Views Bangladesh Logo

ঝুঁকিতে দেড়শ পাহাড়

পাহাড়খেকোদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করুন

বিশ-বাইশ বছর আগেও চট্টগ্রাম নগরে গেলে অনেক ছোট-বড় পাহাড় চোখে পড়ত। আঁকাবাঁকা পথের মাঝ দিয়ে এসব সবুজ পাহাড় ছিল চোখ জুড়ানোর মতো। শহর বর্ধিত করতে, রাস্তাঘাট, নানারকম অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে অনেক পাহাড় কাটা হয়েছে নির্মমভাবে। এর মধ্যে পাহাড়খেকোদের কোপে পড়ে অনেক পাহাড় বিলীন হয়েছে; কিন্তু এবার জানা গেল চোখ কপালে তোলার মতো এক খবর। গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, জরিপের ভুলে বিলীনের ঝুঁকিতে দেড়শ পাহাড়।

প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, চট্টগ্রাম নগর এবং এর পাশের দুই উপজেলা হাটহাজারী ও সীতাকুণ্ডে দেড় শতাধিক পাহাড়-টিলাকে বিএস জরিপে ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব পাহাড়-টিলার জমির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৪০০ একর। তবে ১৯৭০ সালে জরিপ শুরুর সময় কত পরিমাণ জমির পাহাড়-টিলা এমন ভুলভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছিল এবং কাটা হয়েছিল সে হিসাব পাওয়া যায়নি। কোথাও এসব পাহাড়-টিলার পুরোটাই, কোথাও আবার অংশবিশেষকে ‘শণখোলা’, ‘নাল’, ‘খিলা’, ‘বাড়ি’ ইত্যাদি শ্রেণিতে নথিভুক্ত করা হয়েছে। সরকারি জরিপের এমন ভুলের সুযোগ নিয়ে চলছে পাহাড়-টিলা কেটে স্থাপনা নির্মাণ।

প্রশ্ন হচ্ছে, জরিপে এত বড় ভুল কী করে ঘটল? আর ঘটলই যখন তা এতদিনে সংশোধন হলো না কেন? আর ভুল ঘটলেই এভাবে পাহাড় কাটতে হবে? প্রশাসনের উদ্যোগে কোনোভাবেই তা বন্ধ করা গেল না? চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে বসতি নির্মাণসহ নানা কারণে পাহাড় কাটা হচ্ছে। ১৯৯০ সালে ১৫৬ বর্গকিলোমিটারের চট্টগ্রামে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ২৩ লাখ। সিটি করপোরেশনের হিসাবে একই আয়তনের চট্টগ্রাম নগরে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। বিপুল এই জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে প্রশাসনকেও প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসের মতো বিষয়ে হাত দিতে হচ্ছে।

২০১০ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাহাড়-টিলা কাটা নিষিদ্ধ। কেবল জাতীয় স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে পাহাড় কাটা যেতে পারে। তবে আইনে কড়াকড়ি থাকলেও জরিপে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়া পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধ করা কিছুটা কঠিন। এ ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করতে গিয়ে নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। ভূমি জরিপে ভিন্ন নামে শ্রেণিভুক্ত হওয়া পাহাড়-টিলা কাটা হলে এর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় পরিবেশ অধিদপ্তরকে। পাহাড় কাটার অভিযোগে মামলা করা হলেও আদালতে প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, একটি ভূমি এলাকাকে আদালতে যতই পাহাড় বলা হোক, জরিপ-খতিয়ানে কীভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে সেটিই আদালত গুরুত্ব দেন।

কিছুদিন আগেই পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে পাহাড় ও টিলা কাটার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসকদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছেন। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ধস, বন্যা, জলাবদ্ধতা, পরিবেশদূষণ, জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও ভূমি ক্ষয়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে। এ বিধ্বংসী কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

এসব কথা আমরা সবাই জানি; কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রয়োগ দেখি না। গবেষকরা জানান, পাহাড় ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্লেটকে দৃঢ়ভাবে আটকে ধরে রাখে। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে পাহাড় ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্তরে ভূকম্পন প্রতিরোধ করে। পাহাড় বিলীন হলে বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল হারানোসহ নানা পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়। পাহাড় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এটির সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার যেমন সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি অনেক প্রাণিকুলেরও এটি আশ্রয়স্থল। পাহাড় কাটা হলে এর প্রভাবে জীববৈচিত্র্য হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়, খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হয়।

ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, সেটা হয়তো আর পোষানো যাবে না; কিন্তু এখনো যদি শেষ রক্ষা করা যায় প্রশাসনের উচিত সেটুকু রক্ষা করা। যেভাবেই হোক পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে। জরিপে যদি ভুল উঠে থাকে তাহলে সেই জরিপও সংশোধন করতে হবে। কোনো অজুহাতেই পাহাড় কাটার মতো প্রকৃতির ধ্বংস চলতে পারে না। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে এখনই কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ