Views Bangladesh Logo

তারেক রহমানের ফেরা না-ফেরা

বিএনপির শীর্ষনেতা তারেক রহমানের দেশে ফেরা না-ফেরা নিয়ে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে মনে পড়ছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ নামক বিখ্যাত উপন্যাসটির কথা। উপন্যাসের নামটি প্রতীকী। ঔপন্যাসিক এমনভাবে চরিত্রগুলো সাজিয়েছেন, যেন তারা প্রত্যেকেই অদৃশ্য সুতার টানে পুতুলের মতো নড়াচড়া করে।


মানুষের ইচ্ছা, ভালোবাসা, আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা, জীবনের উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ, মিলন-বিরহ, জন্ম-মৃত্যু, সবকিছুই যেন অদৃশ্য সুতার বাঁধনে আবদ্ধ, যেখানে মানুষ ভাবছে সে নিজেই নিজের জীবনের নিয়ন্তা, অথচ বাস্তবে কোনো এক অদৃশ্য শক্তি সুতা টেনে তার সমস্ত নড়াচড়া নির্ধারণ করছে। মানুষ কখনো দৌড়ায়, কখনো থেমে যায়, কখনো ছটফট করে মুক্তি চায়, অথচ শেষ পর্যন্ত বোঝে, তার হাত-পা নড়ার স্বাধীনতাও আরেকজনের ইচ্ছার কাছে বন্ধক রাখা। এই সমাজে সবাই নিজেকে মুক্ত ভাবলেও সে আসলে সুতা-টানা এক চরিত্র মাত্র। এই অদৃশ্য নিয়ন্তার উপস্থিতি অনুভূত হয় না চোখে, কিন্তু অনুভব করা যায় প্রতিটি সিদ্ধান্তের আড়ালে, প্রতিটি আকাঙ্ক্ষার যে স্থবিরতা সেখানে, আর প্রতিটি প্রাপ্তির যে অবধারিত সীমাবদ্ধতা, সেসবের মধ্যে দিয়ে। তাই ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কেবল একটি উপন্যাস নয়; এটি মানবজীবনের প্রতীকী উপাখ্যান, যেখানে মানুষের সব শক্তি, সব দুর্বলতা, সব স্বপ্ন, সব বেদনা শেষ পর্যন্ত পুতুলের মতোই অদৃশ্য হাতে বাঁধা পড়ে থাকে, আর জীবন কেবল তারই নীরব অভিনয়।


বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান কেন দেশে ফিরছেন না, এই নিয়ে চলছে আলোচনার ঝড়। এর আগে তার দেশে ফেরা নিয়ে এতটা আলোচনা হয়নি। এর কারণ তার মা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর শারীরিক অবস্থা। গত কয়েকদিন ধরে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। মায়ের এ অবস্থায় তার পাশে থাকা একজন সন্তানের সহজাত দায়িত্ব ও কর্তব্য। এমন সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন, মায়ের পাশে থাকবেন, এটাই ছিল জনআকাঙ্ক্ষা। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, তিনি দেশে ফিরবেন। এর আগে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, নভেম্বরের মধ্যেই তিনি দেশে ফিরবেন। পরে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের কথা বলা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই তারেক রহমান নিজেই তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জানিয়ে দিলেন, দেশে ফেরা এখনো নিশ্চিত নয়। এই ঘোষণাই পূর্বের সব ঘোষণা-আশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নতুন করে রাজনীতির মাঠে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে।
তারেক রহমান তার ফেসবুক পোস্টে যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। তিনি লিখেছেন, এমন সংকটকালে মায়ের স্নেহস্পর্শ পাওয়ার গভীর আকুলতা তার রয়েছে, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে এককভাবে নেওয়ার ক্ষমতা তার হাতে নেই। এই মন্তব্যটি তার ব্যক্তিগত আবেগকে তুলে ধরলেও একই সঙ্গে এটি একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করেছে, যা বহু বছর ধরেই তার দেশে ফেরা না-ফেরার আলোচনায় পটভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তিনি আরও লিখেছেন, বিষয়টি এতটাই স্পর্শকাতর যে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশও সীমিত। এটি স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তুলেছে, কী এমন বাস্তবতা যা তাকে নিজের দেশেও ফিরতে দিচ্ছে না, কিংবা কোন শক্তি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করছে?


বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক নেতাদের দেশে ফেরাকে ঘিরে নানা ধরনের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা কাজ করে, এটি কোনো নতুন বিষয় নয়। তবে তারেক রহমান যেভাবে ‘একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন, তা আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনৈতিক দল, সরকার বা জনসমর্থন নয়, এর বাইরে ‘আরও কিছু’ রয়েছে, যা তার দেশে ফেরা নির্ধারণ করে, এমন ধারণা রাজনৈতিক মহলে অনেক দিন ধরে বিরাজ করলেও এবার সেই ইঙ্গিত এসেছে সরাসরি তারেক রহমানের কাছ থেকে। বিএনপি বহুবার দাবি করেছে যে তার নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে। যদিও সেই ঝুঁকির উৎস বা প্রকৃতি কখনো সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেনি। হুমকিটি কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থেকে, নাকি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর কোনো অংশ থেকে, নাকি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের কোনো অচিহ্নিত মঞ্চ থেকে, এ বিষয়ে দলের বক্তব্য বরাবরই অস্পষ্ট ছিল। এবার সেই অস্পষ্টতা আরও বাড়ল, যখন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলো, তার দেশে ফেরায় কোনো সরকারি বাধা নেই এবং চাইলে একদিনেই তাকে ট্রাভেল পাস দেওয়া সম্ভব। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্টত কোনো বাধা না থাকার ঘোষণার পরও যদি তারেক রহমান দেশে ফিরতে না পারেন, তবে প্রশ্ন জাগে, তার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে কারা?


এই পরিস্থিতিতে বিএনপির রাজনীতিতে নতুন ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তার অনুপস্থিতিতে দলের সাংগঠনিক কাঠামো, আন্দোলন পরিচালনা, নেতৃত্বের স্থায়িত্ব, সবকিছুই দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতা দলকে রাজনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করেছে। আবার তারেক রহমান দেশের বাইরে থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও বাস্তবে মাঠের রাজনীতি পরিচালনায় তার সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দলের অনেকেই মনে করেন, তার দেশে ফেরা দলকে নতুন প্রাণ দিতে পারত, বিশেষ করে নেতৃত্বের স্থবিরতা কাটানো, কর্মীদের উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে। কিন্তু তিনি নিজেই যখন জানান, তার সিদ্ধান্ত অন্য কোনো নিয়ন্ত্রণাধীন বাস্তবতার ওপর নির্ভরশীল, তখন দলের কর্মীদের মধ্যে হতাশা ও প্রশ্ন আরও বাড়ে, দলের সর্বোচ্চ দুই নেতাকেই যদি কাছে পাওয়া না যায়, তবে দলটি কোন পথে অগ্রসর হবে?


ওদিকে সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক অঙ্গনও স্বাভাবিকভাবে এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক সুবিধার জায়গা হিসেবে বিবেচনা করছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে যে তারেক রহমান চাইলে একদিনেই ট্রাভেল পাস দেওয়া হবে, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে সরকার দেখাতে চাইছে, তাদের পক্ষ থেকে কোনো বাধা নেই; বরং দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত তার নিজের। এতে করে এক ধরনের রাজনৈতিক চাপ তৈরি হয় বিএনপির ওপর, কারণ জনগণ ও সমর্থকদের কাছে ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতার দেশে ফেরায় শুধু ‘পলিটিক্যাল রিয়েলিটি’ বাধা, কিন্তু সেই বাস্তবতা ঠিক কী? কোন অদৃশ্য ভূতের ভয়ে তিনি দেশে আসতে পারছেন না? তবে কি দেশের রাজনীতি এখনও ‘অদৃশ্য’ ভূতের দখলে?


এখানেই আসে বাংলাদেশের রাজনীতির এক অঘোষিত সত্য। আমাদের রাজনীতির ওপর প্রভাব বিস্তারকারী বহু অদৃশ্য শক্তি দীর্ঘদিন ধরেই নানাভাবে সক্রিয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, আঞ্চলিক শক্তির ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, বড় শক্তিগুলোর কৌশলগত সুবিধা; সব মিলিয়ে দেশের রাজনীতির ওপর একটি বহুমাত্রিক চাপ বরাবরই কাজ করে আসছে। এ অবস্থায় একটি বৃহৎ রাজনৈতিক পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যিনি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে রাজনীতিতে সক্রিয়, তার দেশে ফেরা শুধু ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ নয়, বরং এটি একটি নিরাপত্তামূলক, আন্তর্জাতিক, কৌশলগত এবং আঞ্চলিক বাস্তবতার বহুমাত্রিক ফলাফল। তারেক রহমানের বক্তব্যে সেই নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠীর পরিচয় উল্লেখ না করলেও তার ইঙ্গিত বোঝা কঠিন নয় যে, সিদ্ধান্তটি কেবল তার এবং তার দলের হাতে নেই। এই জটিল পরিস্থিতি বিএনপির আগামী রাজনৈতিক পথকেও অনিশ্চিত করে তুলেছে। দলের চেয়ারপারসন গুরুতর অসুস্থ, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন দেশে ফিরতে পারছেন না, মাঠের রাজনীতি আন্দোলন-সংগঠনের সীমাবদ্ধতায় আটকে আছে, সব মিলিয়ে দলটি বর্তমানে নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। এই মুহূর্তে তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারলে তা শুধু তার ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণ করত না, দলীয় রাজনীতিও নতুনভাবে উজ্জীবিত হতো। কিন্তু তার বক্তব্য স্পষ্ট করেছে, দলটিকে এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রিয়াশীলতা নির্ভর করছে অঘোষিত শক্তিগুলোর উপর, যাদের পরিচয় প্রকাশ করা যায় না, কিন্তু প্রভাব স্পষ্ট।


তারেক রহমানের বক্তব্যে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো এই দেশে কে রাজনীতি করবে, কে করবে না; কে দেশে ফিরে আসবে, কে আসতে পারবে না, কে দেশে থাকবে, আর কে ভাগবে, এটি কেবল জনগণ, রাজনৈতিক দল বা সরকার নির্ধারণ করে না। রাজনীতির কাঠামোর বাইরেও এমন কিছু শক্তি আছে, যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। সেই ‘অশরীরী’ শক্তির প্রভাবই তারেক রহমানের দেশে ফেরা প্রশ্নকে ক্রমাগত জটিল করে তুলছে এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার অদৃশ্য দিকটিকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে।


তারেক রহমানের বক্তব্যে যে অসহায়ত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা শুধু একজন সন্তানের মায়ের জন্য আকুল হয়ে থাকা নয়, বরং রাজনীতির বহিরাবরণে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য শক্তিগুলোর প্রভাবের প্রতিফলন। এই বাস্তবতা যতদিন অব্যাহত থাকবে, ততদিন তারেক রহমানের দেশে ফেরা শুধুই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় থাকবে না, এটি হয়ে উঠবে নানা শক্তির সমীকরণের জটিল ফলাফল। যেমনটি চিত্রিত হয়েছিল ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’য়, যেখানে দৃশ্যমান চরিত্রের ভাগ্য নির্ধারণ করে অদৃশ্য নিয়তি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এই বাস্তবতা দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও এবার তারেক রহমানের বক্তব্য সেটিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথকেও প্রভাবিত করতে পারে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ