সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবি হওয়ার নেপথ্যে
‘কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি’ কিংবা ‘অনেকদিন থেকেই আমার একটা পাহাড় কেনার শখ’ পঙক্তিগুলো শুনলে যার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতা দিয়ে তার সাহিত্য জীবন শুরু হলেও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক হিসেবে।
সুনীলের আরও কয়েকটি কবিতার পঙ্ক্তি সাহিত্যের পাঠকদের মুখে মুখে। তন্মধ্যে ‘যদি নির্বাসন দাও, আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরি ছোঁয়াবো/আমি বিষপান করে মরে যাব’ কিংবা ‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ/তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর ফুসফুস-ভরা হাসি।’ এ পঙক্তিগুলো তাকে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছে।
দুই বাংলার সাহিত্যের পাঠকদের জনপ্রিয় লেখকদের অন্যতম তিনি। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে অজস্র স্মরণীয় রচনা উপহার দিয়েছেন। এপার বাংলার হুমায়ুন আহমেদ লেখক হিসেবে যেমন তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন ঠিক একইভাবে ওপার বাংলায় সমান জনপ্রিয় ছিলেন সুনীল।
কিন্তু কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার তার তুমুল খ্যাতি হলেও শুরুটা হয়েছিল কবিতা দিয়ে। আর তার কবিতা লেখার সূচনাও হয়েছিল মজার ছলেই। ডানপিটে সুনীলকে বশে রাখতে তার শিক্ষক বাবাকে খুব বেগ পোহাতে হতো। ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর অফুরন্ত সময়। এ সময়টাতে দুরন্ত সুনীলকে আটকে রাখতে তার বাবা এক ফন্দি আঁটলেন। সুনীলের বাবা ছিলেন শিক্ষক। ছেলের হাতে তিনি তুলে দিলেন টেনিসনের কবিতার বই। তার কড়া আদেশ, প্রতিদিন একটা করে কবিতা অনুবাদ করে খাতা দেখাতে হবে।
কয়েক দিন অনুবাদ করে দেখানোর পর সুনীল খেয়াল করলেন, তার বাবা ভালো করে না পড়েই সই বা টিক চিহ্ন দিয়ে দেন। এতে তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। এবার ইংরেজি কবিতার লাইনের হিসাবের সঙ্গে মিল রেখে নিজেই কবিতা লিখতে শুরু করলেন। ওদিকে বাবাও আগের মতো ভালোভাবে না দেখেই স্বাক্ষর দিয়ে যেতে লাগলেন ছেলের খাতায়।
কিন্তু সুনীল এভাবে কাব্য লিখে কি তা কেবল পকেটে বন্দি করে রাখতে পারেন! তাই পছন্দের এক মেয়ের উদ্দেশে ‘একটি চিঠি’ শিরোনামে একটি কবিতা লিখে তিনি পাঠিয়ে দিলেন ডাকে। মেয়ের বাড়িতে পাঠানোর সাহস হলো না অবশ্য, পাঠালেন নাম করা পত্রিকা দেশ-এর ঠিকানায়।
কিছুদিন পর ১৯৫২ সালের ২৯ মার্চ সংখ্যার দেশ পত্রিকায় সুনীল কুমার গঙ্গোপাধ্যায় নামে এক তরুণের কবিতা ছাপা হলো; কিন্তু কেউই বিশ্বাস করল না, এটা ১৭ বছর বয়সী সুনীলের কবিতা। এমনকি যে মেয়েকে উদ্দেশ করে তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন, তিনি পাত্তা তো দিলেনই না, উল্টো বললেন, অন্যের কবিতা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছ বুঝি! তরুণ বয়সে এ নিয়ে খুব কষ্ট পেলেও পরবর্তী জীবনে এসব কথা খুব মজা করে বলতেন সুনীল।
ছোট, বড়- সবার সঙ্গেই রসিকতা করে কথা বলতেন এ কথাসাহিত্যিক। একবার এক আড্ডায় বিখ্যাত ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের সঙ্গে তার দেখা। তাকে সুনীল প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি বাঙালির ইতিহাস: আদি পর্ব লিখে আর লেখেননি কেন?’ নীহাররঞ্জন বললেন, ‘আমি দীর্ঘদিন জেলে ছিলাম, তখন আমার হাতে খুব সময় ছিল, তাই বইটি লিখতে পেরেছিলাম। এখন তো ব্যস্ত। তাই আর লিখতে পারছি না।’ এ সময় সুনীল যা বললেন তা শুনে হেসে উঠল পুরো মজলিস, ‘আপনাকে তবে আবার জেলে ঢোকানো উচিত। যাতে করে আপনি বাঙালির ইতিহাস পুরোটা শেষ করতে পারেন।’
বরেণ্য এ লেখক ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্ম বাংলাদেশে হলেও বেড়ে উঠেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সুনীলের বেশ কিছু গল্প-উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নিয়ে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। লালনকে নিয়ে লিখিত ‘মনের মানুষ’ উপন্যাসটি গৌতম ঘোষ চলচ্চিত্রায়ন করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লিখিত অন্যতম জনপ্রিয় উপন্যাস ‘প্রথম আলো’ থেকে নির্মিত হয়েছে ‘কাদম্বরী’ চলচ্চিত্র। এ ছাড়াও তার আরও অনেক লেখা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে।
সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ আনন্দ পুরস্কার (১৯৭২), সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৮৫), দ্য হিন্দু লিটারেরি পুরস্কার (২০১১) অর্জন করেছেন তিনি। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য আকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশু-কিশোর আকাদেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিংশ শতকের এই প্রথিতযশা ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক ২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর হৃদযন্ত্রজনিত অসুস্থতার কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার সৃষ্টির জন্যই তিনি আমাদের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন।
শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: তরুণ লেখক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে