Views Bangladesh Logo

দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক: বারাহী থেকে পদ্মা, বহ্মপুত্র থেকে যমুনা

Maria Salam

মারিয়া সালাম

রাজশাহী নগরীর মাঝখান দিয়ে শহরের সবচেয়ে বড় যে নালাটা পদ্মা নদী পর্যন্ত গিয়েছে সেটা আসলে একটা নদী ‘বারাহী’। এই বারাহীই এখন শহরের সবচেয়ে বড় ড্রেন। অষ্টাদশ শতকে বৃটিশ ভূগোলবিদ রেনেলের নকশাতে দেখা যায়, উত্তর থেকে একটা নদী এসে রামপুর-বুয়ালিয়াতে বড়কুঠীর পূর্বে গিয়ে পদ্মায় মিলেছে। উনবিংশ শতকে এটাই বারাহী নামে পরিচিতি পায়। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এই নদী রাজশাহী শহর থেকে বায়া পর্যন্ত মরা নদী আর নওহাটাতে নারাহী বলে পরিচিত ছিল। বোকের নকশাতে দেখা গেছে, এই বারাহী এক সময় আত্রায়ের মান্দার বিল হয়ে রামপুর-বুয়ালিয়ার উত্তরে তের-খাদিয়ার বিল দিয়ে প্রথমে মহানন্দা এবং তারপর পদ্মায় পতিত হতো। সেসময় এটি যথেষ্ট খরস্রোতা এবং চওড়া ছিল। আর আজকের বিশাল পদ্মা এ এলাকায় এতটা বিস্তৃত ছিল না। তাহলে, পদ্মা কিভাবে বিশাল রুপ ধারণ করল আর বারাহী কিভাবে নালায় পরিণত হলো? ভূমিকম্পের ফলে।

কাজী মোহাম্মদ মিছের-এর ‘রাজশাহীর ইতিহাস’ বইয়ের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ আছে। ১৩০৪ (বাংলা সাল) অর্থাৎ ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে একটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প আসামের শিলং মালভূমিতে আঘাত হানে, যার মাত্রা ছিল ৮.৭। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’ বা ভারতের বড় ভূমিকম্প নামে পরিচিত। এই ভূমিকম্পে দেড় হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।পূর্বে দক্ষিণ লুসাই পর্বতমালা থেকে শুরু করে পশ্চিমে শাহাবাদ পর্যন্ত সমগ্র বাংলা জুড়ে এই কম্পন অনুভূত হয়েছিল। আর এই কম্পনের পরেই বা এর ফলে রাজশাহীর নবীনগর, কাঠালবাড়িযা, বশরী, হাবাসপুরসহ সমৃদ্ধ এলাকার অনেকাংশই পদ্মার বুকে বিলীন হয়ে যায়, ফলে পদ্মা ফুলেফেঁপে আরও উত্তরে বিস্তৃত হয় আর বারাহী হারিয়ে ফেলে তার নাব্যতা। অবশ্য এর কয়েকবছর আগেই ১৮৮৫ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে পদ্মা নদীর তীর দিয়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তখন নগরের বুলনপুর এলাকা থেকে তালাইমারী পর্যন্ত ১২টি সুইসগেট বা জলকপাট করা হয়। নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিনটি নদীর উৎসমুখেও জলকপাট বসানো হয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে নদীগুলোর উৎসমুখ মরে যেতে থাকে।বর্তমানে, উৎস থেকে প্রথম পাঁচ কিলোমিটারে বারাহীর কোনো অস্তিত্ব নেই আর বাকি ১৫ কিলোমিটারের মতো অংশটুকু আজ নালায় পরিণত হয়েছে।

সেই ১৮৯৭ এর ভূমিকম্প শুধুমাত্র যে পদ্মা আর বারাহীকেই পাল্টে দিয়েছে তা নয়। কম্পনের প্রভাবে ময়মনসিংহ ও শেরপুর অঞ্চল ৫০ ফুট উঁচু হয়ে যাওয়ায়, ব্রহ্মপুত্রের স্রোত আরও ঘুরে গিয়েছিল অপেক্ষাকৃত ঢালু অঞ্চলের যমুনার দিকে। এবং ব্রহ্মপুত্রে দেখা দেওয়া সুনামিতে ভেসে গিয়েছিল গোয়ালপাড়া শহর। এই ভূমিকম্পের ফলে পুরা বাংলাদেশের যে ক্ষতি হয় তা অকল্পনীয়।

সেদিন ছিল ১৮৯৭ সালের ১২ জুন, ১০ মুহাররম, হিজরি ১৩১৫ অর্থাৎ পবিত্র আশুরা। চারদিকে চলছিল তাজিয়া মিছিল, এরকম একটা তাজিয়া মিছিলে অংশগ্রহণকারী একটা দল আতংকে আশ্রয় নেয় রাজশাহীর বিখ্যাত বাঘা মসজিদের ভেতরে। তাদের উপরে ছাদের কিছু অংশ ভেঙে পড়লে দুইজনের মৃত্যু হয়, আহত হন আরও অনেকেই।

‘রাজশাহীর ইতিহাস’ বইয়ের প্রথম খণ্ড থেকে জানা যায়, তৎকালীন রাজশাহী জেলার অধিকাংশ রাজা জমিদারদের পাকা বাড়ী ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। নাটোর ও রাজশাহী শহরের বহু স্থাপনা এবং ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল, এমনকি নীল ও রেশম কুঠিগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুঠিয়া এবং নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজবাড়ি, বড় বড় কুঠি, সাহেবদের ঘোড়ার আস্তাবল এসব অনেক স্থাপনা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং দেয়াল চাপা পড়ে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সরকারি বিবরণে বলা হয়, ৯ জনের মৃত্যু হয় ও ৬৫ জন আহত হয়।

এই ভূমিকম্পে রাজশাহী শহরের সরকারি, বেসরকারি বহু গুরুত্বপূর্ণ ভবন এবং সংগ্রহশালা ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার ফলে প্রাচীন অনেক নথিপত্র নষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় সরকারি বিল্ডিং- জজকোর্ট, কালেক্টরী, রেকর্ড রুম, সার্কিট হাউস, পুলিশ ব্যারাক, জেলখানা, পোষ্টঅফিস, কলেজ বিল্ডিং এবং মতিহার-কাজলা-শাহাপুর, খোজাপুর এসব এলাকার কুঠিগুলি ক্ষতির মুখে পড়ে। সরকারি বিবরণে উল্লেখ করা হয় যে দেড় লক্ষ টাকার সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে। তবে, বেসরকারি স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতির কোন হিসাব জানা যায়নি।

ভূমিকম্পের প্রভাবে পুরা জেলার বিভিন্ন স্থানে মাটি ফেটে রাশি রাশি বালি উঠে স্তূপীকৃত হয়। রাস্তাঘাট এমনভাবে ফেটে যায় যে, কিছুদিন যাবৎ কোনকোন রাস্তা দিয়ে যান চলাচল একদম বন্ধ ছিল। এমনকি আত্রাই ও কণ্ঠাল রেলওয়ে ব্রিজ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ফলে বেশ কয়েকদিন রেল চলাচলই বন্ধ ছিল। এছাড়াও জেলার বহু সাঁকো আর কালভার্ট ভেঙে অনেক রুটে দীর্ঘদিন ধরে যান চলাচল বন্ধ ছিল। রাজশাহী শহর, নাটোর ও নওগাঁ জেলার অনেক বাড়ির উঠানের মাটি ফেটে পানি আর বালু উঠে এবং অসংখ্য বড় বড় বৃক্ষ উপড়ে পড়ে।

কোথাও কোথাও চাষের জমিতে আধামাইল দীর্ঘ ফাটল দেখা দেয়। এসব ফাটলের প্রস্থ ছিল নয়-দশ ফিট। ফাটল থেকে কাদা-পানি, বালু আর পানি উঠে অনেক শস্যক্ষেতের উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়।

১৯২৩ সালের ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার পাবনা’য় বর্ণিত আছে, এই ভূমিকম্পে সিরাজগঞ্জে উপবিভাগীয় অফিসের উপরের তলা, কারাগার, ডাকঘরসহ নানা স্থাপনা ধ্বংস হয়। অ্যান্ড্রু ইউল অ্যান্ড কোং এর পাটের ব্যাগের ফ্যাক্টরি ধূলিসাৎ হয়ে যায় এই ধাক্কায়। ফলে কোম্পানিটি তাদের ব্যবসাই গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পাবনার কোর্ট হাউজসহ অন্যান্য ইটের স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূপৃষ্ঠের নানা স্থানে চির ধরে, অনেক কূয়া পরিপূর্ণ হয় ভূ-তল থেকে উঠে আসা পলিমাটি আর বালিতে। দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দিরের নবরত্ন চূড়া ওই ভূমিকম্পে ভেঙে গিয়ে বর্তমান ‘বোঁচা’ আকার ধারণ করে।

‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার চিটাগাং’ থেকে জানা যায়, এই ভূমিকম্পের স্থায়ীত্বকাল ছিল জায়গাভেদে ছয় সেকেন্ড থেকে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত। চট্টগ্রামে স্থায়ী ছিল সবচেয়ে বেশি সময় ধরে। দ্য গার্ডিয়ান এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমিকম্পের পর ‘আফটার শক’ বা পরাঘাত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলেছিল। ‘আসামের একটি চা বাগানে টেবিলের ওপর রেখে দেওয়া এক গ্লাস পানি ভূমিকম্প-পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত কাঁপছিল। একবারের জন্যও থামেনি’।

‘ইস্টার্ন বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গ্যাজেটিয়ার ঢাকা’র তথ্য মতে, এই ভূমিকম্প ঢাকা শহরের অনেক উল্লেখযোগ্য স্থাপনার ক্ষতিসাধন করেছিল। ভূমিকম্পটির উৎস মেঘালয়ের ৫০০ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেড় লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ‘ম্যাসনরি’ বা ইট-পাথর-সিমেন্টে নির্মিত সমস্ত স্থাপনা ভেঙে পড়েছিল। ঢাকায় আহসান মঞ্জিলের গম্বুজ ভেঙে পড়ায় আতঙ্কিত নবাব পরিবার মঞ্জিলের সামনের চত্বরে কিছুদিনের জন্য তাঁবু টানিয়ে বসবাস করেছিল বলে জানা যায়। তবে শুধু সিলেট জেলাতেই মৃতের সংখ্যা ছিল ৫৪৫। তখনকার হিসাবে পূর্ব বাংলায় শুধু অর্থ-সম্পত্তির ক্ষতিই হয়েছিল প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

২০০১ সালে নেচার ম্যাগাজিনের গবেষণা নিবন্ধ অনুযায়ী, শিলং মালভূমির ২০ মাইল গভীরে ৭৮ মাইল দীর্ঘ একটি ‘ঘুমন্ত চ্যুতি’ রয়েছে। এর আবিষ্কারক আর. ডি. ওল্ডহ্যামের নামে এই চ্যুতিকে ‘ওল্ডহ্যাম ফল্ট’ নামকরণ করা হয়। এই চ্যুতি জেগে ওঠায় সেদিন সেই প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হয়। আশংকার বিষয় হলো, ওল্ডহ্যাম চ্যুতি গত এক শতাব্দীতে আরও দক্ষিণে, অর্থাৎ বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়েছে। ১৮৯৭ সালের মতো আরেকটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প হতে পারে রংপুর অঞ্চলে। তবে যেহেতু ওল্ডহ্যাম চ্যুতি প্রতি তিন হাজার বছরে একবার জেগে উঠতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে এরকম ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ