‘দখল-চাঁদাবাজি’ নিয়ে টিআইবির বিবৃতি আমলে নিন
গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের একাংশ ও কিছু কিছু উদীয়মান তরুণ নেতা মনে করছেন সব ক্ষমতা তাদের হাতে চলে গেছে, তাই তারা দখল-চাঁদাবাজি শুরু করেছেন বিপুল উৎসবে। তাদের আচরণ, কার্যকলাপ দেখে মনে হয় দখল-চাঁদাবাজিই বুঝি আসল রাজনীতি।
প্রথমে আমরা বিচ্ছিন্নভাবে তাদের দখল-চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য দেখেছি, কিছুদিন আগে দেখলাম ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর লুটপাটে তারা একযোগে কাজ করছে। এসব দেখে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, তাদের এমন আচরণ কর্তৃত্ববাদের পতনে সৃষ্ট নতুন বন্দোবস্তের জন্য অশনি সংকেত।
রোববার টিআইবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কর্তৃত্ববাদ পতনের পরিপ্রেক্ষিতে গত এক বছরে সবচেয়ে প্রভাবশালী বলে বিবেচিত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের একাংশের কার্যক্রম আগের আমলের সরকারি দলের বহুমুখী ক্ষমতার অপব্যবহার ও স্বার্থসিদ্ধিমূলক অসুস্থ চর্চার প্রতিচ্ছবি।
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা উঠেছিল। নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত মানে আগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটবে বলে জনগণ আশা করেছিল। আজ দেখা যাচ্ছে সেই আশার গুড়ে বালি। আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের পর পরই নতুন কর্তৃত্ববাদের আস্ফালন দেখা যাচ্ছে। দেশব্যাপী বহুমাত্রিক দলবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট, মামলা বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য, ট্যাগ বাণিজ্য ও দলীয় আধিপত্যকেন্দ্রিক সহিংসতা শুরু হয়েছে। যা ‘নতুন বাংলাদেশ’ বা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য অশনি সংকেত। টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়েছে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা, নৈতিকতা ও জবাবদিহিমূলক চর্চা প্রতিষ্ঠায় করণীয় নিয়ে আত্মজিজ্ঞাসার এখনই সময়।
কিন্তু সেই সেই আত্মজিজ্ঞাসা কি কি প্রকৃত অর্থে আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি? বড় রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে তারা এর মধ্যেই ক্ষমতা হাতে পেয়ে গেছে। দখল-চাঁদাবাজি চলছে দেদার। নিজেদের নেতাকর্মীদের জোরজবরদস্তির কার্যকলাপ নিয়ে তাদের তেমন কোনো সমালোচনা নেই। অনেক সময় ঘটনা প্রকাশ পেয়ে গেলে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুধু বলা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে; কিন্তু পরবর্তীতে এরকম দেখা গেছে বহিষ্কৃত নেতাকর্মী আবার ঠিকই কোনো না কোনোভাবে দলে ঢুকে যাচ্ছেন। বহিষ্কার ছাড়া তাদের আর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা থাকছে না।
ক্ষমতাপ্রত্যাশী ও প্রভাবশালী দলগুলোর নেতাকর্মীদের একাংশের সরাসরি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পারস্পরিক যোগসাজশমূলক সম্পৃক্ততায় দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আবারও স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পতিত রাজনৈতিক শক্তিও যুক্ত থাকছে। প্রথাগত দলবাজি, দখলবাজি ও পদ বাণিজ্যের কারণে সহিংস দলীয় কোন্দল স্থানীয় পর্যায়ে হরতাল ঘোষণার মতো বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। টিআইবির ভাষ্যমতে, দাবি আদায়ে বলপ্রয়োগের পাশাপাশি কোনো কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও বিচ্ছিন্নভাবে অতিক্ষমতায়িত শক্তির সম্পৃক্ততায় তথাকথিত ‘মবতন্ত্রের’ মুখোশে সংখ্যালঘু, জেন্ডারভিত্তিক, আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের বিরুদ্ধে বীভৎস আঘাত, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ওপর নির্মম আক্রমণের অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হয়েছে দেশবাসীকে।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির এটাই পরিচিত চিত্র যে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক দখল-চাঁদাবাজির অপসংস্কৃতিই তাদের পাথেয়। দেশের সাধারণ জনগণও এ কারণে রাজনীতিবিদের ওপ আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন; কিন্তু এই বিরাজনীতিকরণের মানসিকতাও তো দেশে মঙ্গল বয়ে আনবে না। গণঅভ্যুত্থানের পর আশা করা গিয়েছিল এই অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতির অবসান ঘটবে; কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা দেখা যাচ্ছে না। আর এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেমন দায়ী তেমন দায়ী বর্তমান সরকারও। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনোভাবেই গণঅভ্যুত্থানের আশাবাদকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেনি।
দখল-চাঁদাবাজি রুখতে তারা স্পষ্টভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। সামনে নির্বাচন, আশঙ্কা করা যাচ্ছে নির্বাচনের পর, যে দলই ক্ষমতায় আসুন এই দখল-চাঁদাবাজি আরো বাড়বে। রাজনীতিবিদেরও মনে রাখতে হবে তাহলে জনগণ ছেড়ে দিবে না। মানুষ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। দখল-চাঁদাবাজির রাজনীতি করে বাংলাদেশে আর বেশিদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যাবে না। তবে, সংস্কার নীতিমালায় এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আরো অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তা না হলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনগণের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে তা আরো বাড়বে। এবং তার ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আজ হোক কাল হোক জনগণের মুখোমুখি দাঁড়াতেই হবে। তাই এখনো হয়তো সময় আছে, দখল-চাঁদাবাজি নিয়ে টিআইবির বক্তব্য আমলে নিন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে