Views Bangladesh Logo

গুপ্ত রাজনীতির অপচর্চা

বাংলার রাজনীতিতে যেন নতুন এক নাট্যমঞ্চের জন্ম হয়েছে। একসময় রাজনীতি মানেই ছিল প্রকাশ্য লড়াই- কে কত জোরে স্লোগান দিতে পারে, কে কত বড় মিছিল নামাতে পারে, কে কতটা উঁচু কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ কিংবা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে জনতাকে মাতিয়ে তুলতে পারে। তখন রাজনীতিকরা পরিচয় লুকাতেন না, বরং গর্ব করতেন- ‘আমি অমুক দলের কর্মী, আমি অমুক মতের অনুসারী।’ কিন্তু সময় বদলেছে। সেই সরল ঘোষণা আজ সেকেলে মনে হয়। রাজনীতির মঞ্চে এখন নতুন ঢেউ- প্রকাশ্যে যা নয়, আড়ালে সেটাই আসল; নাম তার গুপ্ত রাজনীতি।

আমাদের সমাজে সবকিছুরই যেন গুপ্ত সংস্করণ আছে। গুপ্তধন, গুপ্তপ্রেম, গুপ্ত শত্রু- সবই চলমান। সোশ্যাল মিডিয়ায় গুপ্ত-আইডি দিয়ে প্রেম কিংবা ট্রল করার মতো, রাজনীতিতেও শুরু হয়েছে গুপ্ত প্রবাহ। ফলে বাংলাদেশকে ইতিহাস হয়তো একদিন চিনবে ‘গুপ্ত রাজনীতির জন্মদাত্রী’ দেশ হিসেবে।

আজকের দিনে কে কোন দলে, সেটা বোঝা দায়। মঞ্চে বক্তৃতা দেওয়া মানুষটিই হয়তো কাল প্রতিদ্বন্দ্বী দলের ব্যানারে হাসিমুখে ছবি তুলছেন। প্রশ্ন করলে বলেন- ‘আরে ভাই, গণতন্ত্র মানে তো সবার সঙ্গে মিশে চলা!’ কিন্তু এই মিশে চলার ভেতরে আছে রহস্যময় এক নাটকীয়তা। সবাই জানে সবাই অভিনয় করছে, তবু অভিনয়ের মহড়া চলছেই। একেকজন যেন একেকজন গুপ্তযোদ্ধা- দুমুখো ছদ্মবেশে লড়াই করছে, অথচ আবার একসঙ্গে চা-নাশতায় বসে হাসাহাসি করছে।

বিদেশি সিনেমায় গুপ্তচরবৃত্তি আমরা কম দেখিনি। জেমস বন্ড, জেসন বর্ন কিংবা কেজিবি-সিআইএ- তাদের গুপ্তচরদের নানান কাহিনি দুনিয়া মাতিয়েছে। কিন্তু আজ মনে হয়, আমাদের দেশীয় রাজনীতিকরাই আসল ওস্তাদ। তারা দিনে অন্য দলের পতাকা হাতে র‌্যালিতে হাঁটেন, আর রাতে নিজের দলের সদর দফতরে গোপন বৈঠকে কৌশল সাজান। এক কথায়, তাঁরা বন্ডদেরও গুরু।

এই খেলায় আসল রসদ হচ্ছে ‘পদ’। মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক কিংবা সহ-সম্পাদক- এসব আসনের প্রতি রাজনীতিকদের অদ্ভুত আসক্তি। পদ পাওয়ার নেশাতেই গড়ে উঠছে গুপ্ত রাজনীতির মজবুত ভিত। আপনি হয়তো বহু বছর ধরে দলের জন্য মাঠে ঘাম ঝরালেন, কিন্তু কোনো পদ পেলেন না। অথচ প্রতিদ্বন্দ্বী দলের একজন ‘গুপ্ত’ সদস্য এসে দিব্যি বড় পদ বাগিয়ে নিলেন। কারণ? সে জানে কার কানে কী খবর ঢালতে হয়। তথ্য পাচারের নিখুঁত কৌশলেই সে হয়ে উঠল দলের অমূল্য সম্পদ। তখন আপনার মনে হয়- ‘আহা, গুপ্তরাই আসল ভবিষ্যৎ!’

বাংলাদেশের রাজনীতির একসময়কার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রকাশ্য সংঘর্ষ। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগর কিংবা বিএনপি-ছাত্রদল-যুবদল- সকলেই খোলাখুলি লড়ত। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর চিত্রটা বদলে গেছে। এক সময় যারা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের পতাকা বয়ে বেড়াত, আজ তারা নতুন পরিচয়ে হাজির। সেই সাবেক নেতাকর্মীরাই এখন ভিন্ন দলীয় পতাকার নিচে বিপ্লবী সেজে দাঁড়িয়েছে। যাকে একসময় পতিত স্বৈরাচারের দোসর বলা হতো, তিনি আজ স্বয়ং মহাবিপ্লবী, অন্যদের ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলে ট্যাগ দিচ্ছেন। প্রশ্ন করলে বলেন- ‘তখন সেই সংগঠনে থাকা ছিল কৌশল।’ কিন্তু সমস্যা হলো, এখন কোনটা কৌশল আর কোনটা আসল, তা নির্ণয় করাই কঠিন।

এটাই গুপ্ত রাজনীতির আসল খেলা- সবার পরিচয়ই অর্ধেক সত্য, অর্ধেক কৌশল। গণতন্ত্রের সংজ্ঞাও যেন পাল্টে গেছে। আগে ভোটাররা ব্যালট দিয়ে নেতা বেছে নিতেন, আজ পদবণ্টন হয় নেতার ইচ্ছায়- কে ভেতরে কার হয়ে লবিং করছে, কার খবর পাচার হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে ভাগ্য গড়ে ওঠে। প্রকাশ্যে নেতা বলেন, ‘আমরা স্বচ্ছতা চাই।’ ভেতরে আসল নীতি চলে- ‘অস্বচ্ছতাই আমাদের শক্তি।’

সাধারণ জনগণ এ নাটকের দর্শক। তারা মিছিল দেখে হাততালি দেয়, ভাষণ শুনে উত্তেজিত হয়; কিন্তু গুপ্ত খেলাটা তাদের অগোচরেই থেকে যায়। আজ যিনি ‘শত্রু’ দলের বিরুদ্ধে আগুনঝরা বক্তৃতা দিচ্ছেন, কাল তাকেই দেখা যায় সেই শত্রুর সঙ্গে একান্ত আড্ডায়। জনগণ হতবাক হয়ে ভাবে- ‘হায় হায়, এ কোন জাদুবিদ্যা!’ অথচ এটাই এখন নিয়মিত পাঠ।

ছাত্র রাজনীতিতে এই গুপ্ত কৌশলের ব্যবহার আরও প্রবল। অভিযোগ আছে, কিছু সংগঠন- যেমন ইসলামি ছাত্র শিবির- গুপ্ত রাজনীতির এক নম্বর চালক। তারা সাধারণ শিক্ষার্থীর সামনে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক পতাকা তোলে না, বরং সামাজিক কাজ বা ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের আড়ালে শক্ত ঘাঁটি গড়ে। এর ফলে রাজনীতির স্বচ্ছতা তো নষ্ট হয়ই, মুক্ত গণতন্ত্রের পথও বাধাগ্রস্ত হয়। ক্যাম্পাসে যখন প্রকাশ্য রাজনীতি নিষিদ্ধ হলো, তখন গুপ্ত রাজনীতি আরও জোরদার হলো। প্রকাশ্যে যা নিষিদ্ধ, আড়ালে তাই চলল আরও ব্যাপকভাবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, গুপ্ত রাজনীতি শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী দমন নয়; এটা রাষ্ট্রের জন্যও বিপজ্জনক। এতে সরকার সাধারণ নাগরিকদের প্রতিও অবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক পরিবেশ হয়ে ওঠে বিষাক্ত। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এই ছদ্মবেশী কূটনীতি শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকেই দুর্বল করে তোলে।

মজার বিষয় হলো, এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি নতুন কোনো কোর্স চালু হয়, তার নাম হতে পারে- ‘গুপ্তরাজনীতি ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তা।’ ছাত্ররা শিখবে কীভাবে দ্বিমুখী প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, কীভাবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে করমর্দন করে আড়ালে ছুরি মারতে হয়। পাস করলে ডিগ্রির নাম হবে- ‘মাস্টার অব গুপ্ত পলিটিক্স (MGP)।’

ভাবুন তো, কেমন হবে যদি প্রতিটি রাজনৈতিক দলের থাকে আলাদা গুপ্ত শাখা? তাহলে অন্তত সবাই জানবে কারা গুপ্ত। তাদের জন্য আলাদা ইউনিফর্ম চালু করা যেতে পারে- এক শার্টে পাশাপাশি দুটি দলের প্রতীক আঁকা। বার্ষিক সম্মেলনে দেয়া যেতে পারে ‘সেরা দ্বিমুখী বক্তৃতা পুরস্কার।’ তখন রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ হবে- ‘মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ: প্রকাশ্য ও গুপ্ত রাজনীতির সমান্তরাল ধারা।’

কিন্তু সব কৌতুকের আড়ালে বাস্তবতা ভয়াবহ। গুপ্ত রাজনীতি আসলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করছে। যখন জনগণ দেখতে পায় নেতা পরিচয় বদলাতে ওস্তাদ, তখন তাদের বিশ্বাস ভেঙে যায়। তখন রাজনীতি হয়ে ওঠে শুধু একধরনের নাটক- যেখানে আদর্শ, নীতি, সততা সবই সাজসজ্জা বা মুখোশের আরেক নাম।

জনগণের মধ্যে অনেকে বলছেন- গুপ্ত রাজনীতি মানে গণতন্ত্রের অবমাননা। আবার কেউ কেউ মনে করেন, এটিই আসল বুদ্ধির খেলা। তবে যাই বলা হোক, একটা সত্য অস্বীকার করা যায় না- গুপ্ত রাজনীতি এখন জাতীয় বিনোদনের উৎসে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্রের খবর পড়া কিংবা টেলিভিশনে টকশো দেখা মানেই নতুন নতুন গুপ্ত কাহিনি শুনে বিস্মিত হওয়া।

আসলে সমস্যা একটাই- বাংলাদেশে সবকিছুই সম্ভব। তাই ‘গুপ্ত গণতন্ত্র’ও অবিশ্বাস্য কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ পথে চলতে থাকলে আমরা কোথায় পৌঁছব? স্বচ্ছ রাজনীতি যদি না আসে, তবে জনগণের আস্থা ভাঙবে, সমাজে বিভাজন বাড়বে, আর রাজনীতি হবে নিছক ক্ষমতার ছদ্মবেশী নাটক।

এ কারণেই সচেতন মহল বলছে, সময় এসেছে গুপ্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার। রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট পরিচয় নিয়ে জনগণের সামনে দাঁড়াতে হবে। আদর্শ লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যে রাখতে হবে। জনগণকে দিতে হবে স্বচ্ছতা, দায়িত্ববোধ আর বিশ্বাসযোগ্যতা। কারণ রাজনীতি যদি আড়াল আর কৌশলের অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে, তবে সেখানে জনগণের জন্য কোনো আলো জন্ম নেবে না, জন্ম নেবে কেবল অবিশ্বাস আর বিভ্রান্তি।

আমাদের ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে- যখন রাজনীতি অস্বচ্ছ হয়, তখন জনগণই সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭০-এর দশকে জনগণ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল, ৯০-এ দেখেছিল গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ। কিন্তু সেইসব স্বপ্নের ভেতরে যদি গুপ্ত চক্রের কারসাজি প্রবেশ করে, তবে আবারও এই জাতি হতাশার অন্ধকূপে নিমজ্জিত হবে। আজ যারা কৌশলের নামে ছদ্মবেশী খেলায় মাতোয়ারা, আগামী প্রজন্ম তাদের ইতিহাসে ক্ষমা করবে না।

গুপ্ত রাজনীতি মানে শুধু একটি দলের ক্ষতি নয়; এটি গোটা রাষ্ট্রকাঠামোকে দুর্বল করে। যখন দলীয় নেতারা নিজেদের পরিচয় গোপন করেন, তখন জনগণের আস্থা ভেঙে পড়ে। যখন ভোটাররা বুঝতে পারে তাদের প্রিয় নেতা আজ এক রঙের পতাকা হাতে, কাল আরেক রঙের পতাকার নিচে- তখন রাজনীতি হয়ে ওঠে সার্কাস, আর গণতন্ত্র রূপ নেয় ভাঁওতায়। এই ভাঁওতা টিকলে হয়তো কিছু ব্যক্তি বাঁচবে; কিন্তু জাতি বাঁচবে না।

তাই এই ছদ্মবেশ ভাঙতে হবে। সময় এসেছে নতুন এক সংস্কৃতির- যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্ব হবে সাহসী, প্রকাশ্য, নির্ভীক। যেখানে বলা হবে: ‘হ্যাঁ, আমি এই আদর্শে বিশ্বাস করি, এটাই আমার দল, এটাই আমার লড়াই।’ সেই সততার রাজনীতি ছাড়া বাংলাদেশ এগোতে পারবে না।

সত্যিকারের গণতন্ত্র মানে আলোর পথে হাঁটা, অন্ধকারে পথ খোঁজা নয়। গুপ্ত রাজনীতি সেই অন্ধকারকেই দীর্ঘায়িত করছে, জনগণকে করছে অচেনা গোলকধাঁধায় বন্দি। যদি আজ আমরা সবাই মিলে এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারি, তবে আগামী দিনের বাংলাদেশ হবে গুপ্ত রাজনীতির কারাগার- যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি আর বিশ্বাসযোগ্যতার কোনো স্থান থাকবে না।

কিন্তু বাংলাদেশ কোনো কারাগার নয়। এ জাতি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অন্ধকার ভেদ করে আলোয় এসেছিল। তাই আবারও প্রয়োজন সেই মুক্তির ডাক- গুপ্ত রাজনীতির শেকল ভেঙে স্বচ্ছ রাজনীতির পথে যাত্রা করা। জনগণ যদি একবার দৃঢ়ভাবে বলে, ‘আমরা গুপ্ত নয়, প্রকাশ্য রাজনীতি চাই,’ তবে নেতাদের আর কোনো ছদ্মবেশে টিকে থাকার জায়গা থাকবে না।

চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ