Views Bangladesh Logo

নির্বাচন কমিশন এখন আসামি

ন্যায্য ও প্রহসন’-এর নির্বাচন করার অভিযোগ তুলে ২৪ জনের পদ বা নাম উল্লেখ করে মামলার আবেদন করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় জমা দেয়া মামলার আবেদনে উল্লিখিত অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনার, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, নির্বাচন সচিব, এনএসআই ও ডিজিএফআই প্রধানসহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। ইতোমধ্যে মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

এদের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগ হচ্ছে, এরা ভয়-ভীতি দেখিয়ে ভোট সম্পন্ন করেছেন এবং জনগণের ভোট ছাড়াই প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করেছেন। তিন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নাম উল্লেখ করে যেদিন বিএনপি থানায় আবেদন করেছে সেদিন রাতেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে তার উত্তরার বাসা থেকে বের করে গলায় জুতার মালা ঝুলিয়ে দেয় এবং জুতা দিয়ে মুখমণ্ডলে আঘাত করে। এই অবস্থায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং পরে আরেক সিইসি হাবিবুল আউয়ালকেও গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ।

উল্লিখিত তিনটি নির্বাচনে কী হয়েছিল তা আমাদের মতো বয়োবৃদ্ধদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। অন্ধ দলকানা নয় এমন লোকদের মতে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ইতিহাসে ২০০৮ সনের ডিসেম্বরের ২৯ তারিখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল সর্বশেষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে, আওয়ামী লীগ পায় ২৩০ আসন, বিএনপি পায় মাত্র ৩০ আসন। নির্বাচনের ফলাফল বিএনপি মেনে নেয়নি, দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলা হয়।

অভিযোগ তোলা হলেও বিএনপির মামলার আবেদনে ২০০৮ সনের নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কমিশনারদের নাম নেই, কেন নেই তার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। অথচ তখনকার নির্বাচন কমিশন খালেদা জিয়ার মূলধারার বিএনপিকে প্রথমবার সংলাপে ডাকেনি, ডেকেছিল বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সংস্কারপন্থি বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া গ্রুপের মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বর্তমান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনও তখন নির্বাচন কমিশনার ছিলেন।

বাংলাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয়বার একতরফা নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ সনে, প্রথমবার হয়েছিল ১৯৯৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করায় ২০১৪ সনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে ২০১৮ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্বাসে এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়েছিল; কিন্তু নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি, দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ায় বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পায়, যা ছিল অবিশ্বাস্য।

অনেক ভোট কেন্দ্রে একশত ভাগ ভোট পড়ে, অনেকগুলো কেন্দ্রে ‘নৌকা’ ছাড়া আর কোন প্রতীকে ভোটই পড়েনি। নানা অভিযোগ দিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিএনপি ও জোটভুক্ত দলগুলোর শতাধিক প্রার্থী দুপুরের মধ্যে নির্বাচন বয়কট করে। নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপির ৩০-৩৫ শতাংশ ভোটের কোন খোঁজই পাওয়া গেল না।

রাতের ভোট যে দিনে হয়ে গেছে তা কিন্তু বিএনপিও ধরতে পারেনি, ধরতে পারেনি বলেই এব্যাপারে অদ্যাবধি তাদের কোন লিখিত অভিযোগও নেই, অভিযোগ আছে অনিয়ম আর কারচুপির। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের পুনঃনির্বাচনের দাবি নাকচ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। ২০২৪ সনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল সম্প্রতি আদালতে যা বলেছেন, বিএনপিও একই কথা বলছে, ‘ডামি নির্বাচন’। এই নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়েত অংশগ্রহণ না করায় আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। বিএনপির অভিযোগ থেকে প্রতিপন্ন হয় এই তিনটি নির্বাচন ব্যতীত অন্য সকল নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আসলেই কী তাই !

প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার পর সর্বজন স্বীকৃত একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু হয়নি। এমন কী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোও পরাজিত রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি পায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সনে মোট তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সনের নির্বাচনে হেরে আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে দেখতে পেয়েছে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’, আর ১৯৯৬ সনের জুন মাসের নির্বাচনে বিএনপি দেখতে পেয়েছে ‘স্থূল কারচুপি’। ২০০১ সনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান সম্পর্কে আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল, ‘বিএনপি যা বলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাই করে’। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করে ভোটারদের একটা ম্যাসেজ দিতে সমর্থ হয়েছিল। যত অভিযোগই থাকুক না কেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচন জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আরও ভয়াবহ। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সনে; এই নির্বাচনে কয়েকটি আসনে বিরোধী প্রার্থীকে ভয় দেখিয়ে উইথড্র করতে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছিল; সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ১১টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। ১৯৭৭ সনে অনুষ্ঠিত হাঁ-না ভোটে জিয়াউর রহমান একাই প্রার্থী ছিলেন, ভোট গ্রহণের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররাই হাঁ ভোটের বাক্স ভরে দিয়েছিলেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটার না গেলেও ৮৮.১% ভোট কাস্ট হয়েছিলো এবং ভোট গণনায় দেখা গেল ৯৮.৯% হ্যাঁ এবং ১.১% না-ভোট। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের রিপোর্ট অনুযায়ী নির্বাচনে কোথাও কোথাও ১১০-১২০ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এরশাদ সাহেবও ১৯৮৫ সনে গণভোট করেন, সেই নির্বাচনে তিনি ৯৪.৫ শতাংশ ভোট পান। হ্যাঁ-না ভোটের ফলাফলে বিএনপি সতর্ক হয়ে যায়, ১৯৭৯ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি তাদের কয়েকজন প্রার্থীকে পরিকল্পনা করে হারিয়ে দেয়। ১৯৮৫ সনে একই কাজ করেছিলেন এরশাদ সাহেবও, নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে তিনি তার প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের ছেলে ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমানকেই উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে হারিয়ে দিয়েছিলেন- এই তথ্যটি আতাউর রহমান খান তার ‘প্রধানমন্ত্রীত্বের নয় মাস’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন। জিয়াউর রহমানের ভোটনীতি অনুসরণ করে প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের গরজ বোধ করেননি; তার আমলেও ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি, ভোট প্রদান শুরু হওয়ার এক বা দুই ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় সব ভোট কাস্ট হয়ে যেত।

১৯৮৬ সনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, ১৯৮৮ সনের নির্বাচন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল বর্জন করায় একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জয় লাভ করে। ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সনের নির্বাচন ছিল চর দখলের নির্বাচন। ১৯৯৬ সনের ফেব্রুয়ারি এবং জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অধীনে জাতীয় সংসদের দুইটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়; জুন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের কথা আগেই বলেছি। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করায় ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিএনপি ২৭৮টি আসন পায়, ৪৮টি আসনে বিএনপির প্রার্থীরা বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়। ফ্রিডম পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধুর খুনি লে, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশীদ তার দল থেকে একাই জয়লাভ করেন এবং সংসদে বিরোধী দলের নেতা হন।

১৯৯৬ সনের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। এত কম সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি লক্ষ্য করে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি একেএম সাদেক বলেন, কত শতাংশ ভোট পড়েছে তা মুখ্য নয়, মুখ্য হচ্ছে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

উপরোল্লিখিত পর্যালোচনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন হয় যে, শুধু বিএনপির উল্লিখিত তিনটি নির্বাচন নয়, আরও অনেকগুলো নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। ভোটার ছাড়া ভোট হয়েছে, বিরোধীদল ব্যতিরেকে সংসদ বসেছে। অপরাধ কি শুধু নির্বাচন কমিশন আর পুলিশ করেছে? অপরাধ রাজনৈতিক দলগুলোও করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত দলের যে সকল সাংসদ সংসদে না গিয়েও বেতন-ভাতাদিসহ সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে না? কেন মামলা হবে না ১৯৯৪ সনে বিএনপির আমলে মাগুরার উপনির্বাচনে ভোটের হরিলুটের? জিয়াউর রহমান, হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার আমলের নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে নিশ্চয়ই বিএনপি বা জাতীয় পার্টি মামলা করবে না, মামলা করার জন্য আওয়ামী লীগও নেই, মামলা করতে পারে একমাত্র জামায়াতে ইসলাম, এই দলটিই এই মুহূর্তে ভোটের মাঠে বিএনপির একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী।

নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান; সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক এর গঠন এবং ১১৯ অনুচ্ছেদে এই কমিশনের দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণ করে দেয়া আছে। নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব লোকবল নেই, সরকারের প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়; এ ছাড়াও তাদের রয়েছে নানাবিধি সীমাবদ্ধতা। তা সত্ত্বেও তারা স্বাধীন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে নির্বাচন কমিশনারদের চাকুরিচ্যুত করার ক্ষমতা সরকারের নেই, তারা শুধু সংবিধানের কাছে দায়বদ্ধ।

এতৎসত্ত্বেও যে সকল নির্বাচন কমিশন তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করেনি তাদের বিচার তো হতেই পারে, কিন্তু বিএনপির সুবিধামতো খণ্ডিত বিচার নয়, অন্যায্য ও প্রহসনমূলক সকল নির্বাচনের সঙ্গে জড়িতদের বিচার হোক। তাই বলে কুটিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য নির্বাচন কমিশনার ও বিভিন্ন সংস্থার লোকদের দায়ী করে বিচারের সম্মুখীন করা যথার্থ হবে না। ক্ষমতাসীন বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের কুটিল নীতির কারণেই বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনগুলো হয়েছে, তাই রাজনৈতিক দল বা শক্তিরও বিচার হওয়া উচিত। শেষ কথা, বলুন তো, আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধকরণের সঙ্গে তাদের নিবন্ধন বাতিলের সম্পর্ক কী ?

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ