Views Bangladesh Logo

জবানবন্দিতে বলেছিলেন বদরুদ্দীন উমর

'শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনার কিছুই ধারণ করেননি শেখ হাসিনা'

বানবন্দিতে বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, শেখ হাসিনা যেন ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’। তিনি শুধু শেখ মুজিবের কন্যা হওয়াতেই ক্ষমতায় এসেছেন। তার নিজের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল না। তিনি ‘বাপের বেটি’ হিসেবে নেতৃত্বে এসেছেন। কিন্তু শেখ মুজিবের চিন্তা-চেতনার কিছুই তিনি ধারণ করেননি। বরং দেশের রাজনৈতিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করেছেন হাসিনা। তার শাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আড়ালে কর্তৃত্ববাদী শাসন আর লুটপাট। এই যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলা হয়, সেটি নিয়ে আমি নিজেও নিশ্চিত না- এই কথাটি আসলে কী বোঝায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা সবাই বলে যাচ্ছে। কিন্তু এই চেতনার প্রকৃত অর্থ কী তা কখনো স্পষ্ট করা হয়নি। যদি চেতনা বলতে বোঝানো হয় ১৯৭১ সালে মানুষ কী স্বপ্ন দেখেছিল, কী পেতে চেয়েছিল, তাহলে বলা যায় সাধারণ মানুষের চেতনা আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের চেতনার মধ্যে কোনো মিল ছিল না। সাধারণ মানুষ চেয়েছিল দু-বেলা খেতে, নিরাপদ জীবন, একটা সম্মানজনক চাকরি, আর একটু নিরাপত্তা। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন ভাবছিল কীভাবে তারা সুযোগ নিয়ে সম্পদ বানাবে আর ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে।

এ বিষয়ে সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকউটর মো. তাজুল ইসলাম জানান, চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনালের তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেয়া জবানবন্দিতে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বহু ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে এ কথা বলেন বদরুদ্দীন উমর।

জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, ‘শেখ হাসিনার পালানোর পরদিন থেকেই সারাদেশে শেখ মুজিবের মূর্তি ও ম্যুরাল ভেঙে ফেলে সাধারণ মানুষ। কেউ কোনো নির্দেশ দেয়নি। তবু এটি ঘটেছে। এটি এক ধরনের প্রকৃতির প্রতিশোধ। যার বহিঃপ্রকাশ জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে। বহু বছর ধরে নির্যাতিত, অবদমিত জনগণের ক্রোধ এই অভ্যুত্থানে বিস্ফোরিত হয়েছে। এ অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ শুধু ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়নি। তারা জনগণের বিশ্বাস থেকেও বিতাড়িত হয়েছে। মুসলিম লীগের পতনের মতোই এবারের গণঅভ্যুত্থান আওয়ামী লীগের জন্য একটি চূড়ান্ত রাজনৈতিক পরিণতি তৈরি করেছে। ভারতের সহায়তায় তারা হয়তো কিছু অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চালাতে পারে। কিন্তু জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের পুনঃউত্থান অসম্ভব।

বদরুদ্দীন উমর বলেন, ‘২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। ভারত বা পাকিস্তানে এমন জনতার শক্তি ও ব্যাপকতার গণঅভ্যুত্থান কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশ নিজেই একটি গণঅভ্যুত্থানের দেশ- ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের ঘটনা উদাহরণ। তবে এসবের মধ্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান ছিল সবচেয়ে বিস্ফোরক ও রূপান্তরমূলক। ভাষা আন্দোলনের (১৯৫২) মধ্য দিয়ে ভাষার স্বীকৃতি এসেছিল। ১৯৬৯- এ আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল। ১৯৯০-এ এরশাদের পতনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব আন্দোলনে এমন সর্বগ্রাসী ভাঙন ও পলায়নপর সরকার বা দল দেখা যায়নি। শেখ হাসিনার সরকারের শাসন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। শেখ মুজিব ভারতপন্থি হলেও ভারতের নির্দেশে চলতেন না। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি ভারতের নকশায় নির্মিত। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা রাজনৈতিক নীতির প্রশ্ন নয়। বরং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। দলটির কার্যক্রম বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে। ভারতঘেঁষা কাঠামোগত এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে তারা। ফলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগের শাসনামলে বড় ধরনের সব অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা। আর তাকে সমর্থন দিয়ে গেছে ভারত। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। এছাড়া ভারতই তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ফলে পতনের পরও ভারতে পালিয়েছেন। সেখানেই থাকবেন তিনি। ওখানে থাকাটাই এক ধরনের শাস্তি। সেখানে তিনি জ্বলে-পুড়ে মরবেন। আরেকটা শাস্তি হতে পারে- যেটা আমি মনে করি, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ভারত সরকার তাকে মেরে ফেলবে। তারা যতদিন তাকে রাখবে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হবে না। আর সেই সম্পর্ক ভালো করতে গেলে তার ব্যাপারে একটা ফয়সালা করতে হবে। তাকে ওখানে রাখা যায় কি যায় না- সে প্রশ্ন না। তবে যদি মেরে ফেলে নরেন্দ্র মোদি আশ্চর্য হবেন না। তারা এমনভাবে বিষয়টা সাজাবে যে মনে হবে বাংলাদেশি কেউ তাকে মেরেছে। এ রকম একটি সংগঠিত প্রচার চালাবে।’

উল্লেখ্য, গত ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান লেখক-বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর। তিনি ছিলেন জুলাই গণআন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ