’ বললাম, ‘ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে- শাহজাহান সিরাজের রুমমেট আমি।’ তিনি আমার খুব প্রশংসা করে বললেন, ‘ইয়েস, তুই আসবি।’ কিছুক্ষণ পর তাজউদ্দীন আহমেদ তার রুম থেকে এসে বলেন, ‘একটা তারিখ খালি আছে ১৯৭০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই তারিখে আমরা কিশোরগঞ্জ যেতে পারি কারণ পরের দিন ময়মনসিংহে মিটিং আছে।’
তারপর বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম কিশোরগঞ্জে যখন গিয়েছিলেন, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ সালে। তখন আমার হাতেই মাইক ছিল। কিশোরগঞ্জে তখন সিএনবির ডাকবাংলো ছিল, সেখানে তিনি দুপুরবেলা খেয়েছেন এবং রাতেরবেলা কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ওনাকে তুলে দিয়েছি- এটুকু। সেই সময় ছবিও একটা তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, সেখানে অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম। দুর্ভাগ্য; সেই ছবিটা হারিয়ে গেছে।
১৯৭০ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি হাওর অঞ্চলে নির্বাচনি ক্যাম্পেইনে গিয়েছিলেন। তখন আমি মাইক পরিচালনা করছিলাম ইটনা দেওয়ান বাড়ির মাঠে। ওই প্রোগ্রামে বঙ্গবন্ধুকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে বক্তৃতা করছিলাম, ওনার নাম ঘোষণা করার পর তিনি বলছিলেন, ‘আমি তোর বয়সে তোর মতো বক্তৃতা করতাম।’ এটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। তারপর বঙ্গবন্ধুকে আমি দেখেছি দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২/১৯৭৩ সালে। তিনি আবার কিশোরগঞ্জ গেলেন ৭ মার্চের নির্বাচনের আগে।
সর্বশেষ মহামানবকে আমি দেখেছি বাকশাল করার কিছুদিন আগে। সময়টা ছিল ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাস। এটা হলো দেখার ক্ষেত্রে অপরদিকে মিছিলে মিছিলে তো পল্টন ময়দানে, ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে গিয়েছি সেগুলো তো আছেই। ওনার বাড়িতে গিয়েছি। ওনি বাড়ি থেকে বক্তৃতা করছিলেন- তোমরা আগাইয়া যাও, দেশ স্বাধীন হবে ইত্যাদি। ওগুলো তো আর ব্যক্তিগত দেখা না। কতবার দেখেছি হিসেব নেই। যেহেতু ৬৯, ৭০, ৭১, ৭২-এ আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ছিলাম, কাজেই অসংখ্যবার ওনাকে দেখেছি। দু-একবার আদর করে জিজ্ঞাসা করছেন-মাথায় হাত দিয়েছেন- এটাই আমার জীবনে বড় ব্যাপার।
আমি যখন যে অবস্থায়ই থাকি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসী একজন লোক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা-অসাম্প্রদায়িকতা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বা খেটে খাওয়া মানুষের ভরণপোষণের যে রাজনীতি সেই রাজনীতি বিশ্বাস করেই আমি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। সে থেকে আমার চেতনার স্তরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামটা ফাইনাল খেলায় ক্যাপ্টেন হিসেবে ১ নম্বরে থাকবে।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কতিপয় দুষ্কৃতকারী, স্বাধীনতাবিরোধী পথভ্রষ্ট মানুষের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন মহামানব। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ১২২ নম্বর রুমে থাকতাম। আমার রুমমেট আবদুল মান্নান, যিনি ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হয়েছিলেন, পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে আমি রুমে বসে পড়ছি। মান্নান সাহেব তখন অনেক বড় ছাত্রনেতা। তার রুমে আসলেন তৎকালীন ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহবুব জামান, অজয় দাশগুপ্ত, কাজী আকরাম হোসেন, নূহ-উল আলম লেলিনসহ ছাত্রনেতারা। ১৪ আগস্ট সারা রাত পাহারা দেবেন তারা। কারণ বঙ্গবন্ধু পরদিন হলে আসবেন। ইকবাল হলের গেস্টরুম কন্ট্রোলরুম হলো ছাত্রনেতাদের। কিছুক্ষণ আগে শেখ কামাল হলে এসে ফেরত গেছেন। সবাই বলল, কামাল ভাই, হলে থেকে যান। কামাল ভাই বলে গেলেন, ‘আমি কাল ভোরবেলায় তোমাদের কাছে আসবো।’ সেই আসা ওনার আর হয়নি। তখন তারা আলাপ করতেছে, বলতেছেন- ঘটনাটি খুব খারাপ মনে হচ্ছে, আজকে বড় ভাই (মণি-সিংহ) এর কাছে গিয়েছিলাম। বড় ভাই আমাদের খুব দুঃসংবাদের মতো একটা কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘যেখানে জাতীয় নেতারা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে পা বাড়ায়, সেখানে তাদের হত্যা করা হয়।’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটটা বোঝার জন্য কথাগুলো বলছি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে আমরা কিছু বুঝতে না পারলেও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রটা এমন এক জায়গায় এসেছে যে, বড় ভাই নাকি বঙ্গবন্ধুকে রিক্যুয়েস্ট করেছিলেন কিছুদিনের জন্য আপনি সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমানে রাশিয়া) গিয়ে থাকেন, আমরা ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা করে নিই, এক মাস পর আপনি আসেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজি হননি। এই কথাটি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম অন্যদের বলছেন; আমি কিন্তু পাশের সিটের টেবিলে বসে পড়ছি। আমার শরীরটা শিহরিত হয়ে উঠল। তখন আমি রাজনীতি করি না, ছেড়ে দিয়েছি। তখন মান্নান আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে। একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের মতো বাঘা বাঘা কমিউনিস্টরা যেখানে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আছেন সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভয় কী? আপনারা তাকে রক্ষা করতে পারবেন না। বললেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি।’ এই কথা বলে তারা চলে গেলেন এবং আবদুল মান্নানও চলে গেলেন।
আমাকে বললেন, দরজাটা ধাক্কা দিয়ে রাখেন, লাগায়েন না, আমি ভোরবেলা রুমে আসব। আমি ঘুমে, ভোর সোয়া ৫টায় মান্নান এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে বললেন, ফজলু ভাই- উঠলেন না, বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলছে। আমি কথাটা শুনে বিশ্বাস করলাম না। কারণ ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন ও সুহার্তের রাজনীতির প্লটটা কিন্তু আমার সামনে আছে। সেই প্লটটা তখন আমার সামনে ভেসে উঠল। তখনই আমার মনে হলো, ঢাকা শহর ম্যাচাকার হয়ে যাবে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বিনা প্রতিবাদ ও বিনা প্রতিরোধে যাবে না; কিন্তু আমি তো দলের কেউ না। আমি তখন রাজনীতি করি না। বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর আমি তওবা করে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। সুতরাং মনে মনে আমার সিদ্ধান্ত হলো, হল থেকে বেরিয়ে যাব। হল থেকে ভোরবেলা বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় জেলের সামনে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড দেখলাম। দেখলাম, একদল মিলিটারি জিপে এলএমজি ফিট করে গেটে আসলো, সব লোককে পেটানো শুরু করলো আর আমরা প্রাণপণে দৌড়াতে শুরু করলাম রিকশা থেকে লাফ দিয়ে। দৌড়াতে দৌড়াতে এমন একটা অবস্থা হলো কোথাও জায়গা হলো না। সবার বাড়িঘর গেট লাগানো। ঢাকা শহরে পরিচিত মানুষ তেমন নেই। গভীর আতঙ্কজনক অবস্থা।
যেখানে গিয়ে উঠলাম, সেটা নবাবপুরের আরজু হোটেলে। আমাদের খুব পরিচিত সেই হোটেল। সেখানে আমার বড় ভাই আসলে থাকতেন। আমি হাঁটতে হাঁটতে আরজু হোটেলে চলে গেলাম। কারণ আমার যে ভয় ও শঙ্কা ছিল সেটা ভুল প্রমাণিত হলো। যা হোক, আমি আরজু হোটেল ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার আজাদকে পেলাম। আজাদ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাই, বঙ্গবন্ধুকে নাকি মেরে ফেলেছে, এ কথা বলে কান্নাকাটি শুরু করল সে। কারণ তারা তো জানে, আমি আওয়ামী লীগ করি। আমার বড় ভাই আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। এর মধ্যেই একজন বিহারি ছেলের নেতৃত্বে কিছু লোক করতাল-ঢোল বাজিয়ে আজাদকে মারার জন্য হোটেলের দোতলায় উঠলো এবং তাকে দুটি চড় মারলো। বলল, ‘এই হারামজাদা তোর বাপতো মইরা গেছে গা, তুই যাবি কোথায়?’ আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, তো সেই সময় বিহারি ছেলেটা বলল- ‘চল, আমি মাথায় পাগড়ি বানছি। কামাইল্লারে মাইরা ফেলছি, সুলতানারে বিয়া করা লাগবো, ওরে তো বিধবা রাখা যাইব না।’ সে বিহারি ভাষায় বলছে। বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুক্তিযুদ্ধের যে রক্ত, এই রক্তটা ঝাড়া দিছে; আমি কিন্তু একটু দূরে রুমের মধ্যেই বসা।
কামাল ভাইকে মেরে ফেলছে বলার সঙ্গে বিহারি ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, ‘একদম বংশ শেষ কইরা দিছে। রাসেইল্লারেও মাইরা ফেলছে।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই যে শপথ করছিলাম আল্লাহর কাছে যে রাজনীতি করবো না, সেটা ভেঙে গেল। আমার মনে হলো, যে দেশে নারী-শিশু হত্যা করা হয় তাদের রক্তের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আল্লাহ তুমি আমাকে শক্তি ও সাহস দাও। আমি আবার রাজনীতিতে ফিরে যেতে চাই।
আমি কিশোরগঞ্জ মুজিব বাহিনীর লিডার ছিলাম। তখনো আমার কাছে অনেক অস্ত্র ছিল। আমি সেই আরজু হোটেল থেকে রাতেরবেলায় নারায়ণগঞ্জ গেলাম। পরের দিন ভোরবেলায় নরসিংদী হয়ে ভৈরব। ভৈরবে তখন কারফিউ চলছে। ভৈরভ থানার ওসি ছিল, তার নাম কালা মোশাররফ, তিনি বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। অষ্টগ্রাম ও ইটনা থানার ওসি ছিলেন। তার কাছে আমি অনেক অস্ত্র জমা দিয়েছি। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বিকেল ৪টা, তিনি আমাকে দেখে বললেন, আপনারা মানুষ! বঙ্গবন্ধুর লাশটা পড়ে আছে, রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই, জিল্লু ভাই কোথায়? ওসি আরও বললেন, এই যে দেখুন- ‘আমার হরিণগুলো দুদিন ধরে কিছু খায় নাই। বনের হরিণ খায় না। আপনারা মানুষ, আপনারা কোনো প্রতিরোধ করলেন না। সে আমাকে ধরে কাঁদতে শুরু করল।
এখানে একটা কথা বলে রাখি, সেই ওসির বাড়ি ছিল নবীনগর। আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় না খেয়ে মারা গেছে। আওয়ামী লীগ তাকে দেখে নাই। এত অভিশপ্ত একটি দল আওয়ামী লীগ।
যা হোক, বললাম ভাই- এসব বাদ দেন। আমাকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। ওসি বললেন, অস্ত্র আছে? বললাম- আছে। ভৈরবের সেই ওসি মোশাররফ মিলিটারির চোখ ফাঁকি দিয়ে একটা লঞ্চ ভাড়া করে রাত ৩টার সময় আমাকে একা লঞ্চে তুলে দিলেন। সারেংকে বললেন, তেলের টাকা দিয়ে দিলাম। যদি তার কোনো ক্ষতি হয় তোর জীবন শেষ হয়ে যাবে। রাত ৩টার সময় পাঁচ ঘণ্টা লঞ্চ চালিয়ে আজমিরীগঞ্জ থানার একটা বাজারে নামিয়ে দিল। নৌকা বেয়ে আমি যখন বাড়িতে গেলাম, শত শত মানুষের কান্নার রোল পড়ে গেল। বাজারে-বাড়িতে মানুষের জায়গা হয় না। রাতেরবেলায় বসলাম আমার বড় ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী করবা? বড় ভাই বললো, প্রতিরোধ করতে হবে, অস্ত্র তোলো। আমি মুজিব বাহিনী ও মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের ডাকলাম, মাটির নিচ থেকে অস্ত্র তুললাম। পরদিন ইটনায় গেলাম। ইটনার ওসি শামীমকে বললাম, এখন থেকে আপনি অফিসিয়াল কোনো কাজ করতে পারবেন না। এটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষের শক্তির থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে, আমরা এ থানা দখল করলাম।
এখানে একজন নেতার নাম উল্লেখ করতে চাচ্ছি না, তিনি এমপি ছিলেন। ২৭ আগস্ট তিনি কিশোরগঞ্জ গেলেন ঢাকা থেকে। তিনি আমাকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে থানায় ফোন করে বললেন- তুমি তাড়াতাড়ি কিশোরগঞ্জে আসো, তুমি ইটনা দখল করছ, আমরা তো কিশোরগঞ্জ দখল করে বসে আছি। আনন্দে আমি কিশোরগঞ্জ আসলাম। এসে দেখি, কথাটা সত্য নয় এবং এ চক্রান্তের মাধ্যমে আমাকে গ্রেপ্তার করানো হলো একটা মিটিং থেকে এবং কন্ডিশন দেয়া হলো, তুমি সব অস্ত্র জমা দিলে ছাড়া পাবে। পরদিন আমাকে স্পিডবোটে করিমগঞ্জ থেকে ইটনায় নিয়ে যাওয়া হলো। বড় ভাই অস্ত্র নিয়ে এসে অস্ত্র জমা দিল; কিন্তু আমাকে আর ছাড়ল না। শেষ পর্যন্ত অনেক সাহসিকতার সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের অনেক জোরাজুরি করে আমি ওখান থেকে মুক্ত হলাম।
সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে চলে গেলাম সোজা সিলেট, সিলেট থেকে ভারতে। সেখানে গিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশে যখন আবার ঢুকলাম তখন ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। পল্লীকবি জসীমউদদীনের নেতৃত্বে একটা কমিটি করলো, আমি সেই কমিটির সঙ্গে যুক্ত হলাম। কোনোভাবেই পল্লীকবি জসীমউদদীনকে মিলিটারিরা শহীদ মিনারে যেতে দেবে না; কিন্তু আমরা গেলাম, তখন থেকে খুব ছোট ছোট করে কানে কানে শেখ মুজিব নামে একজন মানুষ ছিল, মুক্তিযুদ্ধ নামে একটা ঘটনা ছিল- এটা আস্তে আস্তে শুরু হলো। আগস্টের ১২ তারিখ থেকে ওপেন রাজনীতি শুরু হলো; কিন্তু সরকার বলল, কোনো ব্যক্তির নামে রাজনীতি করা যাবে না। বাকশালের নামে কোনো রাজনীতি করা যাবে না। এরপর অনেক ঘটনা, সেদিকে আর গেলাম না।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর এতই কঠিন ছিল সেই সময়গুলো; কিন্তু এ দেশের রাজনীতিতে তাকে বারবারই ছোট করার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। তিনি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেন। আরও সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেন। কারণ তিনি মহান মুক্তিদাতা। কারণ রাজনীতিতে এ জাতির মধ্যে তার মতো কেউ নেই।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধুর ছবিটি যেদিন বঙ্গভবন থেকে নামানো হলো, আমি দু-তিন দিন ঘুমাতে পারিনি। আমি বাম হাতের আঙ্গুলটা লম্বা করে বলেছি, এই রাজাকারের বাচ্চারা, যারা মনে করছিস, বঙ্গবন্ধুর ছবি নামাইলে অথবা ছবির ওপর প্রস্রাব করলে বঙ্গবন্ধু শেষ হয়ে যাবে, তোরা বঙ্গবন্ধুর এই আঙুলটার সমান হতে পারবি না। আমি প্রথম তা বলেছিলাম। সবাই বলেছে, আপনাকে মেরে ফেলবে। আমি বলেছিলাম, এতেও আমি কিছু মনে করি না। ধানমন্ডি ৩২ ভাঙার পরও আমার একই অবস্থা হয়েছিল।
পরিশেষে বলি, শেখ মুজিবকে নিয়ে ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করতে দেন। যত বিশ্লেষণই করুক, যে যাই করুক ইতিহাসে বাঙালি জাতির মধ্যে শেখ মুজিবের নামটা ফাইনাল খেলায় ক্যাপ্টেন হিসেবে ১ নম্বরে থাকবে, কেউ ফেরাতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর প্রাসঙ্গিকতা কখনো হারাবে না। বঙ্গবন্ধু আরও উজ্জ্বল হয়ে এ বাংলাদেশে আসবে। রাজনীতিতে বাঙালি জাতির মধ্যে তার সমসাময়িক কেউ নেই। একজন লোক তার সমসাময়িক, তিনি নেতাজী সুভাস বসু। একজন লোক রাজনীতিতে সাহসিকতায় স্বাধীনতা-সংগ্রামে-স্বপ্নে বাঙালি জাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন; কিন্তু বরাবরই আমরা ভুল পথে হেঁটেছি, তার দেখানো পথের বিপরীতে হেঁটেছি।
ফজলুর রহমান: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে