অপবাদ ছড়িয়ে গণপিটুনিতে হত্যা: এই বর্বরতা বন্ধ করুন
অপবাদ ছড়িয়ে গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা বাংলাদেশে প্রায় মহামারির মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বহু আলোচনা-সমালোচনার পরও এই ধরনের বিচারবহির্ভূত ঘটনা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। আজ শনিবার (২৩ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দেশের তিন জেলায় গত বৃহস্পতিবার রাত ও গতকাল শুক্রবার অপবাদ ছড়িয়ে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, এদের একজন কিশোর, একজন তরুণ এবং একজন যুবক। নিহতদের দুজনকে চোর সন্দেহে এবং একজনকে চাঁদাবাজির অভিযোগে পেটানো হয়। এর মধ্যে দুটি ঘটনা পরিকল্পিত বলে পুলিশ সন্দেহ করেছে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই এ ধরনের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই কয়েকদিন আগেই রংপুরের তারাগঞ্জে ভ্যানচোর সন্দেহে দুই ব্যক্তিকে পিটিয়ে মারা হলো। এ নিয়ে চলতি মাসেই গণপিটুনিতে ১৪ জনের প্রাণ গেল। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১০৩ জন। ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। তার মানে এ বছর গণপিটুনির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। গণপিটুনির বিভিন্ন ঘটনায় আমরা এমন সব ঘটনা দেখেছি যা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। আমরা দেখেছি বুকের ওপর পাথর ছুড়ে থেঁতলে মারার ঘটনা, ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে আহত করে পথচারী সেতুর সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার ঘটনা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চোর সন্দেহে তিন কিশোরকে সেতুর রেলিংয়ে বেঁধে বেধড়ক পেটানোর ঘটনাই অত্যন্ত বর্বরোচিত।
দেশে গণপিটুনি বা মব সহিংসতা বন্ধের কার্যক্রম নিয়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও কার্যত তার কোনো ফল হচ্ছে না। গণপিটুনি ও মব সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেন; কিন্তু শুধু আইনশৃঙ্খলার অবহেলাই কি এর জন্য দায়ী? না কি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের সহিংসতা বেড়ে যাওয়াও এর কারণ।
কেন হঠাৎ একটি জনগোষ্ঠী এমন মারমুখী হয়ে উঠল- এর কারণটি সামাজিক গবেষণার দাবি রাখে। সমাজে নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে মানুষ এখন এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাই মানুষের মধ্যে নানারকম অপরাধপ্রবণতার জন্ম দেয়। একদিকে একদল মানুষ বেকার, তারা জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে অন্যদিকে আরেক শ্রেণির মানুষ নিরাপত্তার অভাবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর আস্থার অভাবে বিচারের দায় নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন।
যেদিক থেকেই ব্যাখ্যা করা হোক, এটাকে বর্তমান সরকারের ব্যর্থতারই ফল। সরকার না পারছে মানুষকে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা দিতে, না পারছে যথাযথ নিশ্চয়তা দিতে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধের শিকার হওয়ার আতঙ্ক থেকে মানুষ আইন হাতে তুলে নিতে পারে। সেটা ঠেকাতে অপরাধ দমাতে হবে। আবার যারা আইন হাতে তুলে নেন, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
তবে, শুধু আইন দিয়েই যে এই অপরাধ-প্রবণতা বন্ধ করা যাবে তা না। সমাজের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস, সহমর্মিতা, সহনশীলতা বাড়ানো ছাড়া এর থেকে মুক্তি নেই। আর এ জন্য সুষ্ঠু-সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশও গড়ে তুলতে হবে। এসব কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। সমাজ-রাষ্ট্রে যখন সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ব্যাহত হয় তখন এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যায়। এই বর্বরতা দমনে সরকার ও জনগণের একযোগে কাজ করার বিকল্প নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে