ছাত্রদের কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হতে দেয়া যাবে না
ছাত্রসমাজ একটি জাতির সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও গতিশীল অংশ। তাদের মধ্যে থাকে আদর্শবাদ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, এবং পরিবর্তনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার এক প্রকার স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব। তারা কেবল একটি নির্দিষ্ট বয়সের জনগোষ্ঠী নয়, বরং পরিবর্তনের বার্তাবাহক হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আমাদের দেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলেই দেখা যায়- বাংলা ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বাংলাদেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্ররাই। তারা ছিলেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে জাতির প্রহরী।
সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র আন্দোলনগুলো বিশ্লেষণ করলে কিছু ভিন্ন প্রবণতা, আশঙ্কা ও প্রশ্ন সামনে চলে আসে। শিক্ষার্থীরা কি কেবল ন্যায্য দাবির ভিত্তিতে আন্দোলনে নামছে, নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তির ইন্ধনে, পরিকল্পিত উদ্দেশ্য সাধনের অংশ হয়ে উঠছে? গত এক দশকে আমরা একাধিক ছাত্র আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছি। ২০১৫ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত ভ্যাটের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ ছিল সাম্প্রতিককালের অন্যতম আলোচিত আন্দোলন। কয়েক দিনের অচলাবস্থার পর সরকার দাবি মেনে নেয়, যা শিক্ষার্থীদের সফল সংগঠিত প্রতিবাদের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
এরপর ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঘটে আরেকটি ঐতিহাসিক আন্দোলন- উত্তরার সড়কে দুই স্কুলছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। এমনকি ছোট ছোট স্কুলের শিক্ষার্থীরাও সড়কে নেমে আসে। এই আন্দোলন জনমত গঠন, রাষ্ট্রকে আইন প্রণয়নে বাধ্য করা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে; কিন্তু এরপরের ধারাটা আরও গভীর ও জটিল হয়ে ওঠে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, যার দ্বিতীয় দফা ২০২৪ সালে ছাত্র সমাজের মধ্যে অসন্তোষ থেকে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি শুধু ছাত্র রাজনীতির নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির দিক পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবেও চিহ্নিত হয়, যার ফলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায় নিতে হয়।
প্রতিটি আন্দোলনের শুরু হয়েছিল যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবিকে ঘিরে। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষও সহানুভূতি প্রকাশ করেছিল; কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো- প্রত্যেক আন্দোলনই একসময় রাজনৈতিক মোড় নিয়েছে, যার ফলে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দাবি কিংবা উদ্দেশ্য ছায়ার নিচে চাপা পড়ে গেছে। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাথমিকভাবে এটি ছিল একটি ছাত্রসমাজের সাংগঠনিক দাবি। কিন্তু ধীরে ধীরে তা রাজনৈতিক রূপ নেয়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিকে গড়ায়। এখানেই প্রশ্ন উঠছে- এই আন্দোলনের অন্তরালে কি কেবল ছাত্রদের আবেগ কাজ করেছে, না কি কোনো সংগঠিত গোষ্ঠী এই আবেগকে পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করেছে?
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, শিক্ষার্থীদের আবেগ এবং আন্দোলনকে সুকৌশলে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা সম্ভব, যা দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। শিক্ষার্থীরা আবেগপ্রবণ, এ কথা সত্য। তাদের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো একটি নৈতিক কর্তব্য বলেই বিবেচিত হয়। তবে সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার, গুজব ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে ছাত্রদের সহজেই উত্তেজিত করা যাচ্ছে, এটি এখন এক উদ্বেগজনক প্রবণতা হয়ে উঠেছে। অতীতে দেখা গেছে, একটি সত্য ঘটনার আড়ালে কিছু ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনকে সহিংস রূপ দিয়েছে। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির ঘটনায় যেমনটি দেখা যাচ্ছে। এই আন্দোলন এখন আর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ট্রাজিক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
নানা গোষ্ঠীর প্রভাব ও উসকানিতে রাজনৈতিক রং চড়িয়ে আন্দোলনকে ক্রমেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তা আরও বিস্তৃত আকার নিচ্ছে- ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এতে করে সন্দেহ জাগে- এই আন্দোলনের গতি ও বিস্তারে কোনো সংগঠিত গোষ্ঠীর হাত রয়েছে কি না। কারণ, একই সময়ে বিভিন্ন তুচ্ছ ইস্যুতে, বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ, ক্লাস বর্জনের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, শিক্ষার্থীরা কেন এত আন্দোলনমুখী হয়ে উঠছে? এর প্রথম ও প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট ও অনিশ্চয়তা। দীর্ঘ সেশনজট, পরীক্ষার ফল নিয়ে অনিয়ম, মানসম্মত শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাব শিক্ষার্থীদের হতাশ করে তুলছে। এই হতাশা থেকেই তারা যেকোনো ইস্যুতে দ্রুত রেগে গিয়ে পথে নামছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাও এর জন্য কম দায়ী নয়। রাষ্ট্রে যখন দুর্নীতি, বৈষম্য এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি দৃশ্যমান হয়, তখন ছাত্ররা নিজেকে সমাজ পরিবর্তনের বাহক মনে করে। এটি একদিকে ইতিবাচক হলেও, অন্যদিকে এই মনোভাবকে অনেক সময় ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষ। তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও প্রভাবও এর অন্যতম কারণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত যেমন খবর ছড়ায়, গুজবও ছড়ায়। যা শিক্ষার্থীদের সহজে উত্তেজিত করে তোলে। একটি আংশিক সত্যকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়ে সহিংসতায় রূপ নেয়। ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক চর্চার অভাবে, সংগঠনের স্থায়ী নেতৃত্ব না থাকায়, শিক্ষার্থীরা অনেক সময় দিকভ্রান্ত হয় এবং তাদের আন্দোলন উদ্দেশ্যহীন বা বিপথগামী হয়ে পড়ে। কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রুপ শিক্ষার্থীদের আবেগ এবং উদ্দীপনাকে ব্যবহার করে তাদের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে।
তারা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। এমনকি কিছু বিদেশি শক্তিও কৌশলে শিক্ষার্থীদের আবেগ ও সংগঠিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অস্থিরতা তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এখানে প্রশ্ন আসে- ছাত্রদের প্রকৃত দায়িত্ব কী? নিঃসন্দেহে, সমাজে অন্যায় দেখলে তারা প্রতিবাদ জানাবে, কারণ সচেতন নাগরিক হিসেবে এটি তাদের কর্তব্য। কিন্তু যদি বারবার আন্দোলনের কারণে তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত হয়, যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট, পরীক্ষা স্থগিত, বা দীর্ঘ সময় ক্লাস বন্ধ থাকে- তাহলে ছাত্রদের ব্যক্তিগত ভবিষ্যৎ যেমন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, তেমনি জাতির সামগ্রিক ভবিষ্যতও প্রশ্নের মুখে পড়বে।
শিক্ষার্থীদের মূল কাজ লেখাপড়া করা এবং নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়া। একটি সুস্থ ও উন্নত সমাজের জন্য শিক্ষিত ও যোগ্য নাগরিক অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলের কাজ রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় থাকা, আর শিক্ষার্থীদের কাজ জ্ঞান অর্জন করা। এই সীমারেখা যদি ঘুচে যায়, তাহলে তা সমাজের জন্য শুভকর হবে না। একটি জিনিস ভুলে গেলে চলবে না- প্রতিটি সফল আন্দোলনের পেছনে থাকে গণ-আন্দোলনের শক্তি এবং বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব। বর্তমানে ছাত্রদের সেই নেতৃত্ব দুর্বল, এবং এই শূন্যতা পূরণ করছে নানা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তারা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এখানেও বিবেচ্য।
প্রশ্ন হলো- রাজনৈতিক দলগুলো কি শিক্ষার্থীদের আবেগকে ইন্ধন দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দরকার একটি বহুমাত্রিক উদ্যোগ। এজন্য সবার আগে দরকার শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার আনা। মানসম্মত শিক্ষা, দ্রুত পরীক্ষা ও ফল প্রকাশ, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং ক্যাম্পাসভিত্তিক স্বচ্ছ প্রশাসন নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তাদের শেখাতে হবে আন্দোলনের পদ্ধতি ও যৌক্তিকতা। কীভাবে দাবি জানাতে হয়, কীভাবে রাজনৈতিক অপশক্তির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়- এই শিক্ষাও দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সংযম ও নৈতিকতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। তারা যেন ছাত্রদের নিজেদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে।
ছাত্র রাজনীতি থাকতে পারে; কিন্তু তা হতে হবে আদর্শভিত্তিক, দায়িত্বশীল। ছাত্রদের নিজ কর্তব্যে ফিরিয়ে আনতে হলে অভিভাবক ও শিক্ষকের দায়িত্ব নিতে হবে। ছাত্রদের আবেগ বুঝে তাদের সঠিক পথে রাখতে হবে। সমাজে শিক্ষার্থীদের শক্তি যেন গঠনমূলক কাজে ব্যবহৃত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। এখন সময় এসেছে গভীর আত্মবিশ্লেষণের। রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক ও রাজনীতিকদের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী নীতিমালা তৈরি করতে হবে যাতে ছাত্রদের যৌক্তিক প্রতিবাদকে প্রণোদনা দেওয়া হয়, কিন্তু একইসঙ্গে অপব্যবহার ও অপপ্রয়োগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। ছাত্রদের আন্দোলন যেন আর কখনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বর্ম না হয়ে ওঠে।
অবশেষে বলতেই হয়- ছাত্রদের শক্তি দেশের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে ব্যবহার হয়। কিন্তু যদি সেই শক্তিকে ব্যবহারের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে- তা ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্র- তিনটির জন্যই। সুতরাং, প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান- যেখানে শিক্ষার্থীরা সচেতন থাকবে, প্রতিবাদ করবে, তবে নিজেদের মূল দায়িত্ব লেখাপড়াকে কখনো বিসর্জন দেবে না। এই ভারসাম্যই হোক আগামী দিনের মূলমন্ত্র।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে