সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষা শিক্ষা ও কিছু হাস্যরস
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা উপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা সৈয়দ মুজতবা আলী। ১৯০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে তার জন্ম। শিক্ষাজীবনের বড় একটা অংশ কেটেছে শান্তি নিকেতনে। সেখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, গুজরাতি, ফরাসি, জার্মানি, ইতালিসহ অনেক ভাষা শেখেন। পড়াশোনা ও চাকরির জন্য এবং নেহাত ঘোরার নেশায়- পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরেছেন মুজতবা আলী। রম্য রচনায় বাংলা সাহিত্যে তিনি অদ্বিতীয়। আজ ১৩ সেপ্টেম্বর এই সাহিত্যিকের প্রয়াণ দিবস। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ প্রকাশিত সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলির থেকে পাঁচটি ঘটনা পাঠকদের জন্য পত্রস্থ হলো।
এক.
সৈয়দ মুজতবা আলীকে কোনো এক আসরে মদ খেতে দেখে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি যে মদ খাচ্ছেন, এটা দেখে তরুণ সমাজ কী শিখবে? উত্তরে সৈয়দ মুজতবা আলী মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার তরুণ সমাজকে বলে দিও-মদ খাওয়ার আগে আমি পৃথিবীর ২৩টি ভাষা রপ্ত করেছি।’
এমনি বিদগ্ধ ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তার সাহিত্য জীবনের ভীত গড়ে দিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন। মুজতবা আলী ছিলেন শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকের ছাত্র। ১৯২১ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানকার কলেজ পর্যায়ের ছাত্র ছিলেন। মুজতবা ১৭ বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের বোলপুরের ওই আঙিনায় পা রাখেন। নিজের ২২ বছর বয়সে সেখানে তার অধ্যয়ন শেষ হয়। শান্তিনিকেতনে প্রথম সাক্ষাতেই রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন মুজতবাকে, কী পড়তে চাও? তরুণ মুজতবা বললেন, তা ঠিক জানি নে। তবে একটা জিনিস খুব ভালো করে শিখতে চাই।
রবীন্দ্রনাথ বললেন, নানা জিনিস শিখতে আপত্তি কী। এভাবেই শান্তিনিকেতনে জার্মান, ফরাসি, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, রুশ ও ইতালীয় ভাষা আয়ত্ত করেন মুজতবা। এর মধ্যে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো ইংরেজি আর বাংলা ক্লাসে। তিনি পড়াতেন শেলি, কিটস আর বলাকা। ড. মার্ক কলিন্সের কাছে শেখেন ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান, অধ্যাপক তুচ্চির কাছে ইতালিয়ান, বগ্ দানফের কাছে আরবি ও ফারসি। এসব মহান শিক্ষককে শান্তিনিকেতনে জড়ো করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাদের কোনো ক্লাসই মিস করার সুযোগ ছিল না মুজতবা আলীর।
মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে জায়গা করে নেন আপন যোগ্যতায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কবিতা, ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ প্রবন্ধ তার মুখস্থ ছিল। তিনি ও প্রমথনাথ বিশী সুসাহিত্যিক হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের একান্ত প্রচেষ্টায়। সৈয়দ মুজতবা আলীর শান্তিনিকেতনের জীবনের সব কথা লিপিবদ্ধ আছে তার ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ বইয়ে।
দুই.
বাংলা সাহিত্যে রম্যরচয়িতা হিসেবে বিখ্যাত সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন প্রচুর ভ্রমণপিপাসু। প্রায়ই এদেশ-ওদেশ ঘুরে বেড়াতেন। ঘটনাটা জার্মানির। মুজবতা আলী জাহাজে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। সেই একই জাহাজে স্কোনো এক গার্লস স্কুলের বনভোজনের দলও ছিল। মুজতবা আলীর তখন মাথাভর্তি কালো চুল। বনভোজন দলের একটা ছোট্ট মেয়ের নজর কাড়ল ব্যাপারটা। ওদের দেশের বেশিরভাগ মানুষের চুল হয় সাদা না হয় বাদামি।
তাই মুজতবা আলীর কালো চুল দেখে অবাক হলো মেয়েটা। এক সময় আগ্রহ মেটাতে মুজতবা আলীর কাছে এসে বলে, ‘আপনি কি চুলে রং লাগান?’ বিব্রত মুজতবা আলী বলেন, ‘না, আমার চুল এমনিতেই কালো।’ মেয়েটি বিশ্বাস করে না মুজতবা আলীর কথা। বলে, ‘মিথ্যা! আমার কাছে লুকাচ্ছেন। মুজতবা আলী বলেন, ‘আমি সত্যি কথাই বলছি।’ মেয়েটি তখন বলে, ‘যদি সত্যি না বলেন, আমি মিসকে বলে দেব যে আপনি টিজ করছিলেন।’
ভারি বিপদ! মুজতবা আলীর মাথায় তখন একটা বুদ্ধি এসে যায়। নিজের শার্টের বোতাম খুলে বলেন, ‘দেখো, আমার বুকের চুলও কালো। বুকের চুল কেউ রঙ করে?’ মেয়েটি তখন বিশ্বাস করে। বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে, ‘আপনি তো খুব সুন্দর!’ এক দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায় মেয়েটি।
তিন.
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার খবর শুনে এক বুড়ো শিখ মেজর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে কার বিরুদ্ধে লড়ছে?’ ‘ইংরেজ-ফরাসি জর্মানির বিরুদ্ধে।’ সর্দারজি আপসোস করে বললেন, ‘ফরাসি হারলে দুনিয়া থেকে সৌন্দর্য চর্চা উঠে যাবে আর জার্মানি হারলেও বুরী বাৎ, কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান কলাকৌশল মারা যাবে।’ কিন্তু ইংরেজরা হারা সম্বন্ধে সর্দারজী চুপ। ‘আর যদি ইংরেজ হারে?’ সর্দারজী দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তবে দুনিয়া থেকে বেইমানি লোপ পেয়ে যাবে।’
চার.
সেই সনাতন প্রশ্ন, কোন দেশের রমণী সবচেয়ে সুন্দরী হয়। অবান্তর নয়, তাই নিবেদন করি, দেশ বিদেশ ঘুরেছি, অর্থাৎ ভ্যাগাবন্ড হিসাবে আমার ঈষৎ বদনাম আছে। কাজেই আমাকে কেউ শুধান, কোন দেশের রান্না সবচেয়ে ভালো, কেউ শুধান, তুলনাত্মক কাব্যচর্চার জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশস্ততম, আর অধিকাংশ শুধান, কোন দেশের রমণী সবচেয়ে সুন্দরী?
জার্মান মেয়ে বিদেশিকে প্রচুর খাতির ও যত্ন করে, প্রেমে পড়ে ফরাসিনীর চেয়েও বেশি; কিন্তু তৎসত্ত্বেও আপনি চিরদিনই তার কাছে 'আউস্ল্যান্ডার' (আউটল্যান্ডার), বা 'বিদেশিই' থেকে যাবেন- কিন্তু ফরাসিনীর মনে অন্য ভাগাভাগি। তার কাছে পৃথিবীতে দুই রকম লোক আছে- কলচরড আর আনকলচরড। ফরাসি, বিদেশি এই দুই স্পৃশ্য অস্পৃশ্য বাদ-বিচার তার মনে কখনো ঢোকে না।
তবে এ কথা অস্বীকার করার যো নেই, ফরাসি মেয়েরা আর পাঁচটা দেশের মেয়েদের তুলনায় বেশি বিদগ্ধ। গান বোঝে, সাহিত্য নিয়ে নাড়াচাড়া করে, নাচতে জানে, ওয়াইনে বানচাল হয় না, অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে চলে, পলিটিক্স নিয়ে মাথা ঘামায় কম এবং জান-ফাত, সাদা-কালো, দেশি-বিদেশি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সংস্কারবিবর্জিত। ভালো লেগেছে, তাই হামেশাই দেখতে পাবেন, দেবকন্যার মতো সুন্দরী ফরাসিনী যমদূতের মতো বিকট হাবশীর সংগে সগর্বে সদম্ভে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্যারিসের মেয়েরা সুন্দরী বটে। ইংরেজ মেয়ে বড্ড ব্যাটামুখো, জার্মান মেয়েরা ভোঁতা, ইতালিয়ান মেয়েরা ভারতবাসীর মতো (তাদের জন্য ইউরোপে আসার কী প্রয়োজন?)। আর বলকান মেয়েদের প্রেমিকরা হরবকতই মারমুখো হয়ে আছে (প্রাণটা তো বাঁচিয়ে চলতে হবে)। তার ওপর আরও একটা কারণ রয়েছে- ফরাসি মেয়ে সত্যি জামা-কাপড় পরার কায়দা জানে- অল্প পয়সায়- অর্থাৎ তাদের রুচি উত্তম।
পাঁচ.
সাধুবাবার এক চ্যালা ভদ্রলোককে দলে টানতে বলছেন, ‘জানেন মশায়, বাবা ত্রিশ বছরের সাধনায় এখন হেঁটে নদী পার হতে পারেন!’ ভদ্রলোক তখন আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘দুই টাকা দিয়েই তো খেয়াতে করে নদী পার হওয়া যায়, তার জন্য ত্রিশ বছরের সাধনার দরকার কী?’
শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: লেখক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে