প্রখর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শেখ মুজিব
শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্যসাধারণ। আপনজনকে তো অবশ্যই, শত্রুপক্ষের লোকরাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উচ্চপদের লোকদেরও কেউ কেউ তার অবস্থানের প্রতি নমনীয় ছিলেন। যে জন্য গণহত্যা শুরুর আগে পূর্ববঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে কর্তব্যরত সাহাবজাদা ইয়াকুব খান পদত্যাগ করেন এবং নৌবাহিনীর এস এম হাসানকে সরিয়ে দিয়ে টিক্কা খানকে গভর্নর ও সামরিক শাসক হিসেবে আনা হয়। টিক্কা খান ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ উপাধি পেয়েছিলেন; যে উপাধির তিনি অযোগ্য ছিলেন না এবং পূর্ববঙ্গেও তিনি এসেছিলেন ‘কসাই’ হিসেবেই।
এই পাঞ্জাবি সেনাধ্যক্ষ উঠে এসেছিলেন একেবারে সিপাহির স্তর থেকে এবং সেনাবাহিনীতে ঢোকার সময় মেট্রিক পাস ছিলেন কি না সন্দেহ; পরাজয়ের আগেভাগে তিনি পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করেন এবং তার ‘দক্ষতার’ বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ভুট্টো তাকে সেনাবাহিনীর প্রধানের পদও দিয়েছিলেন। ভুট্টো শেষ পর্যন্ত নিহত হলেন জুলুমবাজ ওই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতেই। তিনি ঘোরতর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, তার হত্যাকারীরাও ওই একই ঘরানার লোক; কিন্তু তাদের মনে হয়েছিল পাকিস্তানের খণ্ডিতকরণের জন্য ভুট্টোও কম দায়ী নন; এবং তার হাতে রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ‘ইসলামী’ চরিত্রটা সুরক্ষিত থাকবে না। তাই তাকে সরিয়ে দেয়াটা দরকার।
শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য সাফল্যের পেছনে তার ব্যক্তিগত বিভূতি কার্যকর ছিল। সাহস তো অবশ্যই, তার বুদ্ধিমত্তাও ছিল প্রখর। কখন কোন আওয়াজটা তুলতে হবে, তুললে মানুষ সাড়া দেবে সেটা তিনি জানতেন। আপস করতেন না। মানুষ চেনার ক্ষমতা তার ছিল অতুলনীয়। ছাত্র ও যুবকদের তিনি যে এমনভাবে কাছে টেনে নিতে পারতেন তার কারণ ছিল নেতৃত্বদানে তার ক্ষমতা। কাকে দিয়ে কোন কাজ হবে সেটা তিনি বুঝতেন। আগরতলা মামলার সময় তার মুক্তির দাবিতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন করছে সেটা তার অজানা থাকার কথা নয়; কিন্তু তিনি জানতেন এ আন্দোলনকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য একজনকে খুব দরকার, তিনি হচ্ছেন মওলানা ভাসানী। সামরিক আদালত থেকে সাংবাদিক আতাউস সামাদের মারফত মওলানার কাছে তিনি বার্তা পাঠিয়েছিলেন তার মুক্তির জন্য আন্দোলনের অনুরোধ জানিয়ে।
সংক্ষিপ্ত বার্তাটিতে তিনি বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য তাকে মওলানার দরকার হবে এবং তারও দরকার হবে মওলানাকে। মওলানা বুঝি এই রকমের একটি বার্তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি ঘোষণা দেন যে ১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টনে জনসভা হবে, মুজিবের মুক্তির দাবিতে। সেই জনসভায় মওলানা যে অনলবর্ষী বক্তৃতা দেন তাতে মানুষ যেমন উদ্বুদ্ধ হয়েছে, তেমনি ভয় পেয়ে গেছে শাসকরা। তিনি বলেছিলেন, প্রয়োজনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করা হবে, জেলের তালা ভাঙা হবে, বাস্তিলের দুর্গের মতন পতন ঘটবে সামরিক কারাগারের। সমাবেশ থেকে সঙ্গে সঙ্গে গগনবিদারী আওয়াজ উঠেছিল ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’ এরপর অবশ্যম্ভাবী ছিল যে আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হবে এবং মামলার সব অভিযুক্ত তো বটেই অন্য রাজবন্দিরাও মুক্তি পেয়েছেন উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে।
গণহত্যা শুরুর আগে একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান আসগার খান দেখা করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে। ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দাবিকে তিনি অযৌক্তিক মনে করতেন না। তার উদ্বেগ ছিল পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে এবং টের পাচ্ছিলেন যে পীড়ন করলে পাকিস্তান টিকবে না। গভীর দুঃখের সঙ্গে শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন, পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালিদের কখনো বিশ্বাস করেনি, তাদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা হয়নি। আসগার খান বিস্মিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবের দূরদৃষ্টি দেখে। শেখ সাহেব তাকে বলেছিলেন তিনি নিশ্চিত যে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই নিয়ে ফেলেছেন। ইয়াহিয়ার ইচ্ছা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে পূর্ব পাকিস্তানকে চিরকালের জন্য দাবিয়ে দেয়া। আগামীতে কী কী ঘটতে যাচ্ছে তারও একটা ছবি দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। বলেছিলেন, প্রথমে ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসবেন, অল্প পরেই আসবেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান এম এম আহমদ; তারপরে ভুট্টো। এরপরে ইয়াহিয়া খান সামরিক পদক্ষেপ নেবেন এবং তাতে পাকিস্তান শেষ হয়ে যাবে। সেসব ঘটনাই ঘটেছে এবং ওই অনুক্রমেই। নিজের সম্বন্ধে মুজিব বলেছিলেন যে, তাকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হবে; আর সেটা যদি না ঘটে তাহলে তিনি নিহত হবেন হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, নয়তো তার নিজের লোকদের দ্বারা। আসগার খান এসব কথা লিখেছেন তার ‘জেনারেলস ইন পলিটিকস ১৯৫৮-১৯৮২’ নামের বইতে।
উল্লেখ্য, মার্চে ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠকের সময় একদিন ঢাকার প্রেসিডেন্টের ভবনে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে একান্তে ডেকে নিয়ে ভুট্টোকে মুজিব এই বলে সতর্ক করে দেন যে, সেনাবাহিনী আগে তাকে (মুজিবকে) হত্যা করবে, তারপর ভুট্টোকে। ভুট্টো সেই সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করেননি; তার মাথায় তখন খেলা করছে সেনাবাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় আরোহণের স্বপ্ন। অথচ মুজিব যা বলেছিলেন সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল সেটাই। তারা মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিল; পারেনি; পরে ভুট্টোকে হত্যা করতে চেয়েছে, পেরেছে। মুজিবের সতর্কবাণীর কথা ভুট্টো নিজেই বলেছেন, তার ‘দি গ্রেট ট্র্যাজেডি’ বইতে। সেটা লেখা হয়েছিল ওই একাত্তর সালেই, আগস্টের দিকে। দৃষ্টির এই প্রখরতা না থাকলে মুজিব অতবড় নেতা হলেন কী করে, সমসাময়িক ও সমবয়স্ক সবাইকে ছাড়িয়ে? সঙ্গে ছিল অতুলনীয় সাহস। জানতেন কি ঘটতে যাচ্ছে, তবু সাহস হারাননি। প্রাণসংশয় যখন দেখা দিয়েছে তখনো অবিচলিত থেকেছেন।
পাকিস্তানি নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন ভাইস-এডমিরাল এস এম আহসান; ইয়াহিয়ার শাসন শুরুর প্রথম পর্যায়ে তিনি এসেছিলেন পূর্ববঙ্গের গভর্নর হয়ে। আহসানও ছিলেন মুজিবের প্রতি সহানুভূতিশীল। তার ব্যবস্থাপনাতে ১৯৭০-এর নভেম্বরের শেষে ও ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়ার একান্ত বৈঠক হয়েছে। মুজিবের প্রতি আহসানের আকৃষ্ট হওয়ার কারণ তিনি মনে করতেন পাকিস্তানকে বাঁচাতে হলে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া অন্যকোনো উপায় নেই। আহসানের জন্য মুজিবের ওপর ভরসা করার আরও একটি কারণ অবশ্য ছিল; সেটি হলো কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ। আহসান অঙ্গীকারবদ্ধরূপে কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী ছিলেন এবং তার সময়ে পূর্ববঙ্গ সরকার বামপন্থিদের হেনস্তা করার ব্যাপারে হেন পদ্ধতি নেই যে ব্যবহার করেনি। মুজিব না থাকলে কমিউনিস্টরা এসে যাবে, এটা ছিল তার শঙ্কা। আহসান পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিগুলোর ঘোরতর সমর্থক ছিলেন। কমিউনিস্টদের প্রতি এই বিদ্বেষ সেনাবাহিনীতে সুবিস্তৃত ছিল বৈকি।
রাজনীতিতে শেখ মুজিব দুজনকে অগ্রপথিক ও পথনির্দেশক হিসেবে পেয়েছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে। শুরুতে এরাও জাতীয়তাবাদী নেতাই ছিলেন। পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। পরে তারা পৃথক হয়ে যান এবং সেটা ঘটে ওই জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই। সোহরাওয়ার্দী শুরুতে যেমন শেষ পর্যন্তও তেমনি পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; ভাসানী যা ছিলেন না। ভাসানী বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই। মুজিবও তাই। তবে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মুজিবের বিচ্ছেদ ঘটেনি, বিচ্ছেদ বরং ঘটেছে ভাসানীর সঙ্গেই; সেই ১৯৫৭ সালে, ভাসানী যখন ন্যাপ গঠনের উদ্যোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ ছেড়ে বের হয়ে যান তখন। এর কারণ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ভাসানী সমাজতন্ত্রমুখী করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন; মুজিব অতটা যেতে প্রস্তুত ছিলেন না। সমাজতন্ত্র ছাড়া যে উপায় নেই, এটা তিনি জানতেন এবং মানতেনও; কিন্তু তার পক্ষে কমিউনিস্ট হওয়া, এমনকি কমিউনিস্টদের সহযাত্রী হওয়া সম্ভব ছিল না, যেটা তিনি নিজেও বলেছেন। আগে বলেছেন সমবয়সী রাজনীতিকদের, স্বাধীনতার পর বলেছেন সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিতে-উদ্যত তার অনুসারীদের।
মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিবের ছিল ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা এবং পারতপক্ষে কাউকেই দূরে ঠেলে দিতে চাইতেন না। যেমন খন্দকার মোশতাক আহমদ। ইনি যে একজন অসন্তুষ্ট রাজনীতিক এবং অসন্তুষ্টরা যে বিপজ্জনক হয়, বিশেষ করে যদি তাদের মাথায় থাকে দুষ্টবুদ্ধি, সেটা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে অজানা থাকার কথা নয়। খন্দকারকে তবু কাছে রেখেছিলেন, হয়তো ভেবেছিলেন দূরে ঠেলে দিলে ষড়যন্ত্র পাকাবে। মোশতাক আহমদরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে সরাসরি বিচ্যুতও হননি; কিন্তু তাদের ওপর পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের প্রেতাত্মাটির আছর ছিল এবং তার নিজের মধ্যে ছিল ঘোরতর কমিউনিস্ট-বিদ্বেষ; নিজেকে নিজেই তিনি নন-কমিউনিস্ট নয়, অ্যান্টি-কমিউনিস্ট বলেই ঘোষণা করেছিলেন।
আর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর যে লোকগুলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার মতো অবিশ্বাস্য রকমের ভয়াবহ কাজটি করেছে সংক্ষেপে বলতে গেলে তারা ছিল মোশতাকপন্থিই। বাঙালির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র তৈরি করার প্রয়োজনে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াটাই যে যথেষ্ট নয়, বঙ্গবন্ধু সেটা পদে পদে বুঝতে পারছিলেন, নতুন ধরনের একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য নতুন ধরনের মানুষ দরকার একথাও তিনি বারবার বলেছেন এবং তেমনি মানুষকে যে পাওয়া যাচ্ছে না এ নিয়েও তার দুঃখ ছিল, সেই দুঃখ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাও করছিলেন তার নিজের মতো করে।
বাংলাদেশকে স্বাধীন করার পর আরও একটি বিপ্লব যে আবশ্যক সেটাও তিনি বুঝেছিলেন। সেই বিপ্লবের জন্য সর্বপ্রথম যা করতে হবে সেটি যে রাষ্ট্রের চরিত্রে পরিবর্তন আনা, সেটা তার উপলব্ধিতে ছিল; কিন্তু তিনি সময় পাননি, তার আগেই চলে গেছেন। তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলতেন, সে বলাটাকে সাম্রাজ্যবাদীরা, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা, পছন্দ করেনি। তারা তাকে সরিয়ে দিয়ে বিশ্বস্ত লোককে বসাতে চেয়েছে। তারা সাধারণত ব্যর্থ হয় না। এক্ষেত্রেও হয়নি।
তার নৃশংস হত্যায় সোহরাওয়ার্দী শোকাভিভূত হতেন, যদি তিনি জীবিত থাকতেন; মওলানা ভাসানী শুধু শোকাভিভূত নন, অত্যন্ত বিপন্নও বোধ করেছিলেন; তিনি তখনো জীবিত। সোহরাওয়ার্দী এবং ভাসানী এই দুই নেতার পারস্পরিক সম্পর্কটা মধুর ছিল না; কিন্তু তারা দুজনই শেখ মুজিবের অসামান্যতা সম্বন্ধে জানতেন, তবে ভাসানী যতটা জানতেন, সোহরাওয়ার্দী ততটা জানতেন না। জানা সম্ভব ছিল না।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে