Views Bangladesh Logo

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকার ও বিএনপির রাজনীতির ভবিষ্যৎ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিবিসি বাংলাকে দেয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। দীর্ঘ সতেরো বছর নির্বাসনে থেকে দেয়া এই সাক্ষাৎকারটি শুধু তার ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তনের বার্তা নয়; বরং এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে সম্ভাব্য নতুন সমীকরণের ইঙ্গিতও বহন করে। ক্ষমতার পালাবদলের অন্যতম দাবিদার বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে নেতৃত্বের সংকট, দলীয় বিভাজন, দুর্নীতির অভিযোগ ও কার্যকর আন্দোলনের ব্যর্থতায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে দলের শীর্ষ নেতার এই প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভাষ্য নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে- কেউ এটিকে বিএনপির পুনর্জাগরণের সূচনা হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ মনে করছেন এটি এখনো এক অনির্ধারিত প্রতিশ্রুতি।

তারেক রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একদিকে বিতর্কিত, অন্যদিকে প্রভাবশালী চরিত্র। তিনি বিএনপির কার্যনির্বাহী চেয়ারম্যান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সময়ে তিনি দলের নীতিনির্ধারণ ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন; কিন্তু পরবর্তীকালে দুর্নীতি, ঘুষ, অর্থ পাচার ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন। ২০০৭ সালের পর তার বিরুদ্ধে ৮৪টি মামলা হয়; কয়েকটিতে দণ্ডিতও হন। সবচেয়ে আলোচিত ছিল ‘হাওয়া ভবন কেলেঙ্কারি’, যেখানে তাকে কমিশন বাণিজ্য ও ঘুষ গ্রহণের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়।

২০১৬ সালে তাকে অর্থ পাচার মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড ও বিশ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়। ২০২৩ সালে আরও এক দুর্নীতি মামলায় ৯ বছরের কারাদণ্ড হয় তার ও তার স্ত্রী জুবায়দা রহমানের। তবে ২০২৪-২৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর তিনি একাধিক মামলায় খালাস পান। এই জটিল অতীত যেমন তার ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, তেমনি এটি তাকে এক ‘বেঁচে ফেরা রাজনীতিক’-এর প্রতীকে পরিণত করেছে- যিনি ব্যর্থতা পেরিয়ে নতুন করে নিজেকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।

সাক্ষাৎকারে তারেক রহমানের সবচেয়ে আলোচিত বক্তব্য ছিল দেশে ফেরার ঘোষণা: ‘সময় এসেছে, ইনশাল্লাহ আমি খুব শিগগির দেশে ফিরব।’ দীর্ঘদিন নেতৃত্বশূন্য বিএনপির জন্য এটি আশার বার্তা হিসেবে ধরা হয়েছে। তবে দেশে ফেরার বিষয়টি কেবল আবেগ নয়, তা রাজনৈতিক ঝুঁকিও বহন করে- মামলা, গ্রেপ্তার ও সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি তার জন্য অনিবার্য। তবু জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ পুনঃস্থাপন ছাড়া নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়- এই উপলব্ধিই তার বক্তব্যে স্পষ্ট।

তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও গণমানুষের সঙ্গে থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেন। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির পরাজয় ও বর্জন- দুটিই তাদের জনআস্থা ক্ষয় করেছে। তারেকের সক্রিয় অংশগ্রহণ এই মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করতে পারে, যদিও আইনি বাধা এখনো অনিশ্চয়তার বড় ক্ষেত্র।

সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি জনগণের আন্দোলন, কোনো ব্যক্তি বা দলের নয়।’ এই মন্তব্য তার রাজনৈতিক সতর্কতার প্রতিফলন- তিনি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল; কিন্তু মালিকানা দাবি করছেন না। তবে বিশ্লেষণমূলক দৃষ্টিতে এটি দ্বিমুখী কৌশল: একদিকে তিনি ঐক্য অক্ষুণ্ন রাখছেন, অন্যদিকে দায়ও এড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে এ ধরনের নিরপেক্ষ অবস্থান কখনো কখনো নেতৃত্বের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিও প্রকাশ করে। কারণ, ইতিহাসে গণআন্দোলন কেবল বিমূর্ত ‘জনগণের’ নয়- শিক্ষার্থী, শ্রমিক, তরুণ, কিংবা শহুরে মধ্যবিত্তের সক্রিয় অংশগ্রহণেই তা বাস্তব রূপ পায়। তাদের নামহীন করে দেয়া রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ হলেও মানবিকভাবে সংবেদনশীল নয়।

একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, দীর্ঘ সতেরো বছরের নির্বাসন তারেক রহমানকে দেশের বাস্তব রাজনীতি থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করেছে। এই দূরত্ব তাকে যেমন বিপদ থেকে রক্ষা করেছে, তেমনি বর্তমান বাংলাদেশকে বোঝার ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতাও তৈরি করেছে। গণঅভ্যুত্থানের পরও দেশে না ফেরায় অনেকে তার নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। মাঠপর্যায়ে বিভাজন, দুর্নীতি, ও সাংগঠনিক দুর্বলতার দায় এখন সরাসরি তার অনুপস্থিতির ওপর পড়ছে।

খালেদা জিয়া কার্যত রাজনীতি থেকে সরে গেছেন, ফলে বিএনপি নেতৃত্বের সংকটে ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’তে পরিণত হয়েছে। যে দল একসময় স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়ের নতুন ভাষা ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ তৈরি করেছিল, সেই দল আজ প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিতে আবদ্ধ। নিজেদের চিন্তার ন্যারেটিভ হারিয়ে তারা ক্ষমতার প্রতিযোগিতাকেই রাজনীতির প্রধান মানদণ্ড বানিয়ে ফেলেছে।

তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারে দলের ভবিষ্যৎ রূপরেখার কিছু ইঙ্গিত থাকলেও মৌলিক নীতিগত দিক অনুপস্থিত। তিনি আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন ও দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন; কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নিরাপত্তা বাহিনীর অপব্যবহার কিংবা প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কার প্রসঙ্গে নীরব থেকেছেন। একজন সম্ভাব্য রাষ্ট্রনির্মাতা হিসেবে তার এই সীমাবদ্ধতা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, সত্যিকারের নেতৃত্ব কেবল প্রতিপক্ষের সমালোচনায় নয়- সিস্টেমের পুনর্গঠনের দর্শনেও প্রকাশ পায়।

তার জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে মন্তব্যও একইরকম অস্পষ্ট: ‘আইনের মধ্যে থেকে রাজনীতি করলে রাজনীতি করতে দেয়া হবে।’ এটি শুনতে গণতান্ত্রিক মনে হলেও, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জামায়াত কেবল আইনি নয়, নৈতিক দায়েও অভিযুক্ত। তার এই মন্তব্য নেতৃত্বের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে তুলতে পারে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিএনপির সবচেয়ে বড় কাজ হলো আত্মসমালোচনার সাহস দেখানো। আওয়ামী লীগের দুর্নীতির সমালোচনা যথার্থ হলেও, নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়া দলকে নৈতিক উচ্চভূমিতে নিতে পারবে না। রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের পূর্বশর্ত হলো নৈতিক পুনর্জন্ম। প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে ন্যায়বিচার, অন্তর্ভুক্তি ও নাগরিক অধিকারের নতুন দর্শন গঠন করতে হবে।

তারেক রহমান যদি সত্যিই নতুন অধ্যায় শুরু করতে চান, তবে তাকে ‘হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার’-এর বদলে ‘রাষ্ট্র পুনর্নির্মাণ’-এর ভাবনাকে কেন্দ্র করতে হবে। পিতার উত্তরাধিকার নয়, নিজের বুদ্ধি, নৈতিকতা ও বাস্তববাদিতার ভিত্তিতে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারই তাকে ভিন্নমাত্রা দিতে পারে। দলের ভেতরের দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রথার সংস্কার ছাড়া সাংগঠনিক সাফল্যও দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান বারবার তরুণদের কথা বলেছেন: ‘নতুন প্রজন্ম পরিবর্তন চায়।’ এটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, কারণ দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি তরুণদের কাছে অনাকর্ষণীয় ছিল। আওয়ামী লীগের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বয়ানের বিপরীতে বিএনপি কোনো বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করতে পারেনি। যদি দলটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় হয়ে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করে, প্রযুক্তিনির্ভর সংগঠন গড়ে তোলে, তবে তারা পুনরুজ্জীবনের পথে ফিরতে পারে।

তার ‘৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার পরিকল্পনা’ও এক্ষেত্রে নতুন ভিত্তি হতে পারে। তিনি জানিয়েছেন, এতে অন্যান্য গণতান্ত্রিক দলের মতামতও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- যা জোটভিত্তিক রাজনীতির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, বিএনপি কি এত বিভক্ত বাস্তবতায় এমন সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে পারবে?

বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল প্রশাসন, নির্বাচন ব্যবস্থা ও গণমাধ্যমের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। এই বাস্তবতায় বিএনপির জন্য অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি কঠিন। তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমরা সংঘাত নয়, পরিবর্তনের রাজনীতি চাই।’ অর্থাৎ তিনি এখন আন্দোলনের বদলে নির্বাচনি ও সংস্কারভিত্তিক কৌশলে ঝুঁকছেন- যা সংঘাতনির্ভর রাজনীতি থেকে এক ধাপ এগিয়ে।

বিএনপির ভবিষ্যৎ এখন তিন উপাদানের ওপর নির্ভর করছে- নেতৃত্ব, কৌশল ও জনআস্থা। তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন নেতৃত্ব সংকট পূরণ করতে পারে; কৌশলগতভাবে দলকে আন্দোলন ও নির্বাচনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে; আর জনআস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে অতীতের ভুল স্বীকার ও দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি নিশ্চিত করতে হবে।

সবশেষে প্রশ্ন রয়ে যায়- তারেক রহমান দেশে ফিরবেন কি, এবং ফিরলেও কার্যকর রাজনীতি করতে পারবেন কি? দেশে ফিরলে আইনি ঝুঁকি অনিবার্য; কিন্তু সেটিই হতে পারে নতুন বিরোধী রাজনীতির সূচনা। কারণ, প্রতীকী নেতৃত্বের সরাসরি উপস্থিতি ছাড়া জনগণের আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক ক্লান্তি ও নৈতিক নেতৃত্বের অভাব প্রবল। এই শূন্যতা পূরণে যদি বিএনপি তারেক রহমানের নেতৃত্বে আত্মসমালোচনামূলক, গণমুখী ও নৈতিক রাজনীতি গড়ে তুলতে পারে, তবে তারা আবারও শক্তিশালী বিকল্প শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।

তারেক রহমানের বিবিসি সাক্ষাৎকার তাই কেবল ব্যক্তিগত প্রত্যাবর্তনের বার্তা নয়- এটি একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক রূপান্তরের সূচনা। এখন দেখার বিষয়, তিনি কি সেই রূপান্তরকে বাস্তবে পরিণত করতে পারেন, নাকি আবারও পুরোনো ক্ষমতার পুনরাবৃত্তির শিকার হন।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ