‘খাঁচার পাখি উড়ে গেল’: বিদায় লালনকন্যা ফরিদা পারভীন
পাখি কখন জানি উড়ে যায়, কেউ টের পায় না। একটি বদ হাওয়া এসে খাঁচায় লাগলেই, তার ডানা ছুটে যায় অনন্ত আকাশে। ঠিক তেমনভাবেই চলে গেলেন লালনসংগীতের কিংবদন্তি সাধিকা ফরিদা পারভীন- যার কণ্ঠে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চিনেছে সাঁইজি লালনকে, উপলব্ধি করেছে আত্মার গান। তার চলে যাওয়ায় যেন থমকে গেছে অদৃশ্য এক সুরের ধারা। যেন আটকুঠুরি নয় দরজা ভেঙে খাঁচার পাখিটি উড়ে গেল- এবারের মতো সত্যি সত্যিই।
তিনি শুধু সংগীতশিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন পথ দেখানো এক সাধক কণ্ঠ। তার কণ্ঠে বেঁচে থাকতেন মহাত্মা লালন। তার সুরে বাজত দর্শনের নির্যাস। ব্যক্তিগতভাবে তাকে দুবার খুব কাছ থেকে দেখার, কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রথমবার খুব অল্প সময়ে হলেও শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত ‘লালন উৎসব’-এ তার সহচার্যে কিছু সময় কাটে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তখন তার অসুস্থ শরীর, ক্লান্ত মুখ, ভাঙা গলা কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছেন। তবু মঞ্চে উঠে ছোট বক্তৃতা দিলেন ভাঙা কণ্ঠে।
বক্তব্য শেষে অফিসের এসাইনমেন্ট করে ফিরতে রাত হবে বলে, গান শুরুর আগেই বের হয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় তার স্বর শুনে হঠাৎই মন যেন পেছনে টেনে ধরল, আবার ফিরে গিয়ে বসলাম। গান শুরু হতেই দেখা গেল, সেই ভাঙা কণ্ঠ আর নেই- যেন ফিরে এসেছে সেই দরাজ টানটান সুর, যা শৈশব থেকে শুনে এসেছি। সুর যেন ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। অনুষ্ঠান পেরিয়ে, সময় পেরিয়ে, রিকশার ঝিমধরা শহর পেরিয়ে... ফিরতি পথে অনেক দূর অবধি বিস্তৃত সেই সুর তখনো কানে বাজছিল… সেই চেনা কণ্ঠে গাইছেন ফরিদা পারভীন সাঁইজির-
‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার
সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার
নদী কিংবা বিল-বাঁওড়-খাল
সর্বস্থলে একই এক জল...’
ছোটবেলায় ফরিদা পারভীনকে চেনা মানে ছিল লালনকে চেনা। বাড়ির পাশে আরশি নগর, সত্য বল সুপথে চল ওরে আমার মন, সময় গেলে সাধন হবে না, কিংবা আমি অপার হয়ে বসে আছি, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, মিলন হবে কত দিনে, পারে লয়ে যাও আমায়। এসব গান কেবল শুধু সংগীত নয়, যেন ছিল আত্মজিজ্ঞাসার শুরু। ফরিদা পারভীন যেন লালনকে শুধু গানে ধারণ করেননি, তাকে জীবনের দর্শন করে তুলেছিলেন।
তাই তাকে লালনকন্যা বলা হয়তো কাব্যিক শোনালেও, আসলে তার ক্ষেত্রে তা যথার্থ পরিচয়। পরেরবার দেখা হলো যখন, ফরিদা পারভীন আমাদের পত্রিকা অফিসে আসলেন ইন্টারভিউ দিতে, (সেটাই সম্ভাবত তার শেষ ইন্টারভিউ) তখন মনে হয়েছিল, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’র দুলাইন শোনাব- তারই কণ্ঠে শুনে যা ধারণ করেছি, বলব; কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে আর সাহসে কুলাতে পারিনি।
আজ তার প্রয়াণে মনে হলো, সেটুকু সাহসে ভর করে আমার দু-কথা বললে ক্ষতি ছিল না। ফরিদা পারভীন গভীর মমতায় গেয়ে গেছেন জীবনবোধের গান। শুধু লালনগীতিই না, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধক, নজরুলগীতিতেও তিনি ছিলেন অনন্য অসাধারণ। গেয়েছেন আধুনিক ও। লালনকে ধারণ করে তিনিও মানবতার জয়গান করেছেন। তার গানে, তার জীবনযাপনেও লালনের গানের মতো একতা, সার্বজনীন বোধ প্রকাশ পেয়েছে। লালন বলতেন, সবখানে সে এক ‘মানুষ’ মানুষের, মানবতার জয়গান করেছেন, আর ফরিদা পারভীন গানে গানে সেই মানুষকেই চেনাতে চেয়েছেন আমাদের।
তিনি শুধু নিছক শিল্পী নন, ছিলেন সংগীতের অনন্য ধারক ও বাহক। বাংলা লোকসংগীতের মানচিত্রে তিনি এক অনন্য উজ্জ্বল তারকা হয়ে থাকবেন, যার জীবন প্রদীপ নিভে গেলেও আলোর উষ্ণতা রয়ে যাবে বহুদিন, বহুকাল। আমরা যখন আবার লালনসংগীত শুনব, কিংবা লোকগান, ফরিদা পারভীনের কণ্ঠই ফিরে আসবে আমাদের কানে। কারণ ফরিদা পারভীন আমাদের শুধু গান দেননি, দিয়েছেন এক আত্মিক সংযোগ।
যেখানে বাউল দর্শনের মূলে থাকা প্রশ্নগুলো উঁকি দেয়, কে তুমি? কোথা থেকে এসেছো? কোথায় যাবে? তিনি হয়তো চলে গেছেন; কিন্তু উত্তর খোঁজার পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। বিদায়, লালনকন্যা। আপনার গান, আপনার দর্শন, আপনার আত্মার সুর আমাদের ভেতর বেঁচে থাকবে- যতদিন বাংলার মাটি আছে, মানুষের হৃদয় আছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে