Views Bangladesh Logo

তাজউদ্দীন আহমদ জন্মশতবর্ষ

একাত্তরের নিঃসঙ্গ সারথি

Rahat  Minhaz

রাহাত মিনহাজ

রাত তখন আনুমানিক ১১টা। ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের বাড়ির লনে এলোমেলো পায়চারি করছেন তাজউদ্দীন আহমদ। চোখে মুখে প্রচণ্ড অভিমান, রাজ্যের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব চিন্তায়। সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি আর্মি তখন শহরের মূল টার্গেটগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। গোটা ঢাকা শহর নিস্তব্ধ। দেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে এক চরম ক্রান্তিকালে। যেখান থেকে পিছন ফেরার আর কোনো সুযোগ নেই। ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের খবর পাওয়ার পরই রাতে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ৩২ নম্বর ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। আশা করেছিলেন, আত্মগোপনে থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবেন।

বঙ্গবন্ধু তাতে রাজি না হওয়ায় টেপ রেকর্ডারে একটা ঘোষণার জন্য বঙ্গবন্ধুকে পীড়াপীড়ি করেন। তাতেও ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। ক্ষুব্ধ, ভগ্ন হৃদয়ে। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনের মাধ্যমে কেনো কোনো ঘোষণা দেননি বা কেনো আত্মগোপনে গিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে রাজি হননি তা নিয়ে নানা মতভেদ আছে। আছে বিতর্কও। তবে মনে রাখতে হবে শেখ মুজিব ছিলেন আপাদমস্তক সংসদীয় রাজনীতি করা একজন প্রজ্ঞাবান রাজনীতিক। তিনি বিপ্লবী রাজনীতিক বা গেরিলা যোদ্ধা নন। আর আত্মগোপনে গেলে মুক্তি সংগ্রাম বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবেও চিত্রিত হওয়ার শঙ্কা ছিল। সেই মুহূর্তে তার সিদ্ধান্তের নিশ্চয় কোনো না কোনো যৌক্তিকতা ছিল। অন্যদিকে চরম মুহূর্তে তাজউদ্দীন যে ধরনের ঘোষণা বা দিক নির্দেশনা শেখ মুজিবের কাছ থেকে চেয়েছিলেন তারও কোনো পটভূমি বা অপরিহার্য যৌক্তিকতা থাকতে পারে।

এদিকে জিরো আওয়ারে পুরো ঢাকা শহরে দানবীয় আক্রমণ শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। রাজারবাগ পুলিশলাইন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ মার্কেট আর ইপিআর’এ একযোগে শুরু হয় বর্বর আক্রমণ। মেশিনগানের গুলি, মর্টারের গোলার শব্দ, ট্রেসার বুলেটের ভীতিকর অতি আলো আর মানুষের আর্ত চিৎকারে নরকপল্লিতে পরিণত হয় ঢাকা। এই তাণ্ডব শুরুর পর অভিমান আর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। এরই মধ্যে শহরের বেশির ভাগ রাস্তার সড়ক বাতি নিভে গেছে। সেই বিভীষিকাময় রাতে তাজউদ্দীন ও আমীর-উল-ইসলাম আশ্রয় নেন লালমাটিয়ায় গফুর সাহেব নামের এক বিশ্বস্ত ইঞ্জিনিয়ারের বাসায়। এরপর কার্ফ্যু উঠলে ২৭ মার্চ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন। সে সময় তারা নাম পরিবর্তন করে অরেকটা ছদ্মবেশ ধরেন। তাজউদ্দীনের নাম হয় মুহম্মদ আলী আর আমীর-উল-ইসলাম রহমত আলী।

এরপর নানা প্রতিকূল পথ পাড়ি দিয়ে ৩০ মার্চ বিকেলে পৌঁছান কুষ্টিয়ার জীবননগর সীমান্তে। সেখানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আইজি গোলক মজুমদারের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সেখান থেকে গোলক মজুমদারের সঙ্গে তারা কলকাতা আসেন। এরপর একটা রাশিয়ান এএন-১২ বিমানে করে দিল্লি পৌঁছান। লক্ষ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎ হয় ৩ এপ্রিল রাতে। তাতে তাজউদ্দীন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। আর ভারত কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে সে বিষয়েও প্রাথমিক আলোচনা হয়। ওই বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কি না?

তাজউদ্দীন সে সময় জবাব দেন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। যারা এখন বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। অচিরেই সংগঠিত হয়ে কাজ করবেন। অর্থাৎ তিনি সরকার গঠনের কথা নিশ্চিত করেন। যদিও সে সময় কোনো সরকার গঠিত হয়নি। ইন্দিরার সঙ্গে তাজউদ্দীনের এই বৈঠক সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন ‘... ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন জানান পাকিস্তানি আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান সেই সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ কর্মীরাই মন্ত্রিসভার সদস্য। ...তাজউদ্দীনের এই উপস্থিত সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্যভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ...কিন্তু এর ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও অনিবার্য হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় সমগ্র রাজনীতিকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে।’ (পৃষ্ঠা ১২)

ইন্দিরা সঙ্গে দুদফা বৈঠক শেষে দিল্লিতেই একটা রেডিও ভাষণ রেকর্ড করেন তাজউদ্দীন। যা ১০ এপ্রিল কোনো এক জঙ্গল থেকে সম্প্রচার করা হয়। আকাশবাণীর মাধ্যমে সে ঘোষণা বাংলাদেশের অনেকেই শোনেন। ওই ভাষণে তাজউদ্দীন নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন। এই ভাষণে পলায়নপর ও নৃশংস গণহত্যার শিকার বাঙালি জাতির মনে কিছুটা আশার আলো জাগায়। এরপর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায় ৮ এপ্রিল ভবানীপুর এলাকার রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়িতে। ওই বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বসহ যুবনেতাদের দিল্লি বৈঠকের ফলাফল তুলে ধরেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ও সরকার গঠন প্রসঙ্গে তিনি যে অবস্থানের কথা ইন্দিরাকে জানিয়েছেন তাও উল্লেখ করেন। যদিও এতে ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। যুবনেতারা তার প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ফজলুল হক মণি ৪২ জন আওয়ামী লীগ ও যুব নেতার স্বাক্ষর নিয়ে তাউদ্দীনের বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য দিল্লিতে চিঠি লিখেন। এদিকে এসব রেষারেষির মধ্যেই ছোট্ট একটা ডাকোটা বিমানে চড়ে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের খুঁজতে শুরু করেন তাজউদ্দীন। দ্রুতই তিনি পেয়ে যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আব্দুল মান্নানকে। তাজউদ্দীন সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার বৈঠকের কথা জানান এবং একটি সরকার গঠনের আশু প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাতে সম্মতি নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দেন। এরপর আসে সেই দিন, ১৭ এপ্রিল ১৯৭১।

মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার একটি আমবাগানকে বাছাই করা হয় প্রবাসী সরকারে শপথ অনুষ্ঠানস্থল হিসেবে। এই স্থানটির বিষয় গোপন রাখা হয় নিরাপত্তার স্বার্থে। আমীর-উল-ইসলাম খুব ভোরে কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের নিয়ে আমবাগানের দিকে রওনা দেন। এদিকে শপথ অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। ২১৩ বছর আগে ১৭৫৭ সালে পলাশীর এক আমবাগানে স্বাধীনতা হারানোর পর বাংলার স্বাধীনতার নতুন অভ্যুদয় হয় আরেক আমবাগান এই বৈদ্যনাথতলায়। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। চারদিকে সাজ সাজ রব, সঙ্গে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। এদিকে যুবনেতারা শপথ অনুষ্ঠানে না আসায় শুরুতেই অনৈক্য আর বিভক্তি নিয়ে অনেকেই ছিলেন শঙ্কিত। শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে যুব নেতারা তাজউদ্দীনের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে। যাই হোক এমন এক পরিস্থিতিতে হালকা সবুজ কাপড়ে অনাড়ি হাতে বানানো একটা পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হয় শপথ অনুষ্ঠান।

সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্র ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা করা হয় কর্নেল আতাউল গণি ওসমানির নাম। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন ‘... পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হওয়ার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। ...আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড় জাতির বন্ধুত্ব।... আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি।’ (পৃষ্ঠা: ৪১২-৪১৩, তাজউদ্দীন আহমদ, নেতা ও পিতা)

এরপর দীর্ঘ এক কঠিন বন্ধুর পথচলা। মুজিবনগর সরকারে অগোচরে মুজিববাহিনী গঠন, যুবনেতাদের ঔদ্ধত্য ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ ধীর করেছে প্রবাসী সরকারের পথচলা। এ ছাড়া খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ডানপন্থি এক অংশের ষড়যন্ত্র, বামপন্থিদের নানা দাবি দাওয়া, মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট প্রশ্নে বিরোধ সব কিছুকেই সামাল দিতে হয়েছে তাজউদ্দীন আহমদকে। এছাড়া ভারতীয়দের কাছ থেকে সময়মত প্রত্যাশিত সাহায্য না পাওয়ার আক্ষেপ, স্বীকৃতির প্রশ্নে বিলম্ব বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে করছিল আনিশ্চিত। যে পরিস্থিতি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাজউদ্দীন। এ ছাড়া সেক্টর কমান্ডারদের দ্বন্দ্ব, সমর কৌশল নিয়ে মতভেদ আর ভারতীয় সেনাদের অভিযান পরিচালনা নিয়েও ছিল নানা ধরনের জটিলতা। যা অত্যন্ত মেধা আর প্রজ্ঞার সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন তাজউদ্দীন। আর জটিল-কঠিন এই কাজ করতে গিয়ে খুবই সাদামাটা এক জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমানে শেকসপিয়ার সরণি) কার্যালয়ের নয় মাস অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেন। কলকাতায় পরিবার থাকলেও তিনি তাদের সঙ্গে বসবাস করেননি। তার যুক্তি ছিল ছেলেরা জীবনবাজি রেখে খেয়ে না খেয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধ লড়ছে। আর আমি তাদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে আয়েশী জীবন যাপন করতে পারি না। যদিও সে সময় অনেকেই কলকাতায় স্বাচ্ছন্দ্যে সময় কাটিয়েছেন।

১৯৭১ সালে সময় যতই গড়িয়েছে ততই কোণঠাসা হয়েছে পাকিস্তান। অক্টোবর-নভেম্বরে যুদ্ধ অনেকটাই পরিণত হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে একের পর এক সফল অভিযান চালাচ্ছিলেন। বিশ্ব জনমত গঠনে ইন্দিরা গান্ধী ছুটছেন ইউরোপ-আমেরিকায়। ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে সমর কৌশলে আসে ঐক্যতান। সব মিলিয়ে দুরন্তগতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল মুক্তি সংগ্রাম। যার চরম পরিণতি আসে ৩ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তান হঠাৎই ভারতকে আক্রমণ করে বসে। তাজউদ্দীনসহ অন্য নেতারা নিশ্চিত হন এবার পাকিস্তানের খেলা শেষ। ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে বহুকাঙ্ক্ষিত স্বীকৃতি প্রদান করে। গঠিত হয় যৌথ কমান্ড। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তখন হয়ে দাঁড়ায় শুধুই সময়ের অপেক্ষা। তবে যুদ্ধকে এই পরিণতিতে আনতে কম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি তাজউদ্দীনকে। কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়েছে কঠিন দেশপ্রেমের পরীক্ষা। কঠিন সময়ে নিতে হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। যাতে একটু হেরফের হলে নস্যাৎ হতে পারতো পুরো মুক্তি সংগ্রাম। তবে রাজনৈতিক জীবনে পেছন সারিতে থাকতে অভ্যস্ত প্রচারবিমুখ এই মানুষটির এই সংগ্রামের প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘ দিনের। প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ছিল ঋষির মত। পুরো রাজনৈতিক জীবনেই তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি স্বাধীন বাংলাদেশের।

ধারাবাহিক আন্দোলন সংগ্রামের কর্মপন্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়েই যার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য ও দূরদৃষ্টি। উল্লেখ্য মুক্তির সনদ ৬ দফা নিয়ে এক আলোচনায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর এক প্রতিনিধি দলকে যুক্তি দিয়ে কূপোকাত করেছিলেন তাজউদ্দীন। তারপর ভুট্টো বলেছিলেন, ‘শেখের (মুজিবুর রহমান) যোগ্য লেফটেন্যান্ট আছে দেখছি।’ এই লেফটেন্যান্টই ১৯৭১ সালে মূল কান্ডারির ভূমিকা নিয়ে ছিনিয়ে আনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। যদিও পরিতাপের বিষয় একটাই যে লেফটেন্যান্ট পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি যে জেনারেলকে (শেখ মুজিব) সামনে রেখে এতো বড় যুদ্ধ জয় করলেন, সেই জেনারেলই (শেখ মুজিব) লেফটেন্যান্টকে কোনোদিন জিজ্ঞাস করলেন না কীভাবে পরিচালিত হলো বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম সফল এক জনযুদ্ধ। লেফটেন্যান্ট অপেক্ষায় থাকলেন। তবে দিনে দিনে বাড়ল দূরত্ব। একসময় জাতির কান্ডারি নৃশংস হত্যার শিকার হলেন, কিছুদিন পর কুচক্রীরা হত্যা করল লেফটেন্যান্টকেও। শেষ হলো এক অধ্যায়। বাংলাদেশ প্রবেশ করল উল্টোরথের এক আত্মবিনাশী যুগে। যদিও এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। যদি শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীনের মধ্যে এমন দূরত্ব তৈরি না হত, যদি তারা একসঙ্গে দেশটাকে গড়তে পারতেন তাহলে ইতিহাস হয়তো অন্য রকম হতে পারত।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ