ছোটগল্প
চৈত্রের তাপপ্রবাহ, শাপলাফুল ও পুঁটি মাছের ঝোল
এমন অবাক কাণ্ড কেউ কখনো দেখেনি।
এমন আজব কথাও কেউ বোধহয় কক্ষনো শোনেনি।
আর এমন অদ্ভুত মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া? প্রশ্নই আসে না।
তবু ঘটনাটি ঘটে এটা সত্য। আর সেই লোকটি আর কেউ নয়। আমি নিজে। জন্মাবধি থাকি এই গ্রামেই।
জন্মের শুরুতে প্রাকৃতিকভাবে যে প্রবৃত্তির সূচনা, জীবনভর মানুষকে মৌলিক কর্মতৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করতে তা সতত ক্রিয়াশীল। বেঁচে থাকার অন্যতম প্রেরণা, যাপিত জীবনের এক বৃহৎ আনন্দের উৎস হলো তৃপ্তিদায়ক খাবার ও সেই সব খাবারের রূপ, রস, গন্ধ ও স্পর্শ অনুভব করা। ইপ্সিত খাদ্যের আস্বাদ গ্রহণ বা সেসব নিয়ে ভাবনা বা স্বপ্ন দেখা মানুষের ধর্ম। আর তার জন্য কী না করে মানুষ? কোথায় না ছোটে!
অথচ এই খাবারের জন্য কোনোরকম শখ বা ইচ্ছা না হওয়া, দীর্ঘ সময় ধরে কিছু ভক্ষণ না করলেও কোনো চিত্তচাঞ্চল্য বা শরীরে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া টের না পাওয়া, কিংবা খালি পেটে কক্ষনো সুস্বাদু খাদ্যের স্মৃতিচারণা না করা অস্বাভাবিকই বটে। একবার খাওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় অন্তর শরীরে খাদ্যাভাব টের পাওয়া এবং পুনরায় খাবারের জন্য আকুতি ও খাদ্য গ্রহণই প্রাণীতে-জগতের জন্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ক্ষুধার সেই চাহিদা, জ্বালা, যন্ত্রণা, অন্য সব কষ্টকে অপেক্ষাকৃত লঘু, কম গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। অথচ সেই খিদের কোনো অনুভূতি বা জ্বালাই নেই আমার। এক্কেবারে নেই। আশ্চর্যের কথাই বটে!
সারা দিন-রাত কিচ্ছু না খেলেও খাদ্যের প্রতি কোনোরকম অনুরাগ বা আকর্ষণ জন্মে না আমার; কিন্তু মুশকিল হলো, দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে নিজে যতই স্থির থাকি না কেন, বাড়িময় হইচই বেঁধে যায়। ডাক্তার, কবিরাজ, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক কোনোটাই বাদ যায় না। প্রথম প্রথম পা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত, রক্ত থেকে শুরু করে থুতু, পায়খানা-প্রস্রাবের সব ধরনের পরীক্ষা করানো হতো। ব্লাডপ্রেশার এবং হৃৎস্পন্দন গোনা, হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন কুঠুরির নির্দিষ্ট গতিতে ও ছন্দময় ভঙিমায় একটানা খোলা-বন্ধ ও তার তালে তালে রক্ত চলাচলের গতি/চাপের ওঠানামা মেলানো নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন সরকারি হাসপাতালের বড় ডাক্তার নিজে; কিন্তু দেখা যায়, প্রতিটি শারীরিক প্রক্রিয়া ও মাপজোখই থাকে স্বাভাবিক, তা খাদ্যবিরতির ৪, ৮, ১২, ১৬, ২৪ কি ৩৬ ঘণ্টা পরে যখনই নেয়া হোক না কেন! শরীরে খাবারের ঘাটতির জন্য কোনো অস্বাভাবিকতাই ধরা পড়ে না ডাক্তারি পরীক্ষায়। ফলে রক্তে সুগার কমে গেলে যে চিন্তাশক্তি দুর্বল হয়ে যায় বা স্নায়ুবিক বৈকল্য ঘটে, তারও কোনো আভাস দেখা যায় না আমার মধ্যে। ভরা পেটে, খালি পেটে বাহ্যিক আচরণে যেমন অবিচলিত থাকি আমি, আমার শরীরের ভেতর রক্তকোষ, জীবকোষেও খাদ্যজনিত তেমন কোনো পরিবরর্তন দৃশ্যনীয় হয় না।
ফলে আমার মতো এই অদ্ভুত, অস্বাভাবিক মানুষটি কস্মিনকালেও যার দেখা পাওয়া যায় না, ধরেই নেয়া হয়েছে, কোনো নাম না জানা জটিলতায় ভুগছে যার কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না। অতএব, আমাকে নিয়ে ভেবে আর সময় নষ্ট করে না কেউ আজকাল।
জীবনের অর্ধ শতক পার হয়ে গেছে আমার। তাও দু-চার বৎসর আগেই। প্রায় প্রৌঢ় শরীরের অধিকারী ব্যক্তি আমি কি না জোর দাবি করি, সেই বাল্যকাল থেকে এই পর্যন্ত আমার কখনো খিদা লাগেনি। অন্য সবার মতোই তিনবেলা নিয়মিত আহার গ্রহণ করি, এটা সত্য; কিন্তু সেটা করি, কারণ সেটা করাই স্বাভাবিক। সবার প্রত্যাশাও তাই। এ ছাড়া ক্রমাগত করতে করতে অন্য দৈনন্দিন কাজের মতো এটাও একসময় রুটিন অভ্যাসে পরিণত হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, খাওয়ার জন্য আমাকে কখনো পীড়াপীড়ি, জোরজবরদস্তি করতে হয় না কাউকে। আমি নিয়মিত খাই কিন্তু খাদ্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ কিংবা আগ্রহ কখনো বোধ করি না।
ফলে মাঝেমধ্যেই চব্বিশ ঘণ্টা নির্জলা উপবাসের পর পেটপুরে খেয়ে টান টান হয়ে সোজা দাঁড়িয়ে বাঁ হাতে ছাতা ও ডান হাতে বাঁধানো লম্বা খাতাটা সঙ্গে নিয়ে স্কুলের উদ্দেশে যখন বেরিয়ে পড়ি, কেউ আমার জন্য চিন্তিত হয় না। কেবল শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিনই পড়াতে যেতে হয় স্কুলে। বিনা বেতনে স্থানীয় স্কুল ও নিকটবর্তী শহরের কলেজের পড়ালেখা শেষ করে নিজ গ্রামের স্কুলে পাওয়া এই পড়ানোর চাকরির উপার্জন দিয়ে বউ আর এক সন্তান নিয়ে সংসার চলার জন্য যথেষ্ট।
এমন একটা সময় ছিল যখন সহশিক্ষায় গ্রামবাসীর আপত্তি থাকলেও একই স্কুলে পালাক্রমে মেয়েদের ও ছেলেদের পড়ানোতে কোনো দোষ দেখেননি তারা। ফলে সেই সময় একই স্কুলে প্রথমে সকাল ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত মেয়েদের ও পরে, বেলা সাড়ে ১২টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ছেলেদের পড়ানো হতো। আমি যখন স্কুলে যেতাম, তখন দুপুর হয়ে যেত। সেই সময় স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায় দিনই আমি ও আমার ছোকরা বন্ধুরা শোভা, রওশন, হামিদা, ইন্দিরাদের স্কুল শেষ করে একই রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরতে দেখতাম তাকিয়ে তাকিয়ে।
কয়েক বছর হলো, ছেলেমেয়ে উভয়ের ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে পড়াশোনার জন্যই প্রায় এক মাইল ব্যবধানে আলাদা আলাদা স্কুলঘর তৈরি হয়েছে। আগের সেই স্কুল ঘরটি যেখানে আমরা ছেলেমেয়েরা সবাই পড়াশোনা করেছি, অবিকৃত রেখে নতুন নতুন কিছু স্থাপনা যোগ করা হয়েছে। এটাই মেয়েদের স্কুল, ক্লাস ওয়ান থেকে টেন। কিছুটা বাড়তি জায়গা কিনে খেলার মাঠটিকে আরও বড় করা হয়েছে। আর এই মাঠেরই একপাশে একটি পুকুর কাটা হয়েছে। ক্লাস ওয়ান থেকে ফোরের ছাত্রীদের সাঁতার শেখানো হয় সপ্তাহে এক দিন।
আর ছেলেদের জন্য নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। আমার নিজের ৯ বছরের ছেলে সমবয়সী পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সাতসকালেই সে স্কুলে চলে যায়। যদিও আমি নিজে মধ্যগগণে সূর্য উঠলে তবেই স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করতাম। স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে স্বাড়ম্বরে স্নান সারতাম আর কি। দ্বিপ্রহরের খাদ্যগ্রহণ করে বা খালি পেটে স্কুলের দিকে পা ফেলতে দুপুর ১২টা বেজে যেত। যেদিন স্কুলে যাওয়ার আগে খাবার থাকত ঘরে, পুকুরে স্নান করে উঠানে এলেই মাকে খোলা রান্নাঘরের ভেতর দেখতে পেতাম, খাবার জোগাড়যন্ত্রে। তা গরম ভাত, পান্তা ভাত, কড়কড়ে ভাত, আমমুড়ি, চিড়ামাঠা, রুটিতরকারি যে খাবারই হোক না কেন। যেদিন স্নান শেষে এসে মাকে বাড়িতে কোথাও দেখা যেত না, রান্নাঘরের দরজার ওপরের দিকের শিকল টেনে দরজা থাকত বন্ধ, সেদিন স্কুলে একটু তাড়াতাড়িই যাওয়া হতো। কেননা বুঝতে পারতাম খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেনি মা। সেসব বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার দূরত্বটা একটু বেশি মনে হতো কি? কী জানি, ঠিক মনে করতে পারি না আর আজকাল। স্কুলের শেষ ক্লাসগুলোতে বা ক্লাস শেষে ঘরে ফেরার পথে আমার তখন পেট আর মুখগহ্বরে অন্য এক ধরনের অনুভূতি হতো কি না, তাও ভেবে পাই না। তবে ঘরে ফিরে এসে অপেক্ষারত মায়ের সঙ্গে বসে একত্রে দুপুরের খাবার খেতে খুব ভালো লাগত। খেতে খেতে বিকেল ৫টা সোয়া ৫টা বেজে যেত। সেসব রাতে আরও একবার খাবার প্রশ্ন থাকত না।
সেই সময়ের চৌচালা ঢেউটিনের স্কুলঘরটি ছিল আমাদের বাসা থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে। সকালের বদলে দুপুরে স্কুল শুরু হওয়া আর স্কুলের দূরত্ব ২ মাইল পশ্চিমে হওয়া আমার জন্য মস্ত বড় একটা সুবিধা এনে দিয়েছিল। প্রতিবেশী কাকা সাইফুদ্দীনের জমিজমার পরিমাণ নিতান্ত অল্প নয়। তারপরও প্রতিদিন তিনি দিন মজুরদের সঙ্গে সারা দিন কাটাতেন তার ফসল খেতের দেখাশোনা করতে। বিকেল আর খুব সকালটা ছাড়া পুরো দিনই সাইফুদ্দীন থাকতেন তার প্রিয় আখের জমিনে, যেটা পড়ত আমাদের স্কুল চত্বরে ঢোকার আগে আগেই।
শিশুকাল থেকেই পিতৃহীন আমি। মা আর বিয়ে করেনি, বাপের বাড়িতেও ফিরে যায়নি। সাইফুদ্দীন কাকা ও রাশেদা কাকির কৃপায় নিয়মিত স্কুলে গিয়েও সামান্য উপার্জনের একটা ব্যবস্থা হয়েছিল আমার। কাজটা মোটেও কঠিন বা সময়সাপেক্ষ নয়। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে গামছা দিয়ে বাঁধা দুপুরের খাবারটা রাশেদা কাকির কাছ থেকে নিয়ে সাইফুদ্দীন কাকাকে তার খেতে পৌঁছে দিতে হতো। বিনিময়ে রাশেদা কাকি তার বিধবা সইকে অর্থাৎ আমার মাকে দুই কেজি চাল ও এক কেজি খেসারি ডাল ও আধা কেজি মসুরের ডাল দিত প্রতি মাসে। সেই সময় গ্রামে বিশেষ করে মহিলাদের রোজগারের তেমন ব্যবস্থা ছিল না। বাসন মাজা, উঠান লেপা, কাপড় ধোয়ার কাজও নিয়মিত জুটত না। চাইলেও মা মাসের প্রয়োজনের টাকা রোজগার করতে পারত না।
প্রচণ্ড রৌদ্র থেকে নিজেকে আড়াল করতে ছাতাটা মাথার ওপরে বিছিয়ে মধ্য কদমে হেঁটে স্কুলে এলেও টের পাই ইতিমধ্যেই ঘাড়ে, গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই ঘাম পাঞ্জাবির নিচে পরিহিত গেঞ্জিটা ভেদ করে নতুন লাঞ্জাবিটা ভিজিয়ে না দেয় ততক্ষণ ভাবনা নেই। তা না হলে একটি অস্বস্তিকর দৃশ্যের অবতারণা হবে বা হতে পারে, যা আমি একেবারেই চাই না। ঘামে ভেজা প্যাচপ্যাচে শরীর নিয়ে কোনো শুষ্ক ব্যক্তির পাশে দাঁড়াতে সংকোচ হয় আমার। একসঙ্গে কাজ করি বা একই গ্রামে থাকি, এটা কোনো গ্রাহ্য যুক্তি নয়, যা দিয়ে কেউ কারও গায়ের অবাঞ্ছিত গন্ধ অন্যকে শুঁকতে বাধ্য করতে পারে। এসব বিষয়ে একটু সচেতন থাকার চেষ্টা করি।
স্কুল চত্বরে ঢুকে আজ প্রথমেই আমি অফিসঘরের দিকে যাই না। ভিন্ন কিছু করণীয় আছে বলেই হাতে কিছুটা সময় নিয়ে একটু আগেই বাড়ি থেকে রওনা হয়েছি আজ।
এবার লম্বা লম্বা কদমে হলঘরের দিকে পা বাড়ালাম। সেখানে তখন ইতিহাসের শিক্ষক নাজমুল করিম স্যারের বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন চলছিল। আজ বিকেল ৪টায় সেই সভা। ঘরে ঢুকে মেঝের ওপর চোখ পড়তেই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক নাজমুল করিমের বিদায় সভায় তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এবং অনুষ্ঠানে নতুনত্ব ও নান্দনিকতা আনতে ছেলেরা এবার ঠিক করেছিল সব হলঘরের সজ্জা ও মালা তৈরি হবে জাতীয় ফুল শাপলা দিয়ে। এর জন্য তাজা শাপলা ফুল জোগাড় করতে খুব ভোর থেকে নেমেছিল ওরা। বেশি দূরে যাওয়ার দরকার হয়নি। ছেলেদের স্কুলসংলগ্ন পুকুর ছাড়াও মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথে দীঘির মতো সেই মস্তবড় পুকুরটাজুড়েই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে আছে লাল, সাদা, হলুদ সবুজের অসংখ্য শাপলা ফুল। এই দুই পুকুর থেকেই বেশির ভাগ ফুল সংগ্রহ করতে পেরেছিল তারা।
সেই দীঘির মতো বিশাল পুকুরঘাট, শাপলাপুকুর বলে সাত গাঁয়ে যার পরিচিতি, বড় চেনা, বড় আপন আমার। কোথায় যেন আমার নাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে এর।
হলঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসি একধারে। বেশ কিছুক্ষণ খালি সিমেন্টের ওপর পড়ে থাকা অবহেলিত শাপলা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। লক্ষ করি, এত যে গরম আর রৌদ্র যা শাপলাগুলোকে সম্পূর্ণ ম্রিয়মাণ করে দিয়েছে, তার জন্য উল্টো পাশের দেয়ালের হুট করে খোলা দুই পাল্লার বিশাল জানালাটিই বেশি দায়ী। রৌদ্র সেই খোলা জানালা দিয়ে সোজা এসে পড়ছে সংগৃহীত সব শাপলা ফুলের ওপর। এই সাধারণ ব্যাপারটি কেউ লক্ষ করেনি আজ সারা সকাল-দুপুর এখানে বসে কাজ করছে যারা। এটা ভেবে মনে মনে রাগান্বিত বোধ করি বৈকি। তারপরও কাউকে কিচ্ছু না বলে সবাইকে ডিঙ্গিয়ে হলঘরের ওপাশে গিয়ে দেয়ালের মাঝখানে যে লম্বা জানালা, তার দুটো পাটই বন্ধ করে দিই। স্তরে স্তরে রাখা ফুলগুলোর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখি ফুলগুলো শুধু নেতিয়ে পড়েছে তাই নয়, নিচের দিকে রাখা বেশ কিছু ফুল নিজস্ব রং হারিয়ে রোদের তেজ আর তীব্রতায় ইতিমধ্যেই বাদামি হতে শুরু করেছে। আরও নিচের দিকে কয়েক স্তরের ফুলগুলোর পাপড়ি একেবারে গাঢ় বাদামি হয়ে পাতলা হয়ে গেছে, বোঁটা থেকে খসে পড়ার আগে যেমন হয়। সরাসরি রৌদ্রের তীব্রতা বা পারিপার্শ্বিক উষ্ণতায় নরম শাপলা ফুল এমনি আধাসেদ্ধ হয়ে যায় এ সত্য আজকে নয়, আগে থেকেই জানতাম। অথচ এখনো মঞ্চসজ্জা শুরুই হয়নি। অনুষ্ঠান শুরু হতে সাড়ে তিন ঘণ্টা বাকি।
বাদামি বিবর্ণ পাপড়ির শাপলা ফুলগুলো দেখে বহু বছর আগের একটা স্মৃতি বিদ্যুতের মতো মাথায় চকিতে খেলে যায়। এই গ্রীষ্মে, দারুণ গরমে আর আর্দ্রতায় শরীরের ঘামাচিগুলো যখন চুলবুলিয়ে উঠেছে, তখন হঠাৎ অনেক দূরের কোনো এক বিন্দু থেকে, কখনো মনে হয় শরীরের ভেতরেই কোনো বিশেষ স্থান থেকে মুহূর্তের জন্য একটা তীব্র শীতের শিহরণ এসে গা কাঁপিয়ে দেয়। কেবল এক মুহূর্তের জন্য। মনে পড়ে দীঘির মতো বড় পুকুরঘাটের সেই নানা রঙের শাপলার কথা, যে দীঘি আজও একই রকম, একই জায়গায় অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে। আমাকে কেবল আর প্রতিদিন যেতে হয় না সে পথ দিয়ে। কেননা আমি এখন ছেলেদের স্কুলে পড়াই। সে পথ অন্যদিকে। অথচ সেদিন সদ্য রাঁধা ধোঁয়া ওঠা গরম ঢেঁকিছাঁটা লাল চালের ভাতের সঙ্গে ছোট ছোট পুঁটি মাছের ঝোলের সুবাস আমাকে কেমন মাতোয়ারা করে তুলেছিল। গন্ধে অর্ধভোজন, প্রবাদ বাক্যটি বহুবার শোনা সত্ত্বেও সেদিন আমার কাছে ওটাকে ভুল মনে হয়। খালি পেটে প্রিয় খাবারের সুবাস বা পরিচিত ঘ্রাণ নাকে এলে অর্ধভোজন হবে দূরে থাক, চলমান ক্ষুধাকেই আরও উচ্চকিত করে। কথাটা মনে আসতেই হঠাৎ খেয়াল হয়, তার মানে কি তখন পর্যন্ত খাদ্যে আগ্রহ ছিল আমার? আমারও খিদে পেত আর অন্য সবার মতোই, যা পরে কি না কর্পূরের মতোই উড়ে গিয়েছিল!
যা বুকের গভীরে এক অন্ধ কুঠুরিতে আবদ্ধ ছিল এত দিন, যে এক টুকরো স্মৃতিকে পাটাপুতোয় করে পিশে, বেটে খেয়ে তার সম্পূর্ণ অস্তিত্ব বিলীন করে দিতে চেয়েছিলাম, আজ দিবালোকে দেখা দৃশ্যাবলির সঙ্গে সেসব একের পর এক চোখে ও মনে ভাসতে থাকে আমার। সবকিছু উলট-পালট করে দেয়া সেই দিনটির কথা, গোটা জীবন পাল্টানো সেই মঙ্গলবার সকালের কথা গভীর থেকে আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে যেন।
সেই সকালেও কাকভোরে ঘুম ভেঙেছিল আমার। আগের দিন রাতেও ঘরে খাবার তেমন কিছু ছিল না। এক টুকরো পেঁয়াজ আর একটি কাঁচামরিচ ডলে এক বাটি শুকনো মুড়ি খেতে দিয়েছিল মা। আর মা নিজে এক বড় পিতলের গ্লাসে দুধ-চিনি ছাড়া গরম জলে রাশেদা কাকির দেয়া একটুখানি চায়ের পাতার গুঁড়া আর একটা আস্ত লেবুপাতা ভিজিয়ে ধীরে ধীরে পরম তৃপ্তিসহকারে তা পান করছিল।
পরদিন সকাল। স্কুলে যাওয়ার জন্য স্নান সেরে ঘরে ফিরে আবার মাকে কোথাও খুঁজে পাই না। রান্না ঘরে শিকল দেয়া। তার মানে আজও অভুক্ত অবস্থায় স্কুলে যেতে হবে। খাদ্য সংগ্রহ এখনো সম্ভব হয়নি মায়ের।
শুধু শুধু আর দেরি না করে স্কুলের বই-খাতা-পেনসিল নিয়ে রাশেদা কাকির কাছে আসি সাইফুদ্দীন কাকার দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে। খাবার তৈরিই ছিল। রাশেদা কাকি বলল, ‘পারলে আজ একটু তাড়াতাড়ি যাস বাবু। তোর কাকা আবার টাটকা পুঁটি মাছের গরম ঝোল দিয়ে ভাত খেতে খুব ভালোবাসে।’
রাশেদা কাকিকে নিশ্চিন্ত করে গামছায় বাঁধা খাবার নিয়ে রওনা হই; কিন্তু যেতে যেতে ডান হাতে ঝোলানো খাবারের সানকির ফাঁক দিয়ে উষ্ণ বাষ্পের সঙ্গে এক মনমাতানো গরম লাল চালের ভাতের গন্ধ এসে আস্তে আস্তে নাকে লেগে আমাকে বিমোহিত করে দেয়। আমার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয় না সোজা রাস্তা ধরে পা ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া। একটুখানি আড়াল খুঁজতে চৌধুরীবাড়ির টগর বাগানে ঢুকে পড়ি। কোনোমতে লাল গামছাটা একটু ফাঁক করে একবার দেখতে চাই। গামছার ভেতরে কালো সানকির ঢাকনাটা একটু সরাতেই এক রাশ গরম ভাতের উষ্ণ বাষ্প এসে চোখেমুখে লাগে। বেলা ১২টা বেজে গেছে। দ্বিপ্রাহরিক সূর্যের প্রচণ্ড তেজ আর প্রখর আলো আমার দৃষ্টিকে ধাঁধিয়ে দেয়। মহামূল্যবান সোনা, হীরা, জহরতের মতো সানকির ভেতরের সবকিছু তীব্রভাবে জ্বলজ্বল করছে যেন। দৃষ্টি প্রখর আর একত্রিত করে আরও ভালোভাবে তাকাতেই চোখে পড়ে লাল ভাত, ভাজা পেঁয়াজসহ ছোট ছোট সাত-আটটি পুঁটিসহ মাছের ঝোল, বেগুন ভর্তা ও একটি লম্বা সবুজ কাঁচামরিচ। আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে।
সূর্যের প্রচণ্ড ও সরাসরি তেজে আমি কোনো কিছুই যেন আলাদাভাবে দেখতে পাই না। সবকিছু থেকেই যেন এক প্রচণ্ড উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে চলে। আলোর সেই মহা প্লাবণ আমার চোখ দুটোকে জ্বালিয়ে দেয়। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। লালভাত থেকে এখনো উষ্ণ ধোঁয়া উঠছে। কোনো কিছু ভাবার আগেই গামছার ফাঁক দিয়ে ডান হাতের কয়েকটি আঙুল ঢুকিয়ে তাড়াতাড়ি আধ মুঠো ভাতের সঙ্গে একটা ছোট্ট পুঁটি মাছ তুলে সরাসরি মুখে পুরে দিই। লাল ঢেঁকিছাঁটা চালের ভাতের সঙ্গে স্বাদে পার্থক্য কী আমাদের খাওয়া প্রতিদিনের মোটা চালের ভাতের, কিছুই বুঝে উঠতে পারি না অত সামান্য পরিমাণের দলা এত দ্রুত গিলে ফেলার জন্য; কিন্তু টের পাই বুক ও পেটের মারাত্মক ওঠানামার এতটুকু সুরাহা হয়নি। আর ততক্ষণে অন্য একটা অনুভব, একটা প্রবল আশঙ্কা, সত্যিকারের ভয় আমাকে পেয়ে বসে। টগর বাগান থেকে রাস্তায় ফিরে গিয়ে আস্তে আস্তে সানকির ঢাকনা ফাঁক করে দেখি, আমার ছোট্ট হাতে তুলে নেয়া আধমুঠো খাবার মোট খাবারের পরিমাণকে তেমন বিঘ্নিত করেনি এটা সত্য। তবে কেবল একটি জায়গা থেকে কিছুটা ভাত, একটি পুঁটিমাছ ও সামান্য ঝোল সরে যাওয়া ওই জায়গাটিকে পাখির ঠোকরের মতো কিছুটা অসমান ও বেখাপ্পা দেখাচ্ছে। রাস্তার ডান দিকের এই চৌধুরীদের ফুলের বাগান পার হয়ে একটু এগুলেই হাতের বাঁ দিকে দীঘির মতো সেই বিশাল শাপলাপুকুর। বরাবরের মতো সেদিনও পুকুরভরা নানা রঙের শাপলাফুলের সমাহার।
মাঝেমধ্যে দৃষ্টি জুড়ানোর জন্যই বুঝি দীর্ঘ ও গোলাকার ফিনফিনে কিছু শ্যাওলা রঙের শাপলাপাতা ভেসে আছে জলের ঠিক ওপরের স্তরে ফুলগুলোর শোভা বাড়িয়ে। আমি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে পুকুরঘাটে গিয়ে হাতের নাগালে পাওয়া শাপলার দাম থেকে দ্রুত দুটি পরিপুষ্ট শাপলা ফুল এনে পাখির ঠোকরের মতো অসমান ভাতের অংশটিতে ভালোমতো গুঁজে ঢেকে দিই। নিজের শিল্পকর্মে নিজেই স্মিত হাসি। তারপর দেরি না করে তাড়াতাড়ি মাঠের দিকে দৌড়াই। সাইফুদ্দীন কাকা সেদিন খাবারের জন্য সত্যি অপেক্ষাই করছিলেন মনে হয়। নিজে রাস্তায় এসে আমার হাত থেকে খাবার নিয়ে যান।
সারা বিকেল, সন্ধ্যা কেটে যায় অদৃশ্য এক ভয়ে। অজানা এক শঙ্কায়। তবু খেলার মাঠ থেকে ফিরে এসে হাত-পা ধুয়ে যথারীতি পড়তে বসি। সন্ধ্যার একটু পরে হ্যারিকেন হাতে সাইফুদ্দীন কাকা ও রাশেদা কাকি আসেন আমাদের বাসায়। এই বাড়িতে এটাই তাদের প্রথম আসা নয়। তাই কেউ অবাক হয় না; কিন্তু আমি কেমন পিপাসার্ত বোধ করি। জগ থেকে অনেকগুলো জল একত্রে গড়িয়ে খাই। কোনো বিশেষ কাজের কথা ছিল তাদের মনে হয় না। তবে যাওয়ার আগে কেন জানি এই মাসে তিন দিন আগেই আমাদের চাল, ডাল সব দিয়ে যান। সঙ্গে বাড়তি এক কেজি মাসকলাই ডাল। এই বছরেই প্রথম কলাই চাষ করেছেন সাইফুদ্দীন কাকা। তাই প্রথম ফসল সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খেতে চান। মার জন্য রাশেদা কাকি জর্দা দেয়া একটি পান সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল যেমন করে আনে অন্যান্য সময়।
ঘর থেকে বেরিয়ে দরজার কাছে এসে সাইফুদ্দীন চাচা একটু থামেন। স্মিত হাসিমুখে পেছনে ফিরিয়ে দুটি শাপলা ফুল দিয়ে তৈরি আমার আজকের শিল্পকর্মের প্রশংসা করেন। যা বলেন, তার অর্থ হলো, ফুলগুলো খাবারটিকে শুধু সুদৃশ্যই করেনি, গরম ভাত আর টাটকা মাছের ঝোলের সঙ্গে ভাঁপা লাল রঙের শাপলাফুল খেতেও বেশ লেগেছে। ‘অনেকটা মাংসের সঙ্গে সালাদের মতো।’ সাইফুদ্দীন কাকা হাসেন। সঙ্গে মৃদু হেসে তাকে সায় দেন রাশেদা কাকি।
এদিকে আমি তো কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি খোলা দরজার পাটাতনে গা এলিয়ে। তারা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে আমি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা বড় নিশ্বাস নিই।
ওদের চলে যাওয়ার পর, মা কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। তারপর নিচু গলায় ধীরে ধীরে যা বলে তার অর্থ, অন্যের জিনিস না বলে স্পর্শ করা ঠিক নয়; দেয়া-নেয়া কোনোটাই নয়। তারা আজ শাপলাফুলের যত প্রশংসাই করুক না কেন, রাশেদার দেয়া খাবারের সানকিতে শাপলা ফুল ছিল না।
সেদিন থেকে ক্ষুধা কিংবা ভক্ষণ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী সব ধারণা ও বোধ লোপ পায়।
পূরবী বসু: কথাশিল্পী
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে