Views Bangladesh Logo

বিশ্ব আইন ব্যবস্থা ও বাংলাদেশ

প্রত্যেক দেশের আইন ব্যবস্থায় নিজস্ব কিছু সক্রিয়তা রয়েছে। প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব রূপে এবং স্বাধীনভাবে তাদের কৃষ্টি,সংস্কৃতি,প্রকৃতি ও প্রয়োজনীয়তার ওপর নির্ভর করে Legal system (আইন ব্যবস্থা) প্রণয়ন করে থাকে। এটা স্বীকৃত যে, প্রত্যেক দেশ আইন ব্যবস্থা ব্যতীত প্রাণহীন দেহ। যা কোনো রকম কার্য সম্পাদন করতে পারে না। বিভিন্ন দেশে আইন ব্যবস্থার অভ্যুদয়ে বিভিন্ন উপাদানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন: প্রথা,ধর্ম,আদালত ইত্যাদি। এ কারণেই বিভিন্ন আইনের প্রকাশভঙ্গি বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন রকমের এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের আইনের উপাদান সমূহের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান।

বিভিন্ন রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় আইনের অর্থনৈতিক,সামাজিক, রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থা সমূহকে একটা নির্দিষ্ট আইন ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা যায়। অনুরূপভাবে, পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের আইনের ব্যবস্থাগুলোকে আইনের প্রকৃতি, বিষয়বস্তু, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতিমালা আদর্শগত অভিন্নতা এবং কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কয়েকটি আইন ব্যবস্থার আলোকে একটি নির্দিষ্ট গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে। এরূপ প্রত্যেকটি গ্রুপ এক-একটি প্রধান আইন ব্যবস্থা বা আইন পরিবার হিসেবে পরিচিত। Rene David & Brierly এর মত অনুসারে, বর্তমান বিশ্বে প্রধানত চার ধরনের আইন ব্যবস্থা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে পাঁচ ধরনের আইন ব্যবস্থা বিদ্যমান:

১. The Civil Legal System (সিভিল আইন ব্যবস্থা)-এ আইন ব্যবস্থা মূলত রোমান আইন ব্যবস্থা৷ বিশ্বের আদি ও প্রথম আইন ব্যবস্থা। রোমান আইন হলো এই আইন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এ আইনের বৈশিষ্ট্য; (ক) এই আইন ব্যবস্থা সৃষ্টিতে জুরিষ্টের ভূমিকাই প্রধান। এই আইন ব্যবস্থা পরিচালনা ও প্রয়োগ আদালতের ওপর ন্যস্ত ছিল। খ. এর ক্রমবিকাশ সবচেয়ে বেশি ঘটে প্রাইভেট "ল"তে। গ. এ আইন সংহিতা বদ্ধকরণ, বিধিবদ্ধ আইনই এ ব্যবস্থার প্রধান উৎস। বর্তমানে ফ্রান্স, জাপান, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, সাউথ আফ্রিকা, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকাতে এ আইন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।

২. The Common Legal System (কমন আইন ব্যবস্থা)-এ আইন ব্যবস্থা হচ্ছে ইংল্যান্ডের আইন ও সে সমস্ত দেশের আইন নিয়ে গঠিত, যারা ইংলিশ আইনকে ভিত্তি করে তাদের আইন গঠন করেছে। এর উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ ভিন্ন উপায়ে ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে সাধিত হয়েছে। এ আইনের বৈশিষ্ট্য: ক. মাননীয় বিচারক মূলত এই আইন ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছেন। খ. এ আইন ব্যবস্থা বিভিন্ন পদ্ধতিগত আইনের (Procedural Law) উপর গুরুত্ব আরোপ করে। গ. এ আইন ব্যবস্থায় precedent বা নজির এর শক্ত অবস্থান রয়েছে। ঘ. এর উৎপত্তি ইংল্যান্ডে এবং এ আইন ব্যবস্থায় ত্রিমুখী রূপ লক্ষ্য করা যায়। যেমন:

১. Common Law যা প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য। ২. Equily Law যা দ্বারা উৎসের সংযোজন ও সংশোধন করা যায়। ৩. Statutory Laws অর্থাৎ Parliament কর্তৃক লিখিত আইন। এই ব্যবস্থাই পরবর্তী ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ স্থাপনের মাধ্যমে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে Common legal system ইংল্যান্ড, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, পাকিস্তান, বার্মা, ফিলিপাইন, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড বিভিন্ন দেশে প্রচলিত।

৩. The Soviet Legal System (সমাজতান্ত্রিক আইন) এ আইন ব্যবস্থা ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর কমিনিস্টদের চিন্তাধারা থেকে সোভিয়েত রাশিয়াতে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক আইনের উদ্ভব ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অন্যতম আইন ব্যবস্থা হিসেবে এই আইন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় চিন্তা-ধারা থেকে এই আইন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এ আইনের বৈশিষ্ট্য: ক. সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং মার্কস ও ল্যালিনের মতামতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ বিচার ব্যাবস্থায় অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহে আগে সিভিল আইন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এ আইন ব্যবস্থায় তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, পরবর্তীতে এটিকে সংশোধন করা হয়। খ. এ আইনে রোমান ও জার্মান আইনের প্রভাব রয়েছে। এ আইন ব্যবস্থার মৌলিকত্ব হচ্ছে এর জন্ম হয় রাষ্ট্র বিকাশের মাধ্যমে। গ. এ আইনে রাষ্ট্র ও আইনকে অভিন্ন করে দেখা হয়। এ আইনের উৎস হলো জনগণের ইচ্ছা। বর্তমানে চায়না, মঙ্গোলিয়া, উত্তর ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া, বুলগেরিয়া, পশ্চিম জার্মানি, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ইয়ুগস্লাভিয়েতে এ আইন ব্যবস্থা প্রচলন রয়েছে।

৪. The Philosophical or Religious Legal system (দার্শনিক বা ধর্মীয় আইন ব্যবস্থা)- বিশ্বের কোন কোন রাষ্ট্রে ধর্মীয় ও দার্শনিক আইন প্রচলিত রয়েছে। যেমন: মুসলিম আইন, হিন্দু আইন, ইহুদিদের আইন ইত্যাদি। এসব আইনের মূল ভিত্তি হল যার যার পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ। মুসলিম আইন: এ আইন মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য এ আইন ব্যবস্থা আরবের দেশসমূহে, বাংলাদেশ, উত্তর ও মধ্য আফ্রিকা,পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহে ও ইস্ট ইন্ডিজে প্রচলিত আছে হিন্দু আইন: এ আইন ব্যবস্থা হিন্দুদের জন্য প্রযোজ্য। এ আইন ব্যবস্থা ভারত, বাংলাদেশ বা হিন্দুরা যে অঞ্চল বা দেশে বাস করে সেখানে প্রচলিত আছে। ইহুদি আইন: এ আইন ইহুদিদের জন্য প্রযোজ্য। এ আইন ব্যবস্থা ইসরায়েলে প্রচলিত আছে।

৫. The Primitive Legal System (আদিম বা প্রাচীন আইন ব্যবস্থা)-আদিম আইনের মূল ভিত্তি হলো প্রাচীন প্রথা বা রীতি। এটি সাধারণত অনগ্রসর জনগণের জন্য প্রযোজ্য। এ আইন ব্যবস্থা সাউথ আফ্রিকা,ভারতীয় মহাসাগরীয় অঞ্চল ও এশীয় উপজাতিদের জন্য প্রযোজ্য। বর্তমান বিশ্বে "সিভিল আইন" ব্যবস্থা ও "কমন আইন" ব্যবস্থা অধিক প্রচলিত। এ জন্য এ দুই ব্যবস্থায় আদালতের ভূমিকা জানা খুবই জরুরি। তাই "সিভিল আইন" ব্যবস্থা ও "কমন আইন" ব্যবস্থায় আদালতের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য উল্লেখ করা হলো; ১."সিভিল আইন" ব্যবস্থায় আদালতে Regular Court ও Administrative Court বিদ্যমান। অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি লোকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আদালত রয়েছে।

অন্যদিকে কমন "আইন ব্যবস্থায়" সকলের বিচার করা হয় একই আদালতে, যদিও বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চাকুরি সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য Administrative Tribunal রয়েছে। ২."সিভিল আইন" ব্যবস্থায় দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচার একই আদালতে হয়। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় দেওয়ানী ও ফৌজদারি মামলার বিচার পৃথক পৃথক আদালতে হয়। ৩. "সিভিল আইন" ব্যবস্থায় মামলার প্রথম পর্যায়ে আপোষ মীমাংসার জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় এ ধরনের বিধিবদ্ধ আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নাই। যদিও বাংলাদেশে "আরবিট্রেশন অ্যাক্ট" রয়েছে এবং কিছু কিছু মামলায় আপস মীমাংসার বিধান রয়েছে। ৪. "সিভিল আইন" ব্যবস্থায় প্রত্যেক কোর্টে একাধিক বিচারক রয়েছেন। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় এরূপ কোনো ব্যবস্থা নেই। উচ্চ আদালত ব্যতীত একজন বিচারকই বিচারকার্য সমাধান করে থাকেন। ৫. "সিভিল আইন" ব্যবস্থায় বিচারকগণ নিজেরাই তদন্ত করে আসল ঘটনার উদ্ঘাটন করে থাকেন।

পক্ষান্তরে "কমন আইন" ব্যবস্থায় আদালতের বিচারকরা ঘটনা নির্ধারণে তদন্ত করতে পারেন না। তারা শুধু আদালতের কাজ করে থাকেন। ৬."সিভিল আইন" ব্যবস্থায় মৌলিক অধিকার বাস্তবায়নে একটি "ফেডারেশান" আদালত বিদ্যমান। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় এরকম আলাদা সাংবিধানিক আদালতের কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব দেশে সুপ্রিম কোর্টই এর দায়িত্ব পালন করে। ৭. "সিভিল আইন" ব্যবস্থায় আদালতের গঠন সহজ ও নির্দিষ্ট এখতিয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিভক্ত। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় আদালতের বিভাগ রয়েছে সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত,এখতিয়ার ও পরস্পরবিরোধী।

৮. "সিভিল আইন" ব্যবস্থায় একই কোর্টে একাধিক বিচারকের ক্ষেত্রে, কোনো বিচারক পৃথক রায় প্রদান করতে পারেন না।অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় একাধিক বিচারপতি থাকলে প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন রায় প্রদান করতে পারেন। ৯."সিভিল আইন" ব্যবস্থায় পূর্ব-দৃষ্টান্তের বিধান নেই। অন্যদিকে কমন "ল"ব্যবস্থায় পূর্ব-দৃষ্টান্তের বিধান আছে। ১০."সিভিল আইন" ব্যবস্থায় আদালত কোনো বিধিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারেন না। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় আদালত কোনো বিধিকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করতে পারেন। ১১."সিভিল আইন" ব্যবস্থায় বিচারকদের দেওয়া প্রদত্ত রায়ের যে কোনো রকম সমালোচনা করা যায়।

অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় বিচারকদের রায়ের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা যায় না। ১২."সিভিল আইন" ব্যবস্থাপনায় আইন পেশায় আইনগত প্রশিক্ষণ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অন্যদিকে "কমন আইন" ব্যবস্থায় আইনপেশার একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। যা স্বয়ংক্রিয় প্রশিক্ষণের দ্বারা প্রভাবিত। এবার দেখা যাক বাংলাদেশে কোন বিচার ব্যবস্থা প্রচলিত? পূর্বোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ব্রিটিশরা একসময় বিভিন্ন এলাকাকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করেছিল এবং সেখানে তাদের আচার-আচরণ রীতি-নীতির ওপর ভিত্তি করে তাদের আইন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে তাদের অন্যতম একটি ঔপনিবেশিক অঞ্চল ছিল এবং এখানে তারা নিজেদের মতো করে আইনসমূহ প্রণয়ন করেছিল।

এমনকি বর্তমানে বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় যে আইন বিদ্যমান তার অধিকাংশই ব্রিটিশদের সৃষ্টি এবং তা আজ পর্যন্ত বলবৎ আছে। যেমন সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২, দণ্ডবিধি ১৮৬০, দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮, সম্পত্তি হস্তান্তর আইন, ১৮৮২ ইত্যাদি। সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে কমন ল’ ব্যবস্থায় যেসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থায়ও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য যার যার ধর্মীয় ব্যক্তিগত আইন এবং ‘আরবিট্রেশন অ্যাক্ট’সহ কোনো কোনো আইনে আপস মীমাংসার বিধান রয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় আমাদের দেশে মূলত কমন আইন ব্যবস্থা বিদ্যমান। সঙ্গে সঙ্গে ‘ধর্মীয় আইন ব্যবস্থা’সহ ‘সিভিল আইন’ ব্যবস্থাও বিদ্যমান।

মো. জে আর খান রবিন: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ