আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় প্রথম সংসদ নির্বাচন
সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর আজ রোববার সিরিয়ায় প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে চলমান অস্থিরতা ও নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে দেশের কেবল আংশিক এলাকায় এই নির্বাচন হচ্ছে।
নির্বাচনটি সরাসরি জনগণের ভোটে হচ্ছে না। নতুন ২১০ আসনের পিপলস অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ (১৪০টি আসন) সদস্য নির্বাচিত হবে ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে। বাকি ৭০ জন সদস্যকে সরাসরি নিয়োগ দেবেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা।
নিরাপত্তাজনিত কারণে রাকা, হাসাকেহ এবং সুওয়াইদা—এই তিনটি প্রদেশে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশটির ৬০টি নির্বাচনী জেলার মধ্যে মাত্র ৫০টিতে ভোটগ্রহণ হচ্ছে, যার মাধ্যমে প্রায় ১২০টি আসন পূরণ হবে।
আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ১০ মাস পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দীর্ঘ ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ চলার পর শারার অনুগত বাহিনীর হাতে আসাদের পতন ঘটে। এই যুদ্ধে ৬ লাখেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয় এবং বাস্তুচ্যুত হন ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ।
নির্বাচনটি তদারকি করছে হায়ার কমিটি ফর দ্য সিরিয়ান পিপলস অ্যাসেম্বলি ইলেকশনস, যার ১১ জন সদস্যকে জুন মাসে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট নিজেই। ২০১০ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে সংসদীয় আসনগুলো বন্টন করা হয়েছে।
নির্বাচনে ১ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যারা সবাই ইলেকটোরাল কলেজের সদস্য। আসাদ সরকারের সমর্থক, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে মনোনীত দলগুলোর সদস্য বা বিচ্ছিন্নতাবাদের সমর্থকদেরকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ শতাংশ নারী হওয়া বাধ্যতামূলক, তবে মূল সংসদের জন্য নারী বা সংখ্যালঘু কোটা রাখা হয়নি।
এদিকে এই নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা করেছে সিরিয়ার ১৪টি সিভিল সোসাইটি গ্রুপ। তারা সতর্ক করে বলেছে যে, সংসদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্যকে প্রেসিডেন্ট শারার নিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা সংসদের স্বাধীনতাকে দুর্বল করে দেবে।
এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘এই পদ্ধতি সংসদকে এমন ক্ষমতার ভারসাম্যের অধীন করে তোলে, যা জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নয়। এটি নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে এমন একটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেয়, যা স্বাধীন ও প্রতিনিধিত্বশীল হওয়া উচিত।”
লজিস্টিক সমস্যার কথা উল্লেখ করে এই পদ্ধতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট শারা। এক টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘নথি হারানোর কারণে এবং জনসংখ্যার অর্ধেক সিরিয়ার বাইরে থাকায় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন করা কঠিন।’
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন সিরিয়ার কোনো নেতা, যা ৬০ বছরের মধ্যে এটি প্রথম। ভাষণে প্রেসিডেন্ট শারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দেন এবং সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন প্রতিষ্ঠান ও আইন দিয়ে সিরিয়া পুনর্গঠনের ঘোষণা দেন।
রাকা এবং হাসাকেহ প্রদেশ দুটি মূলত কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যারা তাদের সামরিক ও বেসামরিক কাঠামোকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থায় রয়েছে।
কুর্দি ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির (পিওয়াইডি) থৌরিয়া মোস্তফা বলেন, এই নির্বাচনি প্রক্রিয়া দেখায়, সরকার এখনও কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা বহন করছে। এই সরকার সিরিয়ার জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করে না।
অন্যদিকে সুওয়াইদা প্রদেশে জুলাই মাসে দ্রুজ মিলিশিয়া এবং সুন্নি বেদুঈন উপজাতিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর উত্তেজনা বিরাজ করছে। পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর মতে, এই সংঘর্ষে ১ হাজার জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই দ্রুজ সম্প্রদায়ের।
জারামানা শহরতলির বাসিন্দা হুসাম নাসরেদ্দিন বলেন, ‘পিপলস অ্যাসেম্বলির সদস্যদের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হওয়া উচিত। আমরা এখন যা দেখছি, তা আরও বেশি করে নিয়োগের মতো।’
সংস্কারের আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও অনেক সিরিয়ান এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন যে, এই সীমিত পরিসর এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের সামান্যই ইঙ্গিত বহন করছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে