দ্বৈত সংকটে ঢাকাবাসী
দক্ষিণে অচলাবস্থা, উত্তরে ঈদ প্রস্তুতির তৎপরতা
আসন্ন ঈদুল আজহা ও বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে রাজধানীবাসীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। প্রতি বছরই কোরবানির পশুর বর্জ্য দ্রুত ও সুষ্ঠুভাবে অপসারণের বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকে ঢাকার দুই (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটির বাসিন্দা। এর সঙ্গে এবার যুক্ত হয়েছে অকাল বর্ষণের প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা। সামান্য বৃষ্টিতেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়কে পানি জমে যান চলাচলে স্থবিরতা দেখা গেছে। এর মধ্যে যদি কোরবানির ঈদে সুষ্ঠুভাবে বর্জ্য অপসারণ না করা হয়, তাহলে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে নগরীর পরিবেশ। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন দুই ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি।
দক্ষিণে নাগরিক সেবায় অচলাবস্থা
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বর্তমানে চরম অচলাবস্থার মধ্যে রয়েছে। মেয়র হিসেবে উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে ডিএসসিসির কর্মচারী ইউনিয়ন ও ইশরাকের সমর্থকরা। ফলে ১৫ মে থেকে নগরভবনের সব ধরনের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে। গত ১৪ মে থেকেই নগরভবনের মূল ফটকে তালা ঝুলিয়ে আন্দোলনকারীরা ভেতরের সিঁড়িতে অবস্থান নেন। ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন’ ও ‘ঢাকাবাসী’ ব্যানারে মিছিল, স্লোগান ও অবস্থান কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, ‘জনগণের রায় এবং উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী ইশরাক হোসেন বৈধ মেয়র। অথচ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তার শপথ অনুষ্ঠান বিলম্বিত করছে।’ তারা আরও হুঁশিয়ার করে বলেছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত নগর ভবনের প্রতিটি বিভাগে তালা ঝুলিয়ে রাখা হবে। ফলে নাগরিকদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। জন্মনিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স, ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এমনকি মৃত্যুর সনদপত্রসহ সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে। নগরবাসী প্রতিদিনই খালি হাতে ফিরছেন নগর ভবন থেকে।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে আদালতে যান ইশরাক হোসেন। চলতি বছরের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালতের রায়ে শেখ ফজলে নূর তাপসের মেয়র পদ বাতিল করে ইশরাককে বৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশ করলেও শপথ অনুষ্ঠানে জটিলতা তৈরি হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ‘আইনি জটিলতা’র অজুহাতে এখন পর্যন্ত শপথ অনুষ্ঠান থেকে বিরত রয়েছে। ১৪ মে দায়ের করা একটি রিটও হাইকোর্ট খারিজ করে দেয়, তবুও আন্দোলন থামেনি। এই অচলাবস্থায় ঈদুল আজহা ঘিরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে দক্ষিণে আশঙ্কা বেড়েছে।
যদি চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকে, তবে ঈদের দিন ও পরবর্তী সময়ে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চলমান অচলাবস্থার মাঝেও নাগরিক সেবা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. মো. জিল্লুর রহমান। ভিউজ বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘সংকটের মাঝেও আমরা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যতটুকু সম্ভব সর্বোচ্চ নাগরিক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। ঈদের দিন সন্ধ্যার মধ্যে কোরবানির বর্জ্য অপসারণ নিশ্চিত করতে বাড়তি লোকবলও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাজধানীর জলাবদ্ধতা কোনো নতুন সমস্যা নয়, এটি বহুদিনের। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব যেন দ্রুত এর সমাধান করতে পারি।’ তিনি আরও জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলেও ঈদ ও বর্ষা মৌসুম মাথায় রেখে জরুরি কিছু কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চালু রাখা হয়েছে।
উত্তরে ঈদ ও বর্ষা ঘিরে সক্রিয় প্রস্তুতি
অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। ঈদুল আজহার সময়কে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে ডিএনসিসি প্রশাসন। প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, ‘আমরা অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসনের জন্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ খুলেছি এবং বাড়তি জনবল নিয়োগ করেছি।’ তিনি জানান, ‘ঈদের সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করতে একাধিক ভাগে পরিচ্ছন্নতা কর্মী মোতায়েন করা হবে।
বর্ষা মোকাবিলায় আমরা বিভিন্ন খাল পরিষ্কার করেছি, কিছু খাল উদ্ধারও করেছি, যা এখনো চলমান। এতে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমে আসবে বলে আশা করছি।’ উত্তর সিটির গুলশান, বনানী, মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁওয়ের মতো এলাকায় অতিবৃষ্টিতে যে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছিল, তা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নিরসন করা সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। এজাজ বলেন, “আমরা ‘কুইক রেসপন্স টিম’ তৈরি করেছি, যারা জলাবদ্ধতার খবর পেলেই দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিচ্ছে।”
নাগরিকদের শঙ্কা ও প্রত্যাশা
ঢাকার অনেক বাসিন্দাই বলছেন, ঈদের সময় বর্জ্য অপসারণে সামান্য গাফিলতিও নগরজীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তার ওপর বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। দক্ষিণে সিটি করপোরেশন কার্যত অচল থাকায় জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা শাওন বলেন, ‘আমরা চাই দ্রুত সমাধান হোক। রাজনীতির বলি হয়ে আমরা নাগরিকরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হই।’ অন্যদিকে উত্তরা থেকে আসা গৃহিণী সাইয়্যেদা ইসরাত বলেন, ‘উত্তরে প্রস্তুতি ভালো হলেও যদি দক্ষিণে বর্জ্য না সরানো হয়, তাহলে তা পুরো শহরকেই প্রভাবিত করবে।’
বর্জ্য অপসারণ না হলে নগরবাসীর ওপর কেমন প্রভাব পড়বে এমন প্রশ্নের উত্তরে মন্তব্য করতে গিয়ে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সদস্য সচিব শরীফ জামিল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিগত ১৭ বছরে যে খাল, নদী ও জলাশয়গুলো দখল হয়েছে, সেগুলোর উদ্ধার প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। অনেক সময় উদ্ধার অভিযানের নামে উল্টো দখলের বৈধতা দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া সরকার যে প্রক্রিয়ায় দখলমুক্ত করার কাজ করছে, সেটিই ভুল। ফলে যতই বর্জ্য অপসারণ করা হোক না কেন, কার্যকর ফল আসবে না। জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল, নদী ও জলাশয়গুলোর সীমানা চিহ্নিত করে সেগুলো প্রকৃতভাবে দখলমুক্ত করতে হবে। অন্যথায় নগরবাসীর দুঃখ-দুর্দশা কমবে না।’
এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা দীপংকর বরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে