Views Bangladesh Logo

চিড়িয়াখানা বানানোর হাত থেকে মাইলস্টোন স্কুলটি রক্ষা করুন

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষার্থীর কথা শুনে লজ্জায় মাথা নত হয়ে গেল। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সে বলছে, মানুষ এখন বোরিং ফিল করছে, তাই আমাদের স্কুল দেখতে আসছে। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে আসছে। এসে তারা বাদাম খাচ্ছে, ঝালমুড়ি খাচ্ছে, আখের রস খাচ্ছে, চটপটি খাচ্ছে। আমাদের স্কুলটি এখন চিড়িয়াখানা। টিকিট বিক্রি করলে আমরা কোটিপতি হয়ে যাব। তারা আবার বলছে, ভিড়ের কারণে আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তারা দাড়োয়ানকে গেট খুলে দিতে বলছে। ভেতরে গিয়ে দেখবে। ভেতরে গিয়ে কী দেখবে তারা? শিশুদের পোড়াদেহ? শিশুদের পোড়াদেহ দেখতে আসছে তারা।

মেয়েটির কথা শুনে মনে হলো সারা জাতির গালে মেয়েটি কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিল। মেয়েটির বয়স হবে বারো-তেরো। শান্ত স্বরে সে কথাগুলো বলছিল। এরকম চাবুক মারার মতো কথা কিশোরীটি কোথায় শিখল?

শিখেছে তার দুঃখ থেকে। চোখের সামনে সে তার প্রিয় বন্ধুদের পুড়ে মরে যেতে দেখেছে। আর কতিপয় উজবুক সেখানে গিয়ে তামাশা দেখছে! শত শত মানুষ নয়, হাজার হাজার মানুষ! প্রতিদিন সেখানে গিয়ে ভিড় করছে। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেল। এখনো মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে ভিড় করছে হাজার হাজার মানুষ। দূর-দূরান্তর থেকে আসছে তারা। যেন সার্কাস বসেছে! আসছে পরিবারের সদস্যরা সবাই, শিশুদের নিয়ে। কী কাণ্ড!

তাদের কি কোনো বোধবুদ্ধি নেই- যে, মানুষ মারা গেছে এখানে, কিছু শিশু মারা গেছে। এখানে দেখার কিছু নেই। মেয়েটি খুব যথার্থ শব্দ ব্যবহার করেছে, যে বোরিং ফিল করলেই মানুষ আমাদের স্কুলটি দেখতে আসছে!

চিন্তা করা যায়! এর কোনো ব্যাখ্যা বোধহয় সমাজতাত্ত্বিকদের কাছেও নেই। উৎসাহী দর্শকরা আসলে কী দেখতে চাচ্ছে? কী বুঝতে চাচ্ছে? তাদের মনে কি একটু দুঃখবোধ নেই? ওই শিক্ষার্থী মেয়েটি খুবই দুঃখভরা কণ্ঠে বলছিল, যখন আমাদের বন্ধুরা আগুনে পুড়ে যাচ্ছিল তখনো অনেকে ছোটাছুটি করেছে ভেতরে যাওয়ার জন্য। চোখের সামনে তারা পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে চাচ্ছিল। একটা আধপোড়া ছেলেকে নিয়ে বাবা গেছে দোকানে পানি কিনতে, দোকানদার বলে, এক বোতল পানির দাম ৬০০ টাকা। বাবা বলেন, ‘আমার কাছে এত টাকা নাই।’ দোকানদার বলে, ‘তাহলে পানি দেয়া যাবে না। আমার আরও অনেক কাস্টমার আছে।’ ওই কাস্টমার কারা? যাদের শরীর পুড়ে গেছে। ছোট শিশুদের।

এখন আপনি ভাবেন? এই কথাগুলো শোনার পর আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে? ওই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এখনো যারা গিয়ে ভিড় করছে তারা কারা? তাদের কি ন্যূনতম শিক্ষাদীক্ষা নাই? কী রং-তামাশা দেখতে যাচ্ছে তারা সেখানে? আর প্রশাসনও কেন তাদের অনুমতি দিচ্ছে? স্কুলটি বন্ধ করে রেখেছে; কিন্তু উচিত ছিল স্কুলের কাছেও কাউকে ভিড়তে না দেয়া।

এর মধ্যে শত শত সাংবাদিক গিয়ে ঘটনার আদ্যপান্ত তুলে আনছে। আছে অসংখ্য কনটেন্ট ক্রিয়েটর। যতটা না সংবাদ সংগ্রহ তার চেয়ে বেশি যেন মজা লুটছে। এও এক প্রকার পর্নোগ্রাফি। মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, অনেক মানুষ আছে যারা অপরের দুঃখ-দুর্দশা থেকে এক ধরনের সেক্সুয়াল প্লেজার লাভ করে। ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকেও অনেকে আনন্দ লাভ করে।

এই ‘মরবিড কিউরিসিটি’ বা ‘অসুস্থ কৌতূহল’ আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কেন এমন মহামারির মতো জেগে উঠল? তাদের জীবনে কি স্বাভাবিক আনন্দ নেই? সুস্থতা নেই? সুস্থ বিনোদন নেই? তা যে নেই তাও আমরা বুঝতে পারি নানা অসুস্থ উপসর্গ থেকেই।

এখন এটা নীতিশিক্ষার বিষয় না, উচিত কথা বলার বিষয় না, গালাগালিরও বিষয় না; আমাদের আসলে সামাজিক গবেষণা খুব দরকার- কেন আমাদের মানুষরা অন্যের বিপদের সময়ও এমন উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

শুধু যে সাধারণ মানুষ তা তো না। রাজনীতিবিদরাও এ নিয়ে রাজনীতি করতে ছাড়লেন না। জাতি হিসেবে আমরা কতটা অধঃপতনের দিকে যাচ্ছি এগুলো তারই প্রতিচ্ছবি। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরও আমরা সামাজিক-রাষ্ট্রিক-প্রশাসনিক ক্ষেত্রে অনেক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখলাম। আমরা দেখলাম আমাদের অনেক সিদ্ধান্ত ভুল, অনেক পদক্ষেপ ভুল। আর এই ভুলের মাসুল দিতে হলো কিছু কোমলমতি শিশুদের। চোখের সামনে এই শিশুদের মৃত্যুও আমাদের কোনো শিক্ষা দেয়নি।

আর সবশেষে কিছু উচিত কথা বেরিয়ে এল প্রায় এক শিশুর কাছ থেকেই। ছোট্ট একটি মেয়ে আমাদের চোখের দিকে আঙুল তুলে জানাল, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যর্থ। সভ্য মানুষ হয়ে উঠতে আমাদের এখনো অনেক দেরি।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ