Views Bangladesh Logo

প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করুন

লিটিক্স গ্রন্থে রাজনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অ্যারিস্টটল বলেছেন, রাজনীতি হচ্ছে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বিভিন্ন পক্ষের সন্ত্রাসবিহীন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান। বহু দ্বন্দ্ব-বিরোধ, রক্তপাত, সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে মানুষের এই সভ্যতা একটি সুষ্ঠু-সুন্দর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অনেক তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়েই প্রাচীন গ্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে আধুনিক ইউরোপীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা হয়েছে। পৃথিবীতে এখন যতগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে তার মধ্যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই সবচেয়ে বেশি কাম্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকলে আসলে আর কিছুই থাকে না।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বলবৎ আছে; কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের রাষ্ট্রে খুব বেশি সুসংহত হয়নি। বারবারই আমাদের রাষ্ট্র হুমকির মধ্যে পড়ে। কয়েকটি ক্যু-এর পর দীর্ঘ সামরিক শাসনের পরে একটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে মোটামুটি একটি সহনশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে এসেছিল। ২০০৭ সালে প্রচণ্ড রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে নির্বাচন ভেস্তে যায় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে এবং দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচনবিহীন দেশকে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যায়।

এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা দেখেছি বাংলাদেশে প্রায় সবসময়ই প্রতিহিংসার রাজনীতি কমবেশি বহমান। এক পক্ষ ক্ষমতায় আসলে আরেক পক্ষকে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে হয়। শুধু যে রাজনৈতিক সন্ত্রাস, সহিংসতা তা না; বরং অনেক সময় তা ব্যক্তিগত রেষারেষি, কুৎসা রটানো, এমনকি খুবই নিম্নরুচির গালাগালিতে পর্যবসিত হয়। দলীয় স্বার্থের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে বিপক্ষ দলকে খুবই নোংরা ভাষায় গালাগালি করতে আমরা দেখেছি। এর হাত থেকে জাতীয় নেতারাও রেহাই পাননি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীর স্থপতি, এটা বিতার্কিকভাবেই সত্য। তার লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন তার সময়ের দেশ-বিদেশের পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গসহ বিশ্বনেতৃবৃন্দ পর্যন্ত; কিন্তু আজ দেশের একটা বিশেষ গোষ্ঠী, যাদের অনেকের বয়স ৩০-৪০ হয়নি এখনো, তাকে খুবই অপমানজনক ভাষায় আক্রমণ করছেন। গতকাল ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শোক দিবস পালিত হয়নি এবং অনেকে বঙ্গবন্ধুকে খুবই খারাপ ভাষায় আক্রমণ করে কথা বলেছেন। এতে আমাদের জাতির কী লাভ হলো?

ঠিক একই চিত্র দেখা যায় জিয়াউর রহমানের ক্ষেত্রেও। তাকে একটা পক্ষ খুবই খারাপ ভাষায় আক্রমণ করে কথা বলে। অথচ আমাদের জাতির ইতিহাসে তার অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। জিয়াউর রহমান নিজে কখনো জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে খারাপ কথা বলেননি। খারাপ ভাষায় কথা বলা তো দূরের কথা, ঘুণাক্ষরে কোথাও কোনো ইঙ্গিতও দেননি।

বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো কারও প্রতি বিদ্বেষবশত কথা বলেছেন, বিপক্ষ রাজনৈতিক দল বা নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্য করে বাজে কথা বলেছেন এমন উদাহরণ নেই। ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা জানি সে সময় বিরোধী পক্ষকেও সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। রাজনীতির মাঠে ভিন্ন ধারার রাজনীতি করলেও একসঙ্গে বসলে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতেন।

কিন্তু আজ কী লজ্জাজনক প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু হলো আমাদের দেশে! এক পক্ষ আরেক পক্ষকে গালাগালি ছাড়া যেন কথাই বলতে পারেন না। যখনই যারা ক্ষমতায় আসেন তারাই যেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেন, ভিন্ন পক্ষের তখন জীবন নিয়ে পালাতে হয়; কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকা, এমনকি ভারতের রাজনীতি থেকেও তো আমরা দেখছি তাদের মধ্যে এখনো পরস্পরের মধ্যে শ্রদ্ধা বহমান। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নতুন প্রেসিডেন্ট যখন ক্ষমতায় অধিগ্রহণ করেন তখন উদ্বোধনী সভায় জীবিত সব প্রেসিডেন্টকে উপস্থিত থাকতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কি এটা এখনো কল্পনা করা সম্ভব?

এতটা অসহিষ্ণু হলে আমরা কীভাবে একটা সুষ্ঠু-সুন্দর রাষ্ট্র গঠন করব? আমাদের রাজনীতিবিদদের এই সংঘাত-প্রতিহিংসা কি চলতেই থাকবে যুগের পর যুগ? অন্তর্বর্তী সরকার পারতো এই ব্যবধান ঘোচাতে। গণ-অভ্যুত্থানের পর এটাই আমাদের কাম্য ছিল; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়, গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বস্থায়ী সমন্বয়করা, যাদের অনেকে পরবর্তীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসেছেন বা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল খুলে নতুন বন্দোবস্তের রাজনীতি শুরু করেছেন, তাদের কাছ থেকেও আমরা সেরকম সৌজন্যমূলক কথা শুনতে পেলাম না।

বাংলাদেশে আজ যেরকম বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে তার হাত থেকে আমাদের কবে মুক্তি ঘটবে? জাতীয় নেতাদের অবদানকে অস্বীকার করে আমরা ফল লাভ করব? নতুন প্রজন্মকেই আমরা কি শিক্ষা দেব? রাজনীতি-জীবনে ভুলত্রুটি থাকবেই। পৃথিবীর কোনো মানুষই ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে না। সেখানে বড় রাজনীতিবিদদের বড় বড় ভুল থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা বড় মানুষ। তাদের এসব ভুলত্রুটির জন্য পক্ষে-বিপক্ষে নানা সমালোচনা থাকবে যা দিয়ে নতুন প্রজন্ম নতুন কিছু শিখবে; কিন্তু তাদের একেবারে অস্বীকার করে দিয়ে, ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার চেষ্টা করে আমরা কেবল নিজের ইতিহাসকেই কবর দেব। তাতে আমরা জাতি হিসেবে কেবল শূন্যই হব, গর্ভ করার মতো আমাদের কিছু থাকবে না।


তাই এখনই এই প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করুন। সরকার থেকে শুরু করে প্রতিটা রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, এমনকি সাধারণ জনগণকেও আজকে এই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে, আমরা আর প্রতিহিংসার রাজনীতি চালু রাখব না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ