বিজ্ঞান, যুদ্ধ, ভূরাজনীতি এবং এক আত্মঘাতী কুঠারের গল্প
প্রদীপের ভেতর ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাবেন না, সে আপনাকে পুরস্কৃত করার বদলে মেরেও ফেলতে পারে! না, এমন কথা আলিফ লায়লার গল্পে বলা হয়নি; কিন্তু মানবজাতি যে ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগিয়েছে, তার কাছে প্রদীপের দৈত্যের শক্তি নস্যি।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ইরান আক্রমণ হঠাৎ করল, কেন ইরাক যুদ্ধ করেছিল, লিবিয়াকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল? সেই একই যুক্তরাষ্ট্রকে হরদম হুমকি দিয়ে যাওয়া উত্তর কোরিয়াকে কেন আক্রমণ করছে না? এসব প্রশ্নের উত্তর একসূত্রে গাঁথা। আর সেই সুতোটা হলো নিউক্লিয়ার বোমা। যার সূচনা হয়েছিল ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দুটি গুঁড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে।
মানুষ কি জানত না, নিউক্লিয়ার বোমা নামের দৈত্যকে জাগালে ফল কত ভয়াবহ হবে। জানত, জেনেশুনেই বিষপান করেছে। তখন এমন একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল, হিটলার নামের এক জুজুর ভয় গোটা বিশ্বকে এতটাই বিপন্নবোধ করিয়ে রেখেছিল যে, শান্তিকামী আইনস্টাইন পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করতে। সেই অনুরোধের অনুশোচনা আইনস্টাইনকে বাকি জীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি।
শুরুটা হয়েছিল আইনস্টাইনের হাত ধরেই। ১৯০৫ সালে পাঁচ-পাঁচটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন ‘অ্যানালেন ডার ফিজিক’ নামের বিখ্যাত জার্মান জার্নালে। এই পাঁচ প্রবন্ধের একটা ছিল পরমাণুতত্ত্বের গাণিতিক প্রমাণ এবং একটাতে তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্বের গাণিতিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। বাকি তিনটির সাহায্যে স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি অর্থাৎ বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
শক্তিকে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া ছিল স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটির অন্যতম ভবিষ্যদ্বাণী। আইনস্টাইন তার সেই বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 সূত্রের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন সে কথা। এই সমীকরণের সার কথা ছিল ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। সেটা যদি সম্ভব হয় তা হলে সামান্য একটু বস্তু থেকে পাওয়া যাবে বিশাল পরিমাণ শক্তি। প্রায় তিন দশক খাতা কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল এই শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়াটা। এমনকি খোদ আইনস্টাইনও বিশ্বাস করতেন না এভাবে আসলেই শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব; কিন্তু বেশ কয়েকজন নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্টি প্রমাণ করেন, সূর্যের ভেতরেই সব সময় ঘটে চলেছে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া এবং সেটা আইনস্টাইনের ওই বিখ্যাত সমীকরণ মেনেই। এমনকি পরমাণুর ভেতরে নিউক্লিয়াসের ভেতর যেসব নিউট্রন-প্রোটন আছে সেগুলোও আইনস্টাইনে ওই সমীকরণ মেনে চলে বলেই শক্তির ভারসাম্য ঠিকঠাক পাওয়া যায়। নইলে নিউক্লিয়ার বন্ধন তৈরি করে পরমাণুগুলো স্থিতিশীল হতে পারত না।
সূর্য আমাদের থেকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে আর পরমাণুর স্থিতিশীলতার ব্যাপারটার প্রমাণ তখনই মিলবে যখন, পরমাণুকে ভেঙে নিউক্লিয়ার শক্তিমুক্ত করা সম্ভব হবে। অবশ্য পরমাণু ভাঙনের প্রমাণ আগেই দিয়েছিলেন কিউই-ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদাফোর্ড। তিনি দেখিয়েছিলেন তেজস্ক্রিয় পরমাণুগুলো কীভাবে নিজেদের নিউক্লিয়াস ভেঙে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। পরে হেনরি বেকরেল, মেরি ও পিয়েরে কুরিদের মতো পরমাণুবিজ্ঞানীরা ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম ও পোলেনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করেন।
রাদাফোর্ড, বেকরেল ও কুরি দম্পতির আবিষ্কারগুলো ছিল তেজস্ক্রিয় পরমাণুর স্বতঃস্ফূর্ত ভাঙন; কিন্তু বড় পরিসরে পারমাণবিক বোমা বানানোর মতো শক্তি আদৌ উৎপাদন করা সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে আসলে কেউই নিশ্চিত ছিলেন না। আইনস্টাইন তো একেবারেই নয়।
১৯৩৯ সাল। হিটলারের তখন দুর্দান্ত প্রতাপ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত সারিয়ে গোটা বিশ্বকে পদানত করার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। শুরুটা করেন পোলান্ডকে দিয়ে, তারপর একে একে ডেনমার্ক, নরওয়ে, নেদারল্যান্ড এমনকি ফ্রান্সও দখল করে নেন; বাকি কেবল চিরশত্রু ইংল্যান্ড। হিটলার জানতেন, ব্রিটেনের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে পারলে বাকি পৃথিবী এমনিতেই তার পদানত হবে; কিন্তু রণাঙ্গনে তার বিপক্ষে লড়ছে বিশাল সামরিক শক্তি দিয়ে রাশিয়া এবং প্রযুক্তি আর অস্ত্রের পসরা সাজিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। তবুও কি হিটলারকে দমানো যায়! আটলান্টিক মহাসাগরজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে তার নৌবাহিনী। কিছুতেই তাদের আটকানো যাচ্ছে না। নিখুঁত আক্রমণে তছনছ করে দিচ্ছে মিত্রবাহিনীর একের পর এক ঘাঁটি। কেন হিলটার বাহিনীকে ঠেকানো যাচ্ছে না, মিত্র বাহিনীর বড় বড় মাথারা সেটা বুঝতে পারেননি। পেরেছিলেন ছোট্ট একটা গ্রুপে কাজ করা একদল ইঞ্জিনিয়ার। যার নেতৃত্বে ছিলেন আধুনিক কম্পিউটারের অন্যতম পুরোধা অ্যালান টুরিং। টুরিং বুঝতে পারলেন, হিটলালের নাৎসি বাহিনীর মূল শক্তি তাদের শক্তিশালী বেতার যোগাযোগ ব্যবস্থায় যা পরিচালিত হয় জটিল সাংকেতিক ভাষায়। টুরিং তার দলবল নিয়ে হিটলারের সাংকেতিক ভাষাগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং সফল হন। তারপর থেকেই মিত্রবাহিনী একের পর এক নাৎসিদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে শুরু করে। ক্রমেই পিছিয়ে পড়ে জার্মানি-জাপান ও ইতালি জোট।
এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায় ছিল পারমাণবিক বোমা; যে বিষয়ে হিটলার অনেকটা আশাবাদী ছিলেন। তার দেশের বিজ্ঞানীরা নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ছড়ি ঘুরিয়েছে, এখন সময় এসেছে দেশের জন্য সেসব বিজ্ঞানীদের কিছু করার। সুতরাং জল-স্থলে হামলার পাশাপাশি নিউক্লিয়ার ল্যাব বানিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন একদল বিজ্ঞানীকে। তবে তার আগে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল চালিয়ে অনেকখানি পঙ্গু করে ফেলেছেন নিজেকে। তার দেশের নামজাদা বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ ইহুদি। আর ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে গিয়েই কিনা তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে বসেছেন। সুতরাং তার দেশের বিজ্ঞানীরা আর দেশে থাকতে পারলেন কই? যার তত্ত্বের ওপর ভর করে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি হবে সেই আইনস্টাইন পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, ইতালি থেকে পালিয়েছেন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের আরেক দিকপাল এনরিকো ফার্মি। ইউরোপের অন্যসব দেশ থেকেও একে একে বিজ্ঞানীরা আটলান্টিক পেরিয়ে পা রাখছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
কিন্তু তখনো হিটলারের হাতে সুযোগ ছিল। কোয়ান্টাম ম্যাকানিকসের প্রবাদপুরুষ, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী ও গবেষকদের লাগিয়ে দিয়েছেন নিউক্লিয়ার বোমা কর্মসূচিতে। গোয়েন্দা সূত্রে সে তথ্য আটলান্টিকের ওপারে পৌঁছুতে সময় লাগেনি।
হিটলারের হাতে নিউক্লিয়ার বোমা! স্বভাবতই গোটা বিশ্বের চিন্তকদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল। হিটলারের খ্যাপামি উদাহরণ তখন মাঠেই দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এই সাইকো টাইপের লোকটা যদি আগে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরি করতে পারে তাহলে গোটা পৃথিবীই হুমকির মুখে পড়বে। তার আগেই মিত্রশক্তির কিছু করা উচিত। ব্রিটেনের তখন নিউক্লিয়ার কর্মসূচি হাতে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। রাশিয়া? আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে সোভিয়েত ইউনিয়ন কি অতটা উন্নত? সুতরাং মার্কিনিরাই ভরসা। তাদের ভৌগোলিক অবস্থান তখনো হিটলারের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, গবেষণাগারগুলো উদার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপের সেরা মাথাগুলোর জন্য। মোটা মাইনে, বাড়ি-গাড়ি, উন্নত ল্যাবরেটরি- কী নেই সেখানে! ইরোপের সেরা বিজ্ঞানীরা দলে দলে সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন। তাই আইনস্টাইন রুজভেল্টকে চিঠি লেখেন, দ্রুতই যেন এমন কিছু করেন যেন হিটলারকে রুখে দেয়া যায়। অর্থাৎ নিউক্লিয়ার অস্ত্র দিয়েই হিটলালের নিউক্লিয়ার অস্ত্রের মোকাবেলা করতে হবে; কিন্তু আইনস্টাইন তখনো নিশ্চিত ছিলেন, গবেষণাগারে অন্তত পারমাণবিক বোমার মতো কিছু তৈরি করা সম্ভব নয়। তাই খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন না।
অন্যদিকে মার্কিন সরকার, সামরিক বাহিনীর হর্তাকর্তারা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলিই নিয়েছিলেন। সেজন্য তারা চালু করেন ম্যানহাটন প্রকল্প। সেই প্রকল্পের প্রধান করা হলো জ্যোতির্পদার্থবিদ ও নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারকে। সেটা ১৯৪১ সালে। সে বছর ১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র এই বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তারপরই তারা ম্যানহাটন প্রকল্প হাতে নেয়। তার আগে থেকেই ঢাক গুড়গুড় চলছিল।
১৯৩৭ সালে নীলস বোর আর আর্চবিল্ড হুইলার ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’ নামের বিখ্যাত মার্কিন জার্নালে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া নিয়ে একটা মৌলিক গবেষণাপত্র করেন। তখনই নিউক্লিয়ার বোমার সম্ভাব্যতা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়।
নিউক্লিয়ার ফিশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ফ্রান্সে কাজটা শুরু করেন মেরি ও পিয়েরে কুরির মেয়ে ও জামাতা আইরিন ও জোলিও কুরি; জার্মানিতে অটো হান, ফিৎস স্ট্রেসম্যান ও লিস মাইটনার। ১৯৩৮ সালে হিটলার ইহুদিদের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়বহ গণহত্যা শুরু করেন। জন্মসূত্রে ইহুদি মাইটনার প্রাণভয়ে পালিয়ে যান সুইডেনে। সেখানে গিয়ে তার বোনের ছেলে অটো ফিৎশকে সঙ্গে নিয়ে চালিয়ে যান গবেষণা। অন্যদিকে অটো হান-স্ট্রেস ম্যানের সঙ্গেও তাদের নিয়মিত যোগাযোগ বজায় থাকে।
১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল। নিশ্চিত পরাজয় জেনে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেন অ্যাডলফ হিটলার। এরপরই বিধ্বস্ত, ছত্রভঙ্গ জার্মানি। মার্কিন আর ব্রিটিশ সেনারা দলে দলে ঢুকে পড়ে দেশটাতে। এদেরই একটা দলের দায়িত্ব ছিল জার্মান নিউক্লিয়ার বোমার প্রকল্পের শুলুক সন্ধান করা- আদৌ কি কোনো প্রকল্প হিটলার হাতে নিয়েছিল কিনা, নিলেও কতটা এগোলো তারা- এসব জানা। ঠিকই হিটলারের নিউক্লিয়ার ল্যাবরেটরির সন্ধান পেয়ে যায় দলটি। বন্দি করা হয় সেটার সঙ্গে যুক্ত দশ নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানীকে- এরিখ ব্র্যাগ, কার্ট ডিবনার, ওয়াল্টার গ্যেরলাখ, পল হার্টেক, হরস্ট করশিং, ম্যাক্স ভন লু, কার্ল ওয়ার্টজ, কার্ল ফ্রেডরিখ লন ওয়াইজাকার, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং অটো হান। তাদের বন্দি করে রাখা হয় ইংল্যান্ডের একটি গ্রামে ফার্ম হল নামের একটি বাড়িতে।
বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অবশ্য আরসব বন্দিদের মতো আচরণ করেনি মার্কিন সেনারা। তাদের ওইভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। বরং তাদের যে কক্ষে বন্দি করা হয় তাতে একটা স্পাই মাইক্রোফোন লাগিয়ে দেয়া হয়। বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন, সেখানে নিশ্চয়ই তাদের কাজ ও অগ্রগতি সম্পর্কে কথা বলবেন। মার্কিনিদের এই কৌশল কাজে লাগে বেশ ভালো মতোই।
ডিসেম্বর ১৯৪৫ সাল। হিটলারের মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই; কিন্তু যুদ্ধ তখনো থামেনি। জাপান একাই চালিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধ। ঠিক তখনই আমেরিকা গুছিয়ে এনেছে পারমাণবিক বোমা তৈরির সকল কাজ। ওই বছরই ১৬ জুলাই পারমাণবিক বোমা প্রথম বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে নিউ ম্যাক্সিকো অঙ্গরাজ্যের জর্নাদা দেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে, ইতিহাসে এটা ট্রিনিটি টেস্ট নামে পরিচিত। সফল এই বিস্ফোরণের পর এবার আসল ময়দানে পরীক্ষার পালা। সঙ্গে প্রতিশোধেরও। ঠিক পাঁচ বছর আগে ১৯৪১ সালে ৬ ডিসেম্বর জাপান যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারের বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ২ হাজার ৪শ জনকে হত্যা করে। পাঁচ বছর পর ১৯৪৫ সালের ৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোসিমায় প্রথম পারমাণবিক বোমা ফ্যাট ম্যান নিক্ষেপ করে, ৯ ডিসেম্বর লিটিল বয় নিক্ষেপ করে নাগাসাকিতে। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ২ লাখ ১৪ হাজার লোক মারা যায়। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে আরও দুই লাখ লোক পরে নানা রোগভোগে মারা যায়।
৪ লাখেরও বেশি লোকের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া এই নিউক্লিয়ার বোমা আশীর্বাদ না অভিশাপ সেটা এখনি বলা মুশকিল। যেমন, এ ঘটনার দিন বিশেক আগে ট্রিনিটি পরীক্ষার পর ১৯৪৪ সালের রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় অটো হানকে। বিজ্ঞানী তখনো ইংল্যান্ডের ফার্ম হলে বন্দি। পুরস্কার পেলেন বটে; কিন্তু হিরোসিমা-নাগাসাকি কাণ্ডের পর অটো হান আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন নিজের আবিষ্কারের এমন ভয়াবহ রূপ দেখে। রক্ষীরা তাকে অ্যালকোহলের নেশায় ডুবিয়ে রেখে পরিস্থিতি শান্ত করেছিল।
ওয়াল্টার গ্যেরলাখও আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন, তবে সেটা সম্ভবত জাপানিদের প্রাণহানির কারণে নয়। যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক বিজ্ঞানীর ব্যর্থতার জন্য ধিক্কার শোনার ভয়ে। অন্যদিকে ভন ওয়াইজাকার বলেছিলে, ‘আমেরিকা নৃশংসতার চূড়ান্ত রূপ দেখালো। স্রেফ উন্মত্ত আচরণ।’
জবাবে হাইজেনবার্গ বলেছিলেন, ‘এটাই যুদ্ধ শেষ করার দ্রুততম পন্থা।’
জাপানে পারমাণবিক বোমার হুকুমদাতা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। তার কোনো অনুতাপ ছিল না। বরং এর জন্য তিনি রীতিমতো গর্ব করতেন। অন্যদিকে জাপানের ভয়াবহতা দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন ওপেনহাইমার। ছুটে গিয়েছিলেন ট্রুম্যানের কাছে। বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞানীদের হাত আজ রক্তমাখা।’
জবাবে মুচকি হেসে ট্রুম্যান পকেট থেকে রুমাল বের করে ওপেনহাইমারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘মুছে ফেলুন।’
বলার অপেক্ষা রাখে না- এ ঘটনার পর ট্রুম্যান ওপেনহাইমারের ওপর ভীষণ চটে গিয়েছিলেন। পরে সামরিক কর্মকর্তা লিলিয়েনথালকে বলেছিলেন, ‘এই শুয়োরের বাচ্চাটা যেন আর আমার সামনে না আসে। ও ছিচকাদুনে বিজ্ঞানী!’ তারপর মার্কিন প্রশাসনের বিষদৃষ্টিতে পড়া ওপেনহেইমারের ওপর নেমে এসেছিল অভিশাপ। সে গল্প না হয় আরেকদিন হবে।
আসলে ওপেনহাইমারের অবস্থা হয়েছিল প্রবাদবাক্যের ওই কুঠারের মতো, যে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছিল। আইনস্টাইনও কি আরেকজন কুঠার নন? কথিত আছে, এক সাংবাদিক নাকি আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলো নিউক্লিয়ার বোমার মাধ্যমে। আপনার কী মনে হয়? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ কী অস্ত্র ব্যবহার করবে?’
জবাবে আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানুষ কী ব্যবহার করবে আমি জানি না। তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধে লাঠি আর ইট পাটকেল ছাড়া মানুষের হাতে আর কিছু থাকবে না।’
মানব সভ্যতার এ এক ভয়ংকর পিছু হটার ইঙ্গিত। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন মানুষের কল্যাণের জন্য; কিন্তু ক্ষমতাবানরা সেই আবিষ্কার ব্যবহার করে মানুষকে ধ্বংস করার নীলনকশা আঁকেন। বিজ্ঞান তাদের কাছে একধরনের পণ্য। যে পণ্য বিক্রি করা যায়, এর সাহায্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলে মানুষ মারা যায়, সর্বোপরি আত্মঘাতী কুঠারের মতো নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা যায়।
আবদুল গাফফার রনি: বিজ্ঞান লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে