প্রত্যেক নাগরিকের জন্য শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করা প্রয়োজন
সংযোগ: একটি অপরিহার্য প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়
বাংলাদেশের ডিজিটাল যাত্রা শুধু প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধি নয়। ডিজিটাল যাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত দেশের মানুষ। দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষকে ডিজিটাল সেবায় সমান প্রবেশাধিকার, সমান সুযোগ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশে ডিজিটাল যাত্রা এগিয়ে চলেছে।
রংপুরের একজন শিক্ষার্থী যেন বিনা বাধায় অনলাইনে ক্লাস করতে পারে, নারায়ণগঞ্জের দোকানদার যাতে সহজেই মোবাইল পেমেন্ট নিতে পারে, পাহাড়ি অঞ্চলের কোনো শিক্ষক যেন অনলাইনে বই অর্ডার করতে পারে, কিংবা সিলেটের প্রবীণ বাবা-মা বিদেশে থাকা সন্তানের সঙ্গে ভিডিওকলে সুখ-দুঃখের মুহূর্ত ভাগ করে নিতে পারে- এ চিত্র এখন আর মানুষ কল্পনায় সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। এটি তাদের বাস্তবিক প্রত্যাশা।
ডিজিটাল সংযোগ বা কানেকটিভিটি বর্তমানে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা এমনকি সম্পর্ক স্থাপনের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এই প্রাণকেন্দ্র সচল ও শক্তিশালী রাখতে চাইলে প্রয়োজন উন্নত নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ। যেহেতু মোবাইল নেটওয়ার্ক ডিজিটাল সংযোগের মূল চালিকাশক্তি, তাই দেশের প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি ঘরে উন্নত মোবাইল নেটওয়ার্ক পৌঁছে দিতে হবে। তবে সার্বিকভাবে নিশ্চিত হবে দেশের ডিজিটাল অগ্রগতি।
আমাদের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি মোবাইল ব্যবহারকারীর আবাসস্থল। এদিকে টাওয়ার সংখ্যা আছে ৪৬ হাজার। অর্থাৎ, প্রতি ১০ লাখ গ্রাহকের জন্য রয়েছে মাত্র ২৬২টি টাওয়ার। ধারাবাহিক সেবার মান, অর্থাৎ কোয়ালিটি অব সার্ভিস (কিউওএস) বজায় রাখতে গ্রাহকসংখ্যার অনুপাতে যে সংখ্যাটি তুলনামূলক অনেক কম। ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নেটওয়ার্ক সংকট প্রকট আকারে দেখা দেয়। অতিরিক্ত মোবাইল ডেটা ব্যবহার আর নিরবচ্ছিন্ন চাহিদা তো রয়েছেই, তার ওপর উঁচু উঁচু বিল্ডিংগুলো নেটওয়ার্ক বিস্তারে নানারকম বাধা সৃষ্টি করে।
ফলে পর্যাপ্ত টেলিকম টাওয়ার না থাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকা হঠাৎ কভারেজ শূন্য হয়ে যায়, গ্রাহকদের বিচ্ছিন্ন করে দেয় গোটা সংযোগ ব্যবস্থা থেকে। অথচ আমরা এমন একটি সময়ে বাস করছি, যেখানে প্রতিটি কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সংযোগ বা কানেকটিভিটি। এখানে এক মুহূর্তের জন্যও সংযোগহীন হয়ে যাওয়া মানে অনেকটুকুই পিছিয়ে যাওয়া। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য মোবাইল অপারেটররা স্পিড বাড়ানো থেকে শুরু করে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানোসহ প্রতিনিয়ত নানা রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করছে; কিন্তু তা কেবলই সাময়িক সমাধান হিসেবে কাজ করছে।
শহর থেকে একটু বের হলেই দেখা মেলে সেই চেনা দৃশ্যপট- মোবাইল নেটওয়ার্কের দৈন্যদশা। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ অবস্থা আরও করুণ। ফলত দেশের বড় অংশের গ্রাহকই ভুক্তভোগী হয়ে থাকছেন, ডিজিটাল সেবা গ্রহণেও হচ্ছেন বঞ্চিত।বিগত বছরগুলোতে ডিজিটাল যাত্রায় বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য, কোনো সন্দেহ নেই। তবে চাহিদা মোতাবেক অবকাঠামো বিনির্মাণ করা যায়নি বলে বড় একটা ব্যবধান রয়েই গেছে। এই ব্যবধান কমানোর পরেই মূলত টের পাওয়া যাবে- উন্নত সংযোগ বা কানেকটিভিটি মানুষের জন্য কোনো বাড়তি সুবিধা নয়, বরং নাগরিক অধিকার।
শহর-গ্রাম বিভাজন
টেলিযোগাযোগ নিয়ে সম্প্রতি এক মিশ্র চিত্র পরিলক্ষিত হয়। কাগজে কলমে দেশের ৮৮ শতাংশ থানাগুলোতে ইন্টারনেট কভারেজ রয়েছে; কিন্তু এই সংখ্যার মধ্যে খানিকটা শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। দেখা যায়, থানাগুলোর শহরাঞ্চল আর গ্রামাঞ্চলের মধ্যে নেটওয়ার্ক কভারেজে রয়েছে প্রকট বৈষম্য। শহরাঞ্চলের ৯৭ শতাংশ এলাকা ইন্টারনেট কভারেজের মধ্যে থাকলেও গ্রামীণ এলাকার বড় একটা অংশে কোনো নেটওয়ার্ক কভারেজ নেই। থানাগুলোর ২৪ শতাংশ গ্রামীণ অঞ্চলের বাসিন্দারা সংযোগ থেকে রয়েছেন যোজন যোজন দূরে। শুধু তাই নয়, দেশের ৫৮টি অঞ্চল এখনো পুরোপুরি ডিজিটাল মানচিত্রের বাইরে। অর্থাৎ, এইসব এলাকার মানুষজন সকল রকমের ডিজিটাল সেবা থেকে বঞ্চিত।
এই পরিসংখ্যান কেবল সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়, প্রতিদিন হাজার লাখ মানুষ এই সংযোগহীনতার কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। গ্রামীণ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে ধীরগতির ইন্টারনেট নিয়ে কচ্ছপের গতিতে এগুচ্ছে, যেখানে তাদের শহুরে সহপাঠীরা ইন্টারনেটের সংযোগ তুলনামূলক ভাল পাওয়ায় পড়াশোনায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। করোনাকালীন যখন শিক্ষার্থীদের ভার্চুয়াল ক্লাস দেয়া হলো, তখন এই বৈষম্যটুকু তীব্রভাবে প্রত্যক্ষ করেছে দেশের মানুষ। শুধু শিক্ষাখাতেই নয়, ব্যবসা বাণিজ্যেও ইন্টারনেটের প্রভাব ব্যাপক। রিয়েল-টাইম বাজারদর সম্পর্কে অবগত থাকা ব্যবসার আয়ের ক্ষেত্রে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অথচ মন্থর গতির ইন্টারনেট থাকায়, কিংবা ইন্টারনেট না থাকার কারণে প্রান্তিক কৃষকরা রিয়েল-টাইম বাজারদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এছাড়া শহরাঞ্চলে বর্তমানে জনপ্রিয় ইন্টারনেট সেবাগুলোর মধ্যে অন্যতম টেলিমেডিসিন সেবা। ঘরে বসেই শহুরে মানুষ ইন্টারনেটের মাধ্যমে চিকিৎসকের পরামর্শ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় ওষুধ পত্র বা অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন, যা জরুরি অবস্থায় ভীষণ কার্যকরী। অথচ প্রান্তিক এলাকার মানুষগুলোর জন্য এ সেবাপ্রাপ্তি বর্তমানে কল্পনার বাইরে। বাংলাদেশের শহরগুলো দ্রুত ফোর-জি প্রযুক্তি গ্রহণ ও ফাইভজি গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে বেশিরভাগ মফস্বল ও গ্রামগুলো এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। তাদের জন্যও উন্নত সংযোগের ব্যবস্থা করে এই ব্যবধান দ্রুত কমিয়ে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা উচিত। তবেই ডিজিটাল খাতে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে, পাশাপাশি দেশের ডিজিটাল অর্থনীতিও সমৃদ্ধ হবে।
সেবার মানোন্নয়নে কেবল কভারেজ নিশ্চিত করাই নয়
এখন প্রশ্ন আসতে পারে- মোবাইল স্ক্রিনের সিগন্যাল বার পূর্ণ থাকলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? না, সিগন্যাল বার সবসময় পুরো গল্প বলে না। তাহলে প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মানুষের কলড্রপ হওয়া, ভিডিওকলে হঠাৎ আটকে যাওয়া বা অন্য কোনো অ্যাপ থেকে আচমকা ডিসকানেক্টেড হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতো না। সত্যিকারের কোয়ালিটি অব সার্ভিস বা ধারাবাহিক সেবার মান নির্ভর করে লেটেন্সি (প্রতিক্রিয়া সময়), থ্রুপুট (ডেটা গতি) ও রিলায়েবিলিটির (নির্ভরযোগ্যতা) ওপর। ধারাবাহিক সেবার মানের (কিউওএস) ওপর নির্ভর করে একজন গ্রাহক ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করে ডিজিটালি আরও সক্ষম হবেন, নাকি হতাশ হবেন। কিউওএস যত উন্নত হবে, গ্রাহকের অভিজ্ঞতা তত স্মুদ এবং ফাস্ট হবে। গ্রাহক তত বেশী ডিজিটালি সক্ষম হবেন।
ধারাবাহিক সেবার মান বজায় রাখার জন্য দুটি বিষয় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ
১. ব্যাকহল ক্যাপাসিটি: টেলিকম টাওয়ারগুলোতে শক্তিশালী ফাইবার সংযোগ ছাড়া উন্নত রেডিও যন্ত্রপাতিও অকেজো হয়ে যায়। অর্থাৎ, ফাইবার হলো অদৃশ্য মহাসড়কের মতো, যেটি দিয়ে ডেটা অতিক্রম করে। যদি এই রাস্তা মসৃণ না হয়, তবে ডেটা আটকে সবকিছু ধীরগতির হয়ে যায়।
২. ইনডোর কভারেজ: মোবাইল ব্যবহার এর ৭০ শতাংশের বেশি ঘরের ভেতরেই হয়ে থাকে; কিন্তু মোটা দেয়াল ও পুরোনো অবকাঠামো সিগন্যালে বাঁধা সৃষ্টি করে। যে কারণে হাসপাতাল, শপিং মল, স্কুল বা অফিসগুলো প্রায়ই ‘ডেড জোন’-এ পরিণত হয়, যেখানে কোনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।
৩. দৈনন্দিন জীবনকে বাধামুক্ত আর স্মুদ রাখতে ধারাবাহিক সেবার মান (কিউওএস) উন্নত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটিই নির্ধারণ করে কোনো স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক শুধু নামমাত্রে আছে, নাকি সত্যিকার অর্থে সংযোগ আছে।
সেবার মান বজায় রাখতে ফাইবার: যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড
বাংলাদেশের অসংখ্য টেলিকম টাওয়ার এখনো শুধু মাইক্রোওয়েভ লিঙ্কের ওপর নির্ভর করে চালু আছে, যা আধুনিক যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। অন্যদিকে ফাইবার অধিক সক্ষম, কার্যকরী স্থিতিশীল এবং কম লেটেন্সিপূর্ণ মাধ্যম। নিরবচ্ছিন্ন ফোর-জি এবং ফাইভ-জি প্রস্তুতির জন্য এটি অপরিহার্য বিষয়। উন্নত সেবার মান বজায় রাখতে নাগরিক কেন্দ্রিক রোলআউট প্রয়োজন। আর তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন-
* শহুরে হটস্পটগুলোতে ফাইবার প্রয়োগ: ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্রমবর্ধমান ডেটা ট্রাফিকের চাপ সামলাতে এ দুই শহরে সম্পূর্ণভাবে ফাইবার প্রয়োগ করা উচিত।
* জেলা শহরগুলোর জন্য ফাইবার রিং: এই রিংয়ের সহনশীল লুপগুলো তার কেটে গেলেও রিডান্ডেন্সি এবং আপটাইম নিশ্চিত করে উন্নত কভারেজ নিশ্চিত করে।
* প্রত্যন্ত অঞ্চলে হাইব্রিড ব্যাকহল: যেখানে ফাইবার স্থাপন করা অবাস্তব ঠেকে, সেখানে উচ্চ-ক্ষমতার ওয়্যারলেস ব্যাকহল একটি সেতু হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে তুলনামূলক উন্নত সংযোগ নিশ্চিত হয়। ফাইবার কেবল একটি অবকাঠামোগত বিষয় নয়। উন্নত সংযোগ নিশ্চিত করতে এটি একটি অপরিহার্য মাধ্যম, যা বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বিল্ডিংয়ের ভেতরের নেটওয়ার্ক সমস্যায় করণীয়
দারুণ আউটডোর কভারেজ রয়েছে এমন এলাকাগুলোতেও অনেক সময় ইনডোর সিগন্যাল ভঙ্গুর হয়ে যায়। কেননা বিল্ডিংগুলোতে ব্যবহৃত মোটা কংক্রিট, ধাতব কাঠামো এবং শক্তি-সাশ্রয়ী কাচ রেডিও তরঙ্গ চলাচলে বাধা দেয়। ফলে অফিস, হাসপাতাল এবং স্কুলগুলোতে অনেক সময় গ্রাহক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রতিটি অপারেটরের জন্য আলাদা আলাদা ইনডোর সিস্টেম স্থাপন করা অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও ঝামেলাপূর্ণ। এই সমস্যার আধুনিক বিকল্প সমাধান হলো নিউট্রাল-হোস্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার।
নিউট্রাল হোস্ট: আধুনিক, পরিবেশবান্ধব, দ্রুতগতির সমাধান
নিউট্রাল-হোস্ট হলো এমন একটি শেয়ার্ড ব্যবস্থা, যেখানে একটি কমন সোর্স থেকে সব অপারেটরকে পরিষেবা দেয়া হয়। নিউট্রাল হোস্ট সিস্টেমের একাধিক সুবিধা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো-
* খরচ সাশ্রয়: শেয়ার্ড সিস্টেমগুলো মূলধন এবং পরিচালন ব্যয় ৫০ শতাশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়।
* শক্তি সাশ্রয়: গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত কম শক্তি খরচ করে, যা টেকসই লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখে।
* দ্রুত স্থাপন: চারটি ইন্সটলেশনের পরিবর্তে একটি ইন্সটলেশন রোলআউটকে দ্রুত করে এবং ঝামেলা কমায়।
নিউট্রাল-হোস্ট সমাধানগুলো সাধারণত বড় মার্কেটগুলোতে ব্যবহৃত হয়। তবে মার্কেট ও বিমানবন্দরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যেসব জায়গায় কানেক্টিভিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেমন- বিদ্যালয়, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, পরিবহন কেন্দ্র এবং নতুন আবাসিক কমপ্লেক্সগুলোতেও প্রসারিত করা উচিত।
জেলাভিত্তিক চিত্র যেমন
জেলাভিত্তিক নেটওয়ার্ক পরিস্থিতির দিকে যদি তাকাই, তাহলে আমরা একটা অসম চিত্র দেখতে পাই। উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে স্থানভেদে যেখানে প্রয়োজন অনুযায়ী ভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। যেমন-
* ঢাকা উত্তর: একাধিক সার্ভিস প্রোভাইডার থাকা সত্ত্বেও হাসপাতাল এবং উঁচু ভবনগুলোতে এখনো ইনডোর কভারেজের ঘাটতি রয়েছে।
* ঢাকা দক্ষিণ: সরু রাস্তা এবং পুরোনো ভবনগুলোতে কাস্টম-মেড ইনডোর সমাধানের প্রয়োজন।
* গাজীপুর: শিল্প খাতের প্রসারের কারণে নেটওয়ার্ক অবকাঠামো সম্প্রসারণ ও ফাইবারের জরুরি প্রয়োগ প্রয়োজন।
* নারায়ণগঞ্জ: শেয়ার্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচারগুলো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির পুনরাবৃত্তি কমিয়ে দ্রুত পরিষেবা নিশ্চিত করে।
* চট্টগ্রাম সিটি: বাণিজ্যিক অঞ্চলগুলোতে নিউট্রাল-হোস্ট সিস্টেমগুলো কার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে।
অর্থাৎ, মানোন্নত ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করতে কেবল সর্বোত্র টাওয়ার সংখ্যা বাড়ালেই হবে না। প্রয়োজন আধুনিক, লক্ষ্যযুক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে ডিজিটাল অগ্রগতিতে এগিয়ে নিতে যথাযথ প্রযুক্তির প্রয়োগ।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
ডিজিটাল দুনিয়া প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আজকের দিনে ইন্টারনেট ব্যবহারে বড় অংশজুড়ে আছে ভিডিও, রিলস, ভিডিও গেম; কিন্তু আগামী দিনের চাহিদায় যোগ হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) চালিত অ্যাপ্লিকেশন, যেমন: জেনারেটিভ এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট, রিয়েল-টাইম অ্যানালিটিক্স, আইওটি ইত্যাদি। এই ধরনের কাজগুলোর জন্য প্রয়োজন অতি-কম লেটেন্সি, বিশাল ব্যান্ডউইথ এবং নিরবচ্ছিন্ন কভারেজ।
কিন্তু বাস্তবতা যা বলছে
* ঘন কভারেজ এবং শক্তিশালী সক্ষমতা ছাড়া ফাইভ-জি কার্যকর হতে পারবে না।
* নেটওয়ার্ক যদি বিচ্ছিন্ন থাকে, তাহলে আরএমজি, লজিস্টিকস এবং ম্যানুফ্যাকচারিং-এর মতো শিল্পগুলো আইওটি ও অটোমেশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে।
* স্পেকট্রাম বিষয়ে দ্রুত কার্যকরী সিদ্ধান্ত না নিলে বাংলাদেশ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে পিছিয়ে পড়বে।
সুতরাং, দ্রুততার সঙ্গে ন্যায্য ফাইভজি-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া, গ্রাম ও শিল্পাঞ্চলে কভারেজ বাড়ানো এবং আরও বেশি টাওয়ার ও ফাইবার স্থাপন করতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
নাগরিককে অগ্রাধিকার দিয়ে রোলআউট পরিকল্পনা যেমন হতে পারে
শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কভারেজের আওতায় থাকা নাগরিকের একটি জাতীয় অগ্রাধিকার। আর তা বাস্তবায়নের জন্য পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো:
১. অনুমতি সহজ করা: সংযোগে বিলম্ব ঠেকাতে ও খরচ কমানোর জন্য সহজে অনুমোদন দেয়ার ব্যবস্থা চালু রাখা
২. স্পেক্ট্রামের সর্বোত্তম ব্যবহার: এমনভাবে ন্যায্য মূল্য নির্ধারণ করা উচিত যেন গ্রামীণ এলাকা পিছিয়ে না থাকে।
৩. ফাইবার স্থাপনের গতি বাড়ানো: শহরাঞ্চলকে ফাইবারের আওতায় আনা, জেলা পর্যায়ে লুপ তৈরি করা এবং প্রান্তিক অঞ্চলগুলোকে ওয়্যারলেস ব্যাকহলের মাধ্যমে সংযুক্ত করা।
৪. গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে শেয়ারিং বাধ্যতামূলক করা: হাসপাতাল থেকে স্টেডিয়াম-¬¬ পাবলিক জায়গাগুলোতে শেয়ারড সিস্টেমকে প্রাধান্য দেয়া।
৫. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের যথাযথ সমন্বয়: নেটওয়ার্ক ব্যবধান কমাতে অর্থায়ন, নীতি এবং বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার ও শিল্পের মধ্যে সমন্বয় সাধন।
সাফল্যের মাপকাঠি
বাংলাদেশের ডিজিটাল ভবিষ্যৎ কতটুকু সফল হলো, বা কতটুকু অগ্রগতি হলো তা নিরূপণে কিছু বৈশিষ্ট্যকে লিটমাস টেস্ট হিসেবে ধরা যায়। যেমন-
* কলড্রপ কমে যাওয়া: সর্বত্র নির্ভরযোগ্য ভয়েস এবং ভিডিও কল নিশ্চিত হবে।
* শক্তিশালী ইনডোর সিগন্যাল: অফিস, শপিংমল এবং হাসপাতালগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ পাওয়া যাবে।
* গ্রামীণ অন্তর্ভুক্তি: যে গ্রামগুলো ডিজিটাল সেবায় পিছিয়ে আছে, সেগুলো অনলাইন শিক্ষা, কৃষি সংক্রান্ত পরামর্শ এবং টেলিমেডিসিনের জন্য প্রথম সারিতে আসবে।
* সাশ্রয়ী অ্যাক্সেস: শেয়ারড অবকাঠামো খরচ কমায় এবং উদ্ভাবনের পথ খুলে দেয়। ফলে ইন্টারনেট সেবা প্রাপ্তিতে খরচ কমবে।
* শিল্প ৪.০ অর্জন: আইওটি এবং এআই এর সহযোগিতায় আরএমজি এবং উৎপাদন শিল্প বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে।
নাগরিক কেন্দ্রিক সংযোগ ব্যবস্থা শুধু নেটওয়ার্ক তৈরি করা নয়, এটি দেশের শহর আর গ্রামের মধ্যে একটি সেতু তৈরি করা। শুধু তাই নয়, ধনী ও গরিবের মধ্যে, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে ব্যবস্থাটি। প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি নাগরিকের জন্য শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপন করার মাধ্যমে বাংলাদেশের ডিজিটাল প্রতিশ্রুতির সফল বাস্তবায়ন হবে।
সুনীল আইজ্যাক : কান্ট্রি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ইডটকো বাংলাদেশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে