ক্ষুধার্ত জনপদের ভাষণ
খানিক আগেও নেতাকর্মীদের মাঝে বসেছিলেন কুতুব উদ্দিন। নিচের বসার ঘরে। জমে উঠেছিল আড্ডা। কেউ পান চিবাচ্ছেন। কেউ চা খাচ্ছেন। সিগারেট টানছেন। গল্পের ওপর পাল্টা গল্প। লড়াই হবে এবার। জয় আপনার নিশ্চিত নেতা। সবাই বলে যাচ্ছিলেন একই সুরে। মাথা নাড়ছিলেন তিনি। মুখে মৃদু হাসি। সবাই বলছে জয়ের কথা। তিনবার হেরে জয় নিয়ে খুব শঙ্কিত। তবে এবার জোয়ার উঠছে। সে জোয়ার তাকে ভাসিয়ে নেবে জয়ের বন্দরে। জোয়ারের এই স্রোত কেউ ঠেকাতে পারবে না। সামনেই দাঁড়াতে পারবে না। সে বিশ্বাস তার মনে দিন দিন প্রবল হচ্ছে। গতবারও স্বপ্ন দেখেছিলেন ফুলের মালায় ঢাকা পড়ার। মিছিল দিচ্ছেন বিজয়ের। সে স্বপ্ন রাতেই হারিয়ে গেল। জয় পেল প্রতিপক্ষ। তাই এবার খুব বেশি উচ্ছ্বাস তার মন দখল করতে পারেনি।
এই আনন্দঘন মুহূর্তে বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ উঠে গেলেন কুতুব উদ্দিন। উত্তরের রুমে ঢুকে লাগিয়ে দিলেন সিটকিনি। তা বেশ অনেক্ষণ আগে। দরজা খুলছেন না। ডাকছেনও না কেউ। সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছেন। গল্পও তল পড়েছে। হলোটা কী! একটা দুশ্চিন্তা ভর করল সবার মুখে। চোখে চোখে প্রশ্ন, নেতা তো এরকম আগে করেননি। রুম বন্ধ করে বসে আছেন। রুমে বসে থাকার সময় না এখন। তাদের বসিয়ে রেখে রুম বন্ধ করে সিগারেট টানছেন নাকি? না গান শুনছেন? মাথা ঠিক নেই। মাথা ঠিক করতে পারেন। কিছুই বুঝতে পারছেন না তার পিএস মতি মোল্লা। আজ নির্বাচনী শেষ জনসভা। বিকেল চারটা ত্রিশ মিনিটে কুতুব উদ্দিন ভাষণ দেবেন। এটা তার শেষ ভাষণ। শেষ জনসভা। গতকাল রাতে জানিয়েছেন মতি মোল্লা, স্যার এটাই শেষ ভাষণ। কোথায় দেবেন জানেন? ক্ষুধার্ত জনপদে। এই জনপদ একটা ভোটব্যাংক। জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে। এই ভোট আপনার বাক্সে পরলে জয় নিশ্চিত। লিখে দিতে পারি। ঠেকাতে পারবে না কেউ।
কুতুব উদ্দিন হাসলেন। জয়ের জন্য মরিয়া তিনি। কতবার পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। এই নির্বাচনে জিততেই হবে তার। এটাই শেষ নির্বাচন। মতি মোল্লার কথায় গুরুত্ব দেননি তখন। ক্ষুধার্ত জনপদের ভাষণ। সে আর এমন কী। তাচ্ছিল্যের একটা ভাব। হঠাৎ মন অন্যদিকে ঘুরল। যতটা সহজ ভাবছিলেন ততটা সহজ হবে না। একটু জ¦ালাতে হবে। তাই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসলেন একান্তে। সিগারেট টানছেন গভীর ধ্যানে। ভাবছেন ক্ষুধার্ত জনপদে কী বলবেন। খুব কৌশলে বলতে হবে কথা। জয় করতে হবে ওদের মন। বিষয়টা কঠিন না। তবে হঠাৎ কঠিন মনে হচ্ছে। আবার উঠলেন। আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। দেখলেন নিজেকে। বেড়ে গেল মনোবল। ওদের মন জয় করতে পারবেন। কিছুক্ষণ ভাষণ দিলেন। খুব চেঁচিয়ে না। শান্ত কণ্ঠে। হাত নাড়িয়ে।
ভাষণ আজ নতুন দিবেন না কুতুব উদ্দিন। আগেও দিয়েছেন। হাজারবারের বেশি দাঁড়িয়েছেন ডায়াসে। বিশাল জনসভায়। লক্ষ জনতার সামনে। সুবক্তা হিসেবেও সুপরিচিতি রয়েছে। মানুষ মুগ্ধ হয়। ছেড়ে যেতে পারে না সভাস্থল। তবু নিজেকে বাজিয়ে নিতে চাইলেন। কেমন যেন মনে হচ্ছে আজ। মাঝ পথে থেমে যেতে না হয়। শব্দ সংকট দেখা না দেয়। আজকের ভাষণ তার জয়ের শেষ বুলেট। এটা সাধারণ ভাষণ নয়। এ ভাষণে তাকে অভিনয় করতে হবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিনেতার। কাঁদতে হবে। চোখ মুছতে হবে। কাঁদাতে হবে তার সামনে বসে থাকা মানুষদের। ওরা যেন বুঝতে না পারে এটা অভিনয়। অভিনয় আগেও করেছেন তিনি। নতুন কিছু নয়। রাজনীতি মানেই অভিনয়। যে অভিনয় দিয়ে মানুষকে বোকা বানাতে হয়। আজও একদল মানুষকে বোকা বানিয়ে ধোঁকা দিবেন। এই উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠলেন। হঠাৎ উত্তেজনা কমে এলো। মনে পড়ল অন্যকথা। ভাষণ দিবেন ক্ষুধার্ত জনপদে। এই কথা মনে পড়ায় উত্তেজনা জল পড়ল। মনে হলো এটা কঠিন কিছু না। কি বলতে হবে জানেন তিনি। এই মানুষগুলোকে সহজইে বোকা বানানো যায়। কারণ, ক্ষুধা পৃথিবীর সর্বোচ্চ ফাঁদ। সেই ফাঁদে আটকে আছে ওই জনপদের মানুষ। নতুন ফাঁদ পাততে হবে না। ক্ষুধার ফাঁদে ফেলে মানুষকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করা যায়। কী না করা যায়। যা ইচ্ছে তা করা যায়। তার দরকার ভোট। ক্ষুধার্ত মানুষকে লোভের টোপ দিলেই হয়। বানরের মতো পিছে ঘুরানো যায়। সহজেই মত কেনা যায়। মাথা কেনা যায়। মন জয় করা যায়। সামন্য একটু খাবার পেলেই ওরা খুশি। ভোট দেবে। সেøাগান দেবে। তার নামে মিছিল দেবে। জীবনও দেবে। বিশ্বাস করবে হাজারো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। উচ্ছ্বাসে ভাসবে ওদের মুখ। একবারও ভাববে না। প্রশ্ন করবে না। মানুষকেই এরকম বোকা বানানো যায়। বারবার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করে মানুষ। একই ফাঁদে অনেকবার আটকে পড়ে। অন্য প্রাণীকে একবার ধোঁকা দিলে দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করানো কঠিন। মানুষকে ধোঁকা দেয় মানুষ। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয়। মানুষই আবার তা বিশ্বাস করে। এসব ভেবে হা হা করে হেসে উঠলেন কুতুব উদ্দিন।
হঠাৎ থেমে গেল তার হাসি। চুপচাপ বসে রইলেন কিছু সময়। ভাষণ দেবেন ক্ষুধার্ত জনপদে। ধোঁকা দেবেন একদল ক্ষুধার্ত মানুষকে। যারা এর আগেও অনেকবার ধোঁকা খেয়েছে। বোকা হয়েছে। আজও খাবে। তারপরও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করবে। হাসবে। আনন্দ করবে। নাচবে। হাতে তালি বাজাবে। একটা মিথ্যা স্বপ্ন নিয়ে নির্মাণ করবে ভবিষ্যতের পথ। ভোট দেবে। নির্বাচিত হবেন তিনি। পরিবর্তন আসবে তার জীবনে। ওরা আটকে থাকবে ক্ষুধার রাজ্যে। ওই দেয়ালটা ভাঙতে পারবে না। দেবেন না ভাঙতে। আরও মজবুত করে গড়ে তুলবেন দেয়াল। যাতে অনেকবার ধোঁকা দিতে পারেন।
এরপর বসলেন হিসাব মিলাতে। কী পরিবর্তন আসবে তার জীবনে। আজ যাবেন এক্স করল্লায়। নির্বাচনের পরে যাবেন প্যারাডোতে। দ্বিতীয়বার ধোঁকা দিতে যাবেন হেলিকপ্টারে। এসব ভাবতেই কুতুবউদ্দিনের শরীরে শিহরণ উঠল। একটা ভাষণ পাল্টে দিতে পারে তার জীবন। হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন রুম থেকে। তাকে দেখে সবাই অবাক। দরজা বন্ধ করে কী করলেন এতক্ষণ। কোথায় পেলেন এত আনন্দ? স্বপ্ন দেখলেন নাকি? বিজয় নিশ্চিত করে ফেলেছেন? এমন কিছু। তিনবার নির্বাচনে হেরেও এতটা ভরসা পেলেন কোথায়? অবিশ্বাস্য। তবে বিশ্বাস করতে হবে। এত লম্বা হাসি দেখেও বিশ্বাস না করে থাকা যায় না।
কুতুব উদ্দিন হেসে বললেন, তোমরা ভয় পেয়েছ নাকি? একটু জ্বালিয়ে নিলাম। আজ শেষ ভাষণ। এরপর শুরু হবে হাসা। হাসব আমি। হা হা করে হেসে উঠলেন তিনি।
মতি মোল্লা বললেন, কাকে জ¦ালালেন?
কাকে আর জ¦ালাব। নিজেকে জ¦ালালাম। কেনই যেন মনে হচ্ছে কঠিন অভিনয় করতে হবে। কম তো করলাম না অভিনয়। রাজনীতি মানেই অভিনয়। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। তারপরও মনে হলো আজকের অভিনয়টা নিখাদ করতে হবে। কেউ যেন ধরতে না পারে। এই অভিনয়ের ওপর নির্ভর করবে অনেক কিছু। শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়ে উঠব আমি।
মাথা নাড়লেন সবাই। করম আলী বললেন, ওটা আপনি পারবেন। পাকা অভিনেতা হয়ে উঠেছেন নেতা। ক্ষমতা হাতে পেলে পাল্টে যাবেন। বুঝতেই পারব না কোনটা অভি আর কোনটা নয়। জনগণ ধইনচ্যা হয়ে যাবে। আপনার নাগাল পাবে না।
কুতুব উদ্দিন হাসলেন। সবই আপনাদের জন্য। এই অভিনয়, ছলনা। নিজের জন্য কিছুই করলাম না। বুঝল না জনগণ। তিনবার হারলাম। শেষ চেষ্টা। নমিনেশন দেবে না আর দল।
নেতাকর্মীদের নিয়ে খেতে বসলেন কুতুব উদ্দিন। খুব আইট করে বসে টাইট করে খেলেন। উঠতে পারছেন না। মনে পড়ল ক্ষুধার্ত জনপদের কথা। এই পেট নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন ওদের সামনে? খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবলেন এটাও অভিনয়ের অংশ। ভাব ধরবেন তিনি ক্ষুধার্ত। চোখটা ভিজাবেন। তাতে জুরি নেই। পেট টিপে কেউ দেখবে না। মুখ দেখবে। অভিনয় তো মুখেই করবেন।
২
বিকেল চারটা। জনসভা স্থলে গেলেন কুতুব উদ্দিন। এই জনপদে আগে আসেননি তিনি। চমকে উঠলেন দৃশ্য দেখে। কোথায় এসেছেন। সেই উৎসাহ নেই তার। পাল্টে গেছে ভাবনা। ভুলে গেছেন কল্পনা। গাড়ি থেকে নামলেন তিনি। দাঁড়ালেন সোজা হয়ে। তার দিকে ছুটে আসছে ক্ষুধার্ত মানুষ। হইহই করে তাকে ঘিরে ধরেছে। তার সাথের লোকেরা সরিয়ে দিচ্ছে। কেউ কাছে আসবেন না। বসে পড়েন মাঠে। মঞ্চের দিকে হাঁটলেন কুতুব উদ্দিন। এই জনপদ অচেনা তার কাছে। কল্পনাও করতে পারেননি। মানুষগুলোকেও দূরের মনে হচ্ছে। তার সাথের কয়েকজন আর তিনি এই গ্রহের মানুষ না। না হয় ভিনগ্রহ থেকে এসেছে যারা এখানে বাস করছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। হাড়ের তৈরি মানুষ। মাংস গেল কোথায়? গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। মাটি পুড়ে তামা হয়ে গেছে। বহুদিন বৃষ্টির জল মুখে পড়েনি মাটির। কোথাও একটা পাখি নেই। নেই পাখির কণ্ঠে সুরের ঝংকার। ফুল ফোটে না। মানুষ গান গায় না। কবিতা লেখে না কবি। নেতারা এসে ফিতা কাটে না। এখানে চাঁদের আলো বড্ড ম্লান। এ কেমন জনপদ! তৈলচিত্রে আঁকা কোনো শিল্পীর কল্পনার বহিঃপ্রকাশ মনে হচ্ছে। ক্ষুধাই পাল্টে দিয়েছে এই জনপদের চিত্র? তাই হবে। ক্ষুধার অনেক শক্তি। পাল্টে ফেলতে পারে মানুষের মুখ, একটা জনপদের বুক। যাক, এবার তার ভাগ্যও পাল্টে দেবে এই জনপদ।
মঞ্চে উঠে বসলেন কুতুব উদ্দিন। সাদা পাঞ্জাবির ওপর কালো কোর্ট। চশমাটা খুলে রাখলেন টেবিলে। কিছু একটা ভাবছিলেন। আবার চশমা তুলে দিলেন। তাকালেন সামনের দিকে। তার সামনে বসে আছে অসংখ্য ক্ষুধার্ত মানুষ। তাকে দেখে যাদের চেহারা জ্বল জ্বল করছে আনন্দে। চোখ সরাতে পারছেন না। দেখছেন একটি ক্ষুধার্ত জনপদের চিত্র। একদল হাড্ডিসার মানুষ। যাদের অধিকাংশের গায়ে কাপড় নেই। শরীরটা পুড়ে কালছে হয়ে গেছে। কারো কাঁধে গামছা। ছেঁড়া গেঞ্জি। নারীদের পরনে নিতান্ত ইজ্জত ঢাকার অস্ত্র। যাদের শরীরে কিছু নেই তাদের পাজরের হাড্ডি দেখা যাচ্ছে। ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে জেগে উঠছে। চুল, দাড়ি জট পাকানো পাটের আশের মতো দলা বেঁধেছে। চোখগুলো কোটরের ভেতর ঢুকে গেছে। থমকে গেলেন কুতুব উদ্দিন। তাকালেন ডানে বামে। একই চিত্র দেখছেন। একজন ভিন্ন মানুষ খুঁজছেন। এই জনপদে ভিন্ন মানুষ দেখছেন না। ক্ষুধার হাত থেকে কেউ রক্ষা পায়নি? খানিক দূরে দাঁড়িয়ে আছে একটা কুকুর। শরীরে মাংসের চিহ্নও নেই। চারটা পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। লকলকে জিহ্বটা ঝুলে পড়ছে। কুকুরটা কেন দাঁড়িয়ে আছে? ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চায়? না তার বক্তব্য শুনতে চায়? এখন তার ভয় হচ্ছে। মানুষকে ধোঁকা দিতে পারলেও কুকুরটাকে ধোঁকা দেয়া কঠিন হবে। চোখ অন্যদিকে ঘুরালেন।
ক্ষুধার্ত মানুষের লাইন ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। সবাই ছুটে আসছে জনসভার মাঠে। তাদের চোখ মুখ আনন্দের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। একটা ছেলে এসেছে থালা নিয়ে। ল্যাঙটা। কয়েকটা হাড়ের ওপর একটা মাথা বসানো। কথা বলছে। বাবার কাছে জানতে চাচ্ছে, এইহানে নাকি ভাত দেবে? মা কইছে। আমি ভাত খাব। ভাত কই? ভাত আইনা দাও।
ছেলেটাকে পাশে বসালেন বাবা। কথা কইস না। ভাত দেবে, ওই যে দেখছ না একজন মানুষ।
কই মানুষ?
ওই যে মঞ্চে বসে আছে। আমাদের সবার থেকে আলাদা। কত ভালো জামাকাপড় গায়। মহিষের মতো মোটাতাজা। উনি ভাত দেবেন। ভাত নিয়া আইছেন। সবাই আজ ভাত খাইতে পারবে। তুই এইহানে বস।
ছেলেটা বসে না। থালা নিয়ে ছুটে যায় মঞ্চের দিকে। খানিক দূরে পোতা বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কুতুব উদ্দিনের দিকে। ভাত খোঁজে। কোথায় রাখছে ভাত? তার পাশে ভাত দেখে না। ভাতের পাতিল দেখে না। ভাত রাখল কোথায়? ছুটে এলো বাবার কাছে। কই ভাত! ভাত তো দ্যাখি না। উনি ভাত আনে নাই। মিথ্যা কথা কইছে।
না না ভাত আনছে। তার লোকেরা কইছে। নেতা আইবেন ভাত নিয়া। এই জনপদে আর ক্ষুধা থাকবে না। ছেলেকে ধরে পাশে বসালেন বাবা। বস, বস। ভাত দেবে।
ভাত খাইয়া এক থাল লইয়া যামু। রাইতে খামু বাবা।
বাবা তাকালেন ছেলের মুখের দিকে। খানিক পরে বললেন, হ নিস নিস। অনেক ভাত আনছে। নিতে পারবি। আমাদের আর না খাইয়া থাকতে হইবে না।
ছেলে ফিক করে হেসে দিল। ভাতের হাসি। বাবার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আহারে ভাত!
ফুলবানু দাঁড়িয়ে আছেন জারুল গাছের নিচে। আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদছেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। গড়িয়ে নামছে জল। কেন এই নেতা আগে আইলেন না। এখন ভাত লইয়া আইছেন। আগে আইলে তার স্বামী মরত না। ভাতের জন্য স্বামী মরছে। আজ ভাত দেলে ক্যামনে মুখে দেবেন। ক্যামনে ভাত খাইবেন। না, ভাত খাইতে পারবেন না। বুক ভেঙে কান্না এলো তার। মুখটা অন্যদিকে ফিরালেন।
জোহরার মা ধরলেন। ও ফুলু কান্তাছ ক্যান? কান্দিস না। কইছেন তো ভাত দেবেন। খাইতে পারবি। প্যাট ভইরা ভাত খাইস।
ভাতের জিন্যে কান্দিনা চাচি। এই ভাতের জিন্যে স্বামী হারাইলাম। এখন ভাত লইয়া আইছে। ক্যামনে এই ভাত খামু?
জোহরার মায়ের মুখে আন্দার নামল। কষ্ট তো সবার মনেই আছে। কি করার। ফুলুর স্বামী তো আর আইবে না।
কুতুব উদ্দিন দেখছেন ক্ষুধার্ত মানুষের চোখ। ওদের পেটেই ক্ষুধা না চোখেও ক্ষুধা। সে ক্ষুধার তীব্রতা দেখে ভয় পাচ্ছেন। তাকে খেয়ে ফেলবে নাতো। ওরা ছুটে আসতে পারে তার দিকে। খাবলে নেবে তার মাংস। ক্ষুধা নিবারণ হবে ওদের। সতেজ হয়ে উঠবে হাড্ডিসার কঙ্কালগুলো। পেশিবহুল হবে শরীর। চক চক করবে চেহারা। শক্তি ফিরবে তাবত শরীরে। ওরা ছুটবে। ছড়িয়ে পড়বে দিগন্তে।
এসব ভাবতেই মনটা এলোমেলো হয়ে গেল কুতুব উদ্দিনের। ভয় এসে নাড়িয়ে দিল। কী বলবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। সব ভুলে গেছেন। হারিয়ে ফেলেছেন কথা বলার শক্তি। সংকটে পড়েছেন শব্দের। মনে হচ্ছে অভিনয়টা করতে পারবেন না। চেষ্টা করছেন নিজেকে শক্ত করতে। সামলে নিতে; কিন্তু পারছেন না। শরীরটা কাঁপছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। পানি খেলেন। বসলেন সোজা হয়ে। ভেতরে ঘামছেন। এবার অভিনয় করছেন নিজের সাথে। পাশে যারা বসে আছেন তাদের দেখাচ্ছেন ঠিক আছেন। ভয় পেলে চলবে না। সামনে যারা বসে আছে নির্বাচনে জেতার বুলেট। জিততেই হবে। জেতাতে পারে এই ক্ষুধার্ত মানুষ। বারবার মনে পড়ছে সেকথা। এই বুলেটের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সেটা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদের খুশি করতে হবে। হাজারো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। জড়িয়ে গেলে হবে না। জায়গা করে নিতে হবে ওদের মনে।
মাইকে দাঁড়ালেন মতি মোল্লা। হে ক্ষুধার্ত জনপদবাসী, আপনাদের সামনে এখন ভাষণ দেবেন, ক্ষুধার্ত মানুষের বন্ধু, এই জনপদের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এসেছিন, যার অপেক্ষায় আপনারা বসে আছেন, এই জনপদের মানুষের জন্য যিনি ভাতের ব্যবস্থা করবেন, আপনাদের প্রিয় নেতা, জননেতা কুতুব উদ্দিন।
হাতে তালি পড়ল। ঠন ঠন শব্দ হলো। হাড্ডিসার মানুষরা বাজনা বাজাচ্ছে। যারা একটু দূরে ছিল তারও ছুটে এলো। মনে করেছিল ভাত দেয়া শুরু হয়েছে। ভাতের জন্য লড়াই করতে হবে। পেছনে পড়ে থাকলে ভাত পাবে না।
ডায়াসে এলেন কুতুব উদ্দিন। গম্ভীর মুখ। ভেতরের ভয়টা আবারো তাকে নাড়িয়ে দিল। দাঁড়ালেন ভাবলেশহীনভাবে। অসংখ্য ক্ষুধার্ত চোখ তার দিকে। এখন যা বলবেন তা এই জনপদের মানুষের ক্ষুধা নিবারণের উপাদান। তার কথা ভাত হয়ে ওদের পেটে পড়বে। ক্ষুধা দূর করবে। সেই আকাক্সক্ষা নিয়ে চাতকের মতো তাকিয়ে আছে। কোনো হইচই নেই। নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো জনপদ। মৃত্যুপুরির মতো নীরবতা নামল। ক্ষুধা তাদের ধৈর্যশীল করেছে। শুধু তাই না, পাথর করে দিয়েছে। হরণ করে নিয়েছে চলার শক্তি। আওয়াজ তুলতে পারে না। মরে গেছে স্বর। স্বপ্ন একটাই বাসা বেঁধেছে মনে। আজ ভাত খাবে। শক্তি ফিরবে। হাঁটতে পারবে। আবার লড়াই করবে। ছুটে যাবে অন্য জনপদে।
কুতুব উদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন। কথা বলতে পারছেন না। গালে হাত বুলালেন। গলা চেপে আসছে। কথা আটকে যাচ্ছে। তার পেছনে মতি মোল্লা। ফিসফিসে কণ্ঠে বললেন, কথা বলতে হবে নেতা। এটাই শেষ ভাষণ। জয়ের শেষ বুলেট।
ঘোর কাটল কুতুব উদ্দিনের। একটা শব্দ খুঁজছেন। যেটা দিয়ে শুরু করবেন। সেই শব্দটা পাচ্ছেন না। অপেক্ষাও করতে পারছেন না। কথা তার বলতে হবে। গমগম করে উঠল মাইক। মাথা তুললেন কুতুব উদ্দিন। বললেন, আমি জানি আপনারা ক্ষুধার্ত।
নীরবতা ভাঙল। সবাই হাত তুলে দিল। শুকনো বাঁশের লাঠির মতো দেখাচ্ছে সে হাত। বলছে হ্যাঁ, আমরা ক্ষুধার্ত।
শুধু ক্ষুধার্ত না। আপনারা ক্লান্ত। শ্রান্ত। ক্ষুধার ভয়াবহতা আপনাদের চোখে মুখে ছাপ ফেলেছে। দারিদ্র্যের সাইনবোর্ড ঝুলছে আপনাদের শরীরে। পুরো জনপদে। ক্ষুধার থাবা থেকে এই জনপদের গাছপালা-পশুপাখি কেউ রক্ষা পায়নি। আমার প্রশ্ন, কেন আপনারা ক্ষুধার্ত? কেন আপনারা হাড্ডিসার? কেন আপনারা অর্ধনগ্ন? কেন আপনারা দারিদ্র্যের দেয়ালে আবদ্ধ? এই জনপদ ক্ষুধার্ত মানুষের জনপদ নয়। এই জনপদে উর্বর মাটি আছে। মানুষ আছে। মনোবল আছে। আপনাদের অসীম সাহস আর ধৈর্য আছে। এই জনপদে সোনা ফলবে। ক্ষুধার্ত নয়, সোনালি জনপদ হবে এটা।
কুতুব উদ্দিন কথা শেষ করতে পারেননি। একজন উঠে দাঁড়ালেন। দুহাত তুলে বললেন, সোনা চাই না, সোনা দরকার নাই। সোনা দিয়া কী করমু? ভাত চাই, ভাত। আমাগো প্যাডে খিদা। অনেক খিদা। ভাত আমাদের সোনা। ভাত খামু। ভাত দ্যান। ভাতের কথা কন। সোনার কথা কইয়েন না। সোনা আপনারা লইয়া যান। আমাগো ভাত দ্যান।
অন্যরা হইচই করে উঠল। সবাই ভাত চায়। কেউ সোনা চায় না। অনেকে দাঁড়িয়ে গেল। সবার মুখে একটাই কথা, ভাত চাই। ভাত। হইচই পড়ে গেল। কয়েকজন সেøাগান দিয়ে উঠল। ভাত চাই, ভাত।
কুতুব উদ্দিনের মুখে মৃদুহাসি। ভাষণ জমে উঠেছে। এবার দু’হাত তুলে দিলেন। থামুন আপনারা। আপনাদের ভাত দেব। এই জনপদে ভাতের গাছ লাগাব। কোনো মানুষ ক্ষুধার্ত থাকবে না। না খেয়ে মরবে না। হাড্ডিসার থাকবে না। বস্ত্রহীন থাকবে না। পিচডালা পথ হবে। মাটিতে পা পড়বে না। এই জনপদের যুবকরা অকালে বৃদ্ধ হবে না। শহরে গিয়ে চাকরি করবে। এই জনপদে পাখিরা গান করবে। ফুল ফুটবে। ভরে উঠবে শান্তিতে। আপনারা হাসবেন। আপনাদের মুখে হাসি ফোটাব আমি। দুঃখ ভুলে যাবেন। সেজন্য এই জনপদে এসেছি।
আনন্দে দাঁড়িয়ে গেল সভায় বসা থাকা মানুষ। কুতুব উদ্দিনের কথাগুলো শক্তি হয়ে তাদের উজ্জীবিত করে তুলল। তারা ভাত খাবে। থাকবে না ক্ষুধা। ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। সবাই হইহই করছে। আনন্দের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল ক্ষুধার্ত জনপদে।
কুতুব উদ্দিন হাসছেন মুখ বুজে। তিনি সফল। তার টোপ গিলছে এই জনপদের মানুষ। গিলবেই তো। এরকম লোভনীয় টোপ না গিলে পারবে না। এত সহজে গিলবে সেটা ভাবতে পারেননি। কত সহজ-সরল মানুষ। বলার সাথে সাথে বিশ্বাস করল। গিলে ফেলল। ফাল পেড়ে উঠল আনন্দে।
আনন্দ-উল্লাস থামার পরে কুতুব উদ্দিন বললেন, তারজন্য আপনাদের একটা কাজ করতে হবে।
সবাই থেমে গেল। কী করতে হবে। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাল কুতুব উদ্দিনের দিকে। কিছু করতে পারবে না তারা! ভাত খেতে পারবে। কতদিন প্যাট ভরে ভাত খায়নি। একজন বলল, কোনো কাজ করতে পারমু না। ভাত খাইতে চাই।
আর একজন থামিয়ে দিল। চুপ কর। বস। কি বলেন শোন।
সবাই তাকিয়ে আছে কুতুব উদ্দিনের দিকে। শুনতে চায় কী বলবেন। কুতুব উদ্দিন বললেন, আমাকে একটা ভোট দিতে হবে। ওটা খুব মূল্যবান নয়। আপনাদের কষ্ট হবে না। টাকা-পয়সাও খরচ যাবে না। কাগজে একটা সিল মারবেন। কল মার্কায়। তাতে আপনাদের কোনো লাভ হবে না। লাভ হবে আমার। আমি নির্বাচিত হব। আপনাদের জন্য ভাতের ব্যবস্থা করব। কল নিয়ে আসব। সেই কল দিয়ে পানি তুলব। ফসল ফলাব। আপনারা খাবেন। আমার বিশ্বাস এর মধ্যে কেউ মারা যাবেন না। ক্ষুধা আপনাদের কাছে হার মানবে। আমার বিজয় হলে নিশ্চিত ক্ষুধার পরাজয় হবে। ক্ষুধার মৃত্যু ঘটিয়ে ছাড়ব। সেটা শক্তি দিয়ে বলতে পারি। আপনাদের মতো ক্ষুধার্ত ছিলাম আমিও। ক্ষুধাকে পরাজিত করেছি। আমাকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। লড়াই করে সেখান থেকে ফিরে এসেছি। ক্ষুধাকে হারানোর মন্ত্র আমি জানি। আপনাদের একটা ভোটই পারে এই জনপদ থেকে ক্ষুধা তাড়াতে। আপনাদের মুক্তি দিতে। আমার বিজয় নিশ্চিত করতে।
পুরো জনপদ শান্ত হয়ে গেল। এখানে কোনো মানুষ আছে কেউ বলবে না। তাদের মনে সেই আনন্দ নেই। উত্তেজনা নেই। মুহূর্তেই মৃত্যু জনপদে পরিণত হলো। কুতুব উদ্দিন তাকিয়ে আছেন তার সামনে বসা ক্ষুধার্ত মানুষের দিকে। কী হলো। মানুষগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে গেল! হঠাৎ। কী ভাবছে এরা। বুঝতে পারছেন না এই জনপদের মানুষের মনোভাব। কেন চুপ হয়ে গেল? এটা তার মনে ভয় জাগিয়ে তুলল। খানিক আগের সেই আনন্দ খুঁজছেন। পাচ্ছেন না। কেন এদের সব আনন্দ হারিয়ে গেল? নিস্তব্ধতা ভেঙে একজন উঠে দাঁড়াল। রাগে কাঁপছেন থরথর করে। চিৎকার করে বলল, মিথ্যুক। দোকাবাজ। প্রতারক। এসব বলার জন্য আমাদের জড়ো করেছ? ভোট আমরা দেব না। আমরা ভাত চাই। ভাত খাব।
সবাই দাঁড়িয়ে গেল। শক্তিশূন্য হাড্ডিসার মানুষগুলো রাগে উত্তেজনা কাঁপছে। হাতে তুলে নিল পাথরের টুকরা। নিক্ষেপ করতে লাগল কুতুব উদ্দিনের দিকে। মুহূর্তেই পাল্টে গেল পরিবেশ। পাথরের সামনে দাঁড়াতে পারছেন না কুতুব উদ্দিন। ক্রমশ ওদের চেহারা দানবীয় আকৃতিতে রূপ নিচ্ছে। চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে মঞ্চের দিকে। ভয় পেয়ে গেলেন। বড্ড ভয়। ওরা আসলে রক্ষা হবে না। খেয়ে ফেলবে। ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন। এত শক্তি কোথায় পেল ওরা? ভয়ে জবুথবু হয়ে গেলেন। একদল ক্ষুধার্ত মানুষের মুখের সামনে তিনি। দৌড়ে পালাতে পারছেন না। ভাবতে পারছেন না কী করবেন। এরকম হলো কেন? এইতো তার দেয়া টোপ গিলল। ভাতের কথা বলতেই ওদের চোখগুলো আনন্দে কেমন লাফাচ্ছিল। সেই চোখে রক্ত খেলা করছে। তার দিকে ইট-পাথর ছুড়ছে। গালি দিচ্ছে। তেড়ে আসছে। কেন? এই কেনর উত্তর খোঁজার সময় নেই। দেখলেন তার পাশে কেউ নেই। সবাই পালিয়েছে। বাঁচার পথ নেই। ডায়াসের নিচে লুকালেন। তাতেও কাজ হচ্ছে না। ওরা ছুটে আসছে। টেনে বের করবে। এবার দাঁড়িয়ে দু’হাত জাগালেন। বললেন, আপনারা থামুন। এ কী করছেন? কেন পাথর মারছেন? কেন তেড়ে আসছেন? আপনাদের শত্রু না আমি। আপনাদের বন্ধু। এই জনপদ থেকে ক্ষুধা দূর করতে এসেছি। আপনারা ভাত খাবেন। ভোট দিতে হবে না। থামেন।
দাঁড়ালেন ক্ষুধার্ত জনপদের প্রধান। চিৎকার করে উঠলেন তিনি। মূর্খ। নির্বোধ আপনি। পুরনো অস্ত্র দিয়ে নতুন সৈনিক নিয়ে যুদ্ধ করতে এসেছেন। তা দিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। ন্যাড়া কতবার ব্যাল তলা যাবে? কত প্রলোভনের জলে ভিজবে? কত মিথ্যা স্বপ্ন নিয়ে বাঁচবে? বলেন, বলেন। স্বপ্ন দেখতে দেখতে আজ আমরা মৃত্যুর মুখে এসে খাড়াইছি। এখন বাঁচতে চাই। স্বপ্ন দ্যাখতে চাই না। কেন স্বপ্ন দ্যাখাইছেন?
চুপ হয়ে গেলেন কুতুব উদ্দিন। বুঝতে পারলেন সূত্রটা তার ভুল ছিল। এই সূত্র দিয়ে আগেও অনেকে ধোঁকা দিয়েছে। তাই ফেঁসে গেছেন। কী বলতে পারতেন? ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবারের কথাই বলতে হবে। গান শুনালে তো হবে না। ক্ষুধার্ত জনপদের প্রধানকে ডাকলেন। আপনি শুনেন। এদের শান্ত করেন। ভোট চাই না। ভোট দিতে হবে না।
সবাইকে শান্ত করলেন ক্ষুধার্ত জনপদের প্রধান। কুতুব উদ্দিন জানতে চাইলেন, ব্যাপারটা কী বলুন তো। হঠাৎ সবাই ক্ষেপে উঠল কেন? ক্ষুধার্ত মানুষ খাবার কথা শুনলে আনন্দিত হয়। এই জনপদের মানুষ পাথর মারে। তা কেন?
ক্ষুধার্ত জনপদের প্রধান বললেন, আপনি ভুল করছেন। আগেও এই জনপদে অনেক নেতা আইছেন। একই সূত্রে অঙ্ক করছেন তারা। রেজাল্ট ঠিক হইছে। আপনারও হইতো; কিন্তু খারাপ সময় আইছেন আপনি। তাই সফল হইতে পারেন নাই। এটা আপনার দুর্ভাগ্য। আপনার আগে যারা আইছেন তারাও গলা ফাডাইয়া কইছেন, ক্ষুধা আপনাদের জন্য অভিশাপ। ক্ষুধা আপনাদের জীবন ধ্বংস কইরা দিছে। ক্ষুধা দূর করব আমরা। সেজন্য আপনাদের ভোট চাই। ক্ষমতা ছাড়া ক্ষুধা দূর করা যাইবে না। অনেক স্বপ্ন নিয়া সবাই ভোট দিল। নির্বাচিত হইলেন তিনি। ভুইলা গ্যালেন এই জনপদের মানুষের কথা। আর মনে পড়ল না। ফিরেও আইলেন না। ক্রমশই বড় হতে থাকল ক্ষুধা। রাক্ষসের মতো নিজেই অনেককে গিলে খাইল। জনপদের মানুষ তাকিয়ে আছে পথের দিকে। কখন নেতা আইবেন। কখন তাদের ক্ষুধা দূর করবেন। বছরের পর বছর কাইটা গ্যাল। নেতা আর আইলেন না। হ্যাঁ, নেতা আইছেন। ভোটের আগে। সে কতবড় গাড়ি লইয়া। ধুলোয় জনপদ অন্ধার হইয়া গ্যাল। মানুষগুলো ছুটছে গাড়ির পেছনে। তারা কিছু দ্যাখছে না। ধুলার সামনে খাড়াইতে পারছে না। গাড়ি থেকে নামলেন না নেতা। গ্লাস নামাইয়া কইলেন, শোনেন, আমি নিজেও ক্ষুধার্ত আছিলাম, পাঁচ বছরে কিছুটা মিটছে ক্ষুধা। এবার আপনাদের ক্ষুধা মিটাইব। সেজন্য আরও একবার ভোট দিতে হইবে। না হয় ক্ষুধা নিবারণ করা যাইবে না।
গাড়ি ঘুরাইয়া চইলা গ্যালেন নেতা। এই জনপদের মানুষ আবারো ভোট দিল। কী করবে? উপায় নাই। পথ নাই। বিশ্বাস কইরা যাইতাছে। নেতা আবার ভুইলা গ্যালেন। এই জনপদে আর পা দিলেন না। অনেকদিন পর সেই নেতা আইলেন। এবার গাড়িতে নয়। আকাশে উড়তে উড়তে আইলেন। ভট ভট শব্দ হইলো। জনপদের মানুষ তাকাইল আকাশের দিকে। ভাবছে ওই যন্ত্রে কইরা ভাত লইয়া আইছে। ভাত লইয়া আন নাই। আবারো ভোট চাইতে আইছেন। তার এত বেশি ক্ষুধা যা আর নিবারণ হইলো না। প্রথম ছোট গাড়ি খাইলেন। তারপর বড় গাড়ি। তাতেও ক্ষুধা মিটল না। তারপর আকাশে ওড়া যন্ত্রটাও খাইলেন। ক্ষুধা মিটল না। ক্ষুধা মেটানোর জন্য এই জনপদ ছাইড়া অন্য জনপদে গ্যালেন। আমাদের ক্ষুধা আর দূর হইলো না।
কিছুদিন পরে আইলেন আর এক নেতা। সেও একই কথা কইলেন। আপনাগো ক্ষুধা থাকবে না। নতুন আশায় এই জনপদের মানুষ বুক বাঁধল। সত্যি এবার এই জনপদে ক্ষুধা থাকবে না। প্যাটভরে ভাত খাইবে। এই জনপদের মানুষ হাসতে পারবে। ভোট নিয়ে তিনিও উইড়া গ্যালেন। ভাত নিয়া আর ফিরলেন না।
কয়েকদিন আগে ফুলবানুর স্বামী ভাতের জন্য আত্মহত্যা করছে। গলায় ফাঁস দিয়া। এই জনপদের মানুষের প্যাডে য্যামন খিদা, ত্যামনি চোখে মুখে অবিশ্বাস। কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। এর আগে যারা আইছেন তারাও যা কইছেন, আপনিও তাই কইছেন। ক্ষুধা দূর করবেন। ওনাদের মতো আপনিও ভোট নিয়া পালাইয়া যাইবেন। আপনিও গাড়ি খাইবেন। আকাশে ওড়া যন্ত্র খাইবেন। অস্ত্র এক সৈনিক আলাদা। তাই আপনাকে কেউ বিশ্বাস করতে পারে নাই। আপনি ভুল করছেন। কিছু খাবার লইয়া আইলে হইতো। আরও একবার ধোঁকা দিতে পারতেন। মিথ্যা একটা বিশ্বাসের জায়গা সৃষ্টি করতে পারতেন ক্ষুধার্ত মানুষের হৃদয়ে।
নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন কুতুব উদ্দিন। ক্ষুধার্ত মানুষের ভোট নিয়ে এমপি হতে চান না তিনি। এদের ভাগ্য নিয়ে সবাই ছিনিমিনি খেলেছে। ওদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। সবাই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। এই মানুষদের শুধু ব্যবহার করেছে নিজেদের উন্নতির জন্য। ওদের ক্ষুধা দূর করবেন। ওদের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করবেন। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নয়। সেটা কী করে সম্ভব? তাকে এখন বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করাতে হবে। ক্ষুধার্ত মানুষের মাঝে নেমে এলেন। মিশে গেলেন সবার সঙ্গে। বললেন, মঞ্চ থেকে নয়, পরিবর্তন হবে এই জনতার ভেতর থেকে। আপনাদের সাথে আমিও ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই করব। ক্ষুধার অভিশাপ থেকে এই জনপদকে মুক্ত করব।
ক্ষুধার্ত জনপদের মানুষের মুখে হাসি ফুটল। হাড্ডিসার কালো মানুষগুলো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল কুতুব উদ্দিনকে। হইহই করে উঠল। ছড়িয়ে পড়ল আনন্দ। সত্যিকারের নেতা আইছেন এবার। যে তাদের মতো। মিশে গেছে তাদের সঙ্গে। মঞ্চে নাই। মাঠে নেমেছে।
ক্ষুধার্ত জনপদের প্রধান বললেন, আবারও ভুল করলেন নেতা। পরিবর্তন এখান থেকে করা যায় না। পরিবর্তন মঞ্চ থেকে করতে হয়। জনতার ভেতর থেকে পরিবর্তন করতে পারলে আমরা সবাই নিজেদের ভাগ্য পাল্টে ফেলতাম। ক্ষুধার্ত থাকতাম না। আপনাদের জন্য অপেক্ষা করতাম না। বারবার আমাদের বোকা বানাইতে পারতেন না।
বিস্ময়ের চোখে তাকিয়ে রইলেন কুতুব উদ্দিন। আকাশটা মেঘে ঢেকে গেছে। চারিদিকে নেমে এসেছে অন্ধকার। আকাশের দিকে তাকালেন। ভাবলেন আবারও ভুল করলেন। তখনই বৃষ্টি নেমে এলো আকাশ থেকে। আর সবুজে ভরে উঠল ক্ষুধার্ত জনপদ।
শামস সাইদ: কথাশিল্পী।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে