শহীদ আবু সাঈদ: ব্যর্থ নও তুমি, ব্যর্থ নয় তোমার আত্মার চিৎকার
আবু সাঈদ ২০০১ সালে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মকবুল হোসেন, মাতা মনোয়ারা বেগম। আবু সাঈদের ৬ ভাই ও ৩ বোন। ৯ ভাইবোনের মধ্যে আবু সাঈদ সবার ছোট। আবু সাঈদ স্থানীয় জাফরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর স্থানীয় খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন। ২০১৮ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরে তিনি ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। তিনি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ২০২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। টগবগে তরুণ মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। তাকে ঘিরে তার এলাকার মানুষ স্বপ্ন দেখতেন। সেই সাঈদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া অসহ্য কষ্টের।
অন্য যে কোনো দিন সাঈদ বাড়িতে গেলে মা-বাবা গভীর আনন্দের সঙ্গে অপেক্ষা করতেন। সেদিন অপেক্ষা করছিলেন মরদেহ দেখার জন্য। গর্ভে ধারণ করা বাবা-মায়ের মনে কত ঝড় যে বয়ে গেছে আমরা কি তার সামান্যটুকুও উপলব্ধি করতে পারব? মধ্যরাতের অন্ধকার ভেদ করে কান্নার করুণ সুর সেদিন উপস্থিত সবাইকে স্পর্শ করেছে। মা-বোন-স্বজনের আর্তনাদে উপস্থিত অনেকের চোখ ভিজেছে। বাবার পাথরদৃষ্টিতে গড়িয়ে পড়েছে অশ্রু। ছোটবেলা থেকে মেধার পরিচয় দিয়ে বেড়ে উঠছিলেন আবু সাঈদ। তার লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহ করার মতো সামর্থ্য পরিবারের ছিল না। নিজের পড়ালেখার ব্যয় নিজেই মেটাতেন। লেখাপড়া ছেড়ে দেয়ারও উপক্রম হয়েছিল কখনো কখনো। আবু সাঈদের বাড়িতে থাকার আলাদা কোনো ঘর ছিল না। দুভাই এক বিছানায় থাকতেন।
বাবা সামান্য জমি থেকে একটা অংশ বিক্রি করেছেন ঘর তোলার জন্য। দেয়ালটুকু কেবল তুলেছেন। পরিবারের সদস্যরা বলছিলেন সাঈদ বড় চাকরি করবে- এটা তার স্বপ্ন ছিল। ৫৬ শতাংশ কোটা থাকলে সেই স্বপ্ন পূরণ করা যে কিছুটা কঠিন সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তিনিও যুক্ত হন। এই আবু সাঈদকে ঘিরে বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই দিনটি বিশেষ দিনে পরিণত হয়েছে। এই দিনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ দানব সরকারের অস্ত্রের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দুই হাত প্রশস্ত করে দাঁড়িয়েছিলেন। বিশ্ববাসী দেখেছে বাঙালি তরুণের সাহস। বিশ্ব ইতিহাসেও আবু সাঈদ এক অনন্য চরিত্র হয়ে উঠেছেন। পুলিশের কয়েকজন সদস্য একসঙ্গে তাকে ঘিরে ধরে লাঠিতে মেরেছে। অকুতোভয় আবু সাঈদ এত মার খাওয়ার পরও অস্ত্রের সামনে দুই হাত প্রশস্ত করে দাঁড়াতে দ্বিধা করেননি।
আবু সাঈদকে কাছ থেকে নির্মমভাবে ছররা গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এরপরও জীবনের এমন এক উচ্চতায় আবু সাঈদ পৌঁছে গেছেন, যেখানে পৌঁছে গেলে মানুষ অমরত্ব লাভ করে। শ্রেণিকক্ষে কোনো দিন উঁচু গলায় কথা বলেননি যে আবু সাঈদ, সেই কিনা কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হয়ে উঠেছিলেন নেতৃস্থানীয় সংগঠক-সমন্বয়ক। টিউশনিতে উপার্জন করে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেকে চালাতে হতো। সেই টাকা থেকে কিছু দিয়ে আন্দোলনও এগিয়ে নিয়েছেন তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন দুর্বিনীত। সরকারি রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন শহীদ আবু সাঈদ। ছাত্রলীগের পেটোয়া বাহিনীর মার খেয়েও দমে যাননি বরং নিজেকে আরও দৃঢ় করে তুলেছিলেন আন্দোলনে।
সে সময় সরকার যা চাইত, তাই হতো। সেই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আবু সাঈদের মৃত্যু ঘটনাক্রমে নয়। বয়সে তরুণ হলেও তার বুদ্ধির স্তর ছিল পরিণত। বুদ্ধিদীপ্ত ছিল তার অবস্থান। আন্দোলনকে চাঙা করতে ফেসবুকে তিনি নূরলদীন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, শামসুজ্জোহা, রফিক, শফিক, বরকতকে নিয়ে লিখেছেন। সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে লিখেছেন। আন্দোলনের যৌক্তিকতা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। শহীদ আবু সাঈদ ১৫ জুলাই ফেসবুকে অনেকগুলো পোস্ট করেন। সব কটি কোটা সংস্কারের জন্য বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক হলেও তার অর্থ কোটা আন্দোলনের সীমাকে ছাড়িয়ে যায়।
শহীদ শামসুজ্জোহার মারা যাওয়ার আগের দিন কী বলেছিলেন, তা উল্লেখ করেও একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। শহীদ শামসুজ্জোহার উক্তিটি ছিল এমন- ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত। এরপর কোনো গুলি হলে তা ছাত্রদের না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে।’ আবু সাঈদের মন্তব্য ছিল- ‘অন্তত একজন শামসুজ্জোহা হয়ে মরে যাওয়াটা অনেক বেশি আনন্দের, সম্মানের আর গর্বের।’ এটাই ছিল ফেসবুকে তার শেষ পোস্ট। ১৫ জুলাই সরকারের এবং সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কঠোর সমালোচনা করে দীর্ঘ পোস্ট দিয়েছিলেন। এখানে বলেছেন, ‘আপনাদের মতের সাথে না মিললেই সে রাজাকার- এই অপকৌশল এখন আর চলবে না।’ এই পোস্টের শেষে লিখেছেন, ‘দেশের মালিক দেশের জনগণ, কাজেই জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিন।’
সরকার যা চাইবে তা-ই হবে এটা কোনো গণতান্ত্রিক দেশের চিত্র হতে পারে না। ১৪ জুলাই আবু সাঈদ লিখেছেন, ‘আমিও তো সেটাই কই বাঁচলে বাঁচার মতো বাঁচব। কারও রক্তচক্ষু ভয়ে, ন্যায়কে ন্যায় আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে পিছপা হবো না।’
১৩ জুলাই তারিখে আবু সাঈদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সবথেকে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো আপনি ন্যায়ের পক্ষে না অন্যায়ের পক্ষে। অন্যায়ের পক্ষে থেকে ১০০ বছর বাঁচার থেকে ন্যায়ের পক্ষে থেকে মরে যাওয়া উত্তম, সম্মানের ও শ্রেয়।’ ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শতবর্ষী হওয়ার বদলে ন্যায়ের পক্ষে থেকে মৃত্যুকে বরণ করেছেন বীরের বেশে। ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন মৃত্যুহীন প্রাণ। আবু সাঈদ ফেসবুকে মৃত্যুকে বরণ করে নেয়ার মতো পোস্ট দেয়ার কারণ আছে। আবু সাঈদসহ অন্য যে সমন্বয়করা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত কর্মসূচি পরিচালনা করেছেন, তাদের কাউকে কাউকে ভয় দেখানো হয়েছিল। আন্দোলন বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। তাদের গায়ে হাত তোলা হয়েছিল। সরকার, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠন সবাই মিলে আন্দোলন বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর। সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কারণে অতীতে অসংখ্য মানুষকে সরকার মেরেও ফেলেছে। ফলে আবু সাঈদ মৃত্যু হতে পারে জেনেও অনঢ় ছিলেন।
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন। এতে আন্দোলনে প্রথম শহীদ আবু সাঈদকে হত্যার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অনুরোধে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় সেপ্টেম্বরে একটি দল পাঠায়। এ দলে মানবাধিকার অনুসন্ধানকারী, একজন ফরেনসিক চিকিৎসক এবং একজন অস্ত্র বিশেষজ্ঞ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা মরণঘাতী ঘটনাগুলোর বিষয়ে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তথ্য অনুসন্ধান পরিচালনা করেন। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা, যারা সরাসরি বিক্ষোভ পরিচালনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বর্ণনা করেছে যে কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা একাধিক বৃহৎ আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন, যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছিল। একটি ফরেনসিক বিশ্লেষণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, তার আঘাতগুলো প্রায় ১৪ মিটার দূরত্ব থেকে ধাতব গুলিবোঝাই শটগান দিয়ে কমপক্ষে দুবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবু সাঈদ, পুলিশের ইচ্ছাকৃত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। জীবিত আবু সাঈদের চেয়ে মৃত আবু সাঈদ আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। শহীদ আবু সাঈদ জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছেন মৃত্যুও কত সুন্দর হতে পারে, অর্থবহ হতে পারে।
দেশজুড়ে আন্দোলনকারীরা যেন আবু সাঈদের মতো হয়ে উঠেছিল। তারাও মৃত্যুভয় পদদলিত করে এগিয়ে গেছে প্রতিদিন। সেই এগিয়ে চলার পরিণতি ৫ আগস্ট দানব সরকারের পতন। যতক্ষণ দানব সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল, ততক্ষণ আবু সাঈদকে নিয়ে সীমাহীন মিথ্যাচার করাও হয়েছে। মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছিল। মৃত আবু সাঈদের প্রতিও করা হয়েছে অবিচার। এরই মধ্যে একটি বছর চলে গেছে। আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিচারেও এসেছে অগ্রগতি। আমরা চাই, শহীদ আবু সাঈদসহ জুলাই অভ্যুত্থানের সব হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক। দেশে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রাণের বিসর্জন, সে ন্যায় প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল জীবনদান সার্থক হবে। ‘ব্যর্থ নও তুমি, ব্যর্থ নয় তোমার আত্মার চিৎকার; তবে ব্যর্থ হয়েছে ওরা, সীমাহীন নির্মম নিষ্ঠুরতায়, কালের সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।’
রায়হান আহমেদ তপাদার: গবেষক ও কলাম লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে