স্মরণ
আড্ডাবাজ কবি শহীদ কাদরী ও তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা
যদি বলা হয়, বাংলা সাহিত্যের তুমুল আড্ডাবাজ কবি কে? উত্তরে যাদের নাম সবার আগে আসবে তাদের মধ্যে অন্যতম কবি শহীদ কাদরী। একটা সময় শহীদ কাদরী ছিলেন জলজ্যান্ত এক আড্ডার নাম। তার সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গেও আড্ডা দিতে পারেন। কবি নিজেই বলতেন, আমি হচ্ছি ইমিগ্র্যান্ট আড্ডাবাজ। আড্ডার নেতৃত্ব দিতেন নিজেই। কোথায় ছিল না আড্ডা- বিউটি বোর্ডিং, রেক্স রেস্তোরাঁ, কথাশিল্পী রশীদ করীমের বাড়ি, কবি শামসুর রাহমানের বাড়ি, শিক্ষাবিদ ফজল শাহাবুদ্দিনের অফিস, সন্ধানী পত্রিকা আর পুরানা পল্টন সর্বত্রই। আড্ডা হতো নিয়মিত।
আড্ডায় থাকতেন রথী-মহারথীরা। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দিন, কায়সুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, মান্নান সৈয়দ, মাহমুদুল হক, সিকদার আমিনুল হক। আড্ডায় মাঝেমধ্যে আসতেন মফিদুল হক, কখনো আবুল হাসনাত, বিপ্লব দাশ, মুহম্মদ খসরু, রাজীব আহসান চৌধুরী প্রমুখ। আর আসত এক ঝাঁক তরুণ- আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার, ইকবাল হাসান, মাহাবুব হাসান, হাফিজুর রহমান।
কবির প্রয়াণের পর সাহিত্য সাময়িকী ‘কালের খেয়া’য় একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেই সাক্ষাৎকারে আড্ডার স্মৃতিচারণ করে কবি বলেন, ‘মান্নান সৈয়দ ছিলেন আমার মতোই তুমুল আড্ডাবাজ। এক সন্ধ্যার কথা মনে পড়ে- গ্রিনরোডে মান্নান সৈয়দের বাসায় হাজির হলাম, সঙ্গে রফিক আজাদ ও ইকবাল। গিয়ে দেখি, পুরো বাড়ি আলোকে আলোকময়- মান্নানের বোনের বিয়ে। রফিক বলল, ‘ওস্তাদ, আড্ডা কিন্তু ছাড়া যাবে না। মান্নান বিয়ে নিয়ে থাকুক, আমরা আমাদের মতো আড্ডা দেব। আমাদের শুধু একটা রুম হলেই চলবে।’ সে রাতে মান্নান ব্যস্ততার মধ্যেও আমাদের সঙ্গে রাতের শেষ অব্দি পর্যন্ত আড্ডা দিয়েছিলাম।’
দেশভাগ-পরবর্তী বাঙালি কবিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শহীদ কাদরী। যারা বাংলা কবিতায় নাগরিকতা ও আধুনিকতাবোধের সূচনা করেছিলেন, তাদের অন্যতম শহীদ কাদরী। ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কলকাতা শহরে কাটে তার শৈশব। তখনকার একটি স্মৃতিচারণ করে কবি বলেন, ‘ভারত ভাগের পরও আমরা কলকাতায় ছিলাম। বাবা হঠাৎ কলকাতায়ই মারা যান। আমার এক ফুফু ছিলেন ঢাকায়- খুবই কান্নাকাটি করতেন আমাদের জন্য। তখন কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হতো খুব। ফুফুর মনে তখন আমাদের নিয়ে নানা আশঙ্কা- ১৯৫২ সালে আমরা ঢাকায় চলে আসি।’
কলকাতার দাঙ্গা ব্যথিত করেছিলে কবির হৃদয়। দাঙ্গার বেদনা নিয়ে লিখেছেন কবিতা: ‘একটা মেয়ে খোঁপায় তার কোমল লাল গোলাপ/ ছুরিতে বেঁধা কোলকাতার শানানো ফুটপাতে/দেখেছিলাম ছেলেবেলায় ম্যানহোলের পাশে/রয়েছে পড়ে স্তনের নীচে হা-খোলা এক ক্ষত/হুবহু এই লাল গোলাপের মতো/ আজকে তাই তোমার দেয়া কোমল লাল গোলাপ/তীক্ষ্ণ হিম ছুরির মতো বিঁধল যেন বুকে।’
কিছুতেই যেন ভুলতে পারেন না কলকাতার স্মৃতি। সেই কথা স্মরণ করেছিলেন কবি। তখন কলকাতা ছিল অত্যাধুনিক শহর। কবি বলেন, ‘আমরা তখন ইঙ্গো-বঙ্গো সমাজের মতো ইংরেজিতে কথা বলতাম, কাউবয় মুভি দেখতাম। কেক-পেস্ট্রির দোকান চালাত ডাচ, ইংরেজ, জার্মান আর ফরাসিরা। আমরা সুইজারল্যান্ডের আইসক্রিম খেতাম। সেই কলকাতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। কলকাতার একজন সাধারণ মানুষও যে কত সমৃদ্ধ, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাদের যে কত অনুরাগ, আত্মিক টান- একটি উদাহরণ থেকে বুঝতে পারবে। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরছি। দেখি, ফুটপাতে একজন বই বিক্রি করছে। আমি একটি বই হাতে নিয়ে উচ্চারণ করলাম, লেস মিজারেবল। দোকানি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, খোকা, বইটির নাম ‘লা মিজারেবল।’ এই হচ্ছে কলকাতা।’
কী রকম ছিল সেই প্রিয়তম শহর কলকাতা ছেড়ে চলে আসা? কবি বললেন, খুবই বেদনার। ইস্পাহানির ওরিয়েন্টাল এয়ারলাইন্সে যখন কলকাতা থেকে ঢাকা এসে নামলাম- মনে হলো, আলোর রাজ্য থেকে এক অন্ধকার গলিতে প্রবেশ করেছি। কলকাতায় আমি কোনোদিন নৌকো দেখিনি। ঢাকার সদরঘাটে নৌকা দেখা ছিল এক বিস্ময়ের মতো। আমার বয়স তখন ১০। প্রথম দিন বুড়িগঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকা দেখে আমি তো রীতিমতো অবাক। কী আশ্চর্য, ঢাকায় এভাবে সারাজীবন নৌকা দেখতে পারব! প্রতিদিন বিকেলে সদরঘাট যেতাম নৌকা দেখতে। তারপর রিভারভিউ ক্যাফেতে বসে চা আর চকোলেট বিস্কুট খেয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম। ওখানে করোনেশান পার্ক বলে একটা পার্ক ছিল। ওই পার্কে গিয়ে বসতাম আমার এক কাজিনকে নিয়ে। আমার সেই কাজিনটা মারা গেছে।’
কবি মনে করতেন, তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ১৯৭৮-এ দেশ ছেড়ে হঠাৎ চলে আসা। তিনি মনে করতেন, একজন লেখকের মাতৃভূমি ত্যাগ করা আত্মহত্যার শামিল। দেশের নিত্যদিনের ঘটনাপ্রবাহ যে তরঙ্গের সৃষ্টি করে, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা একজন লেখকের জন্য জরুরি। আমি জীবনে অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। সেই বেদনা থেকে কবি লিখেছিলেন, ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর/জুঁই, চামেলি চন্দ্রমল্লিকা কিংবা কাঠগোলাপ থেকে/টিউলিপ ম্যাগনোলিয়া অথবা ক্রিসেনথিমামে/নিজস্ব শহর থেকে অচেনা ফুটপাতে/এশিয়ার আকাশে ময়ূর নীল থেকে/কুয়াশাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যে/না, কোনো নির্বাসনই কাম্য নয় আর।’
প্রেম নিয়ে অনেক কবিতার মধ্যে তার একটি বিখ্যাত কবিতার কথা রয়েছে, প্রেমের দুরন্ত অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে কবি শহীদ কাদরীর ‘ভয় নেই/আমি এমন ব্যবস্থা করব যাতে সেনাবাহিনী/গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে/মার্চপাস্ট করে চলে যাবে/এবং স্যালুট করবে/কেবল তোমাকেই প্রিয়তমা...।
১৯৭৮ সাল থেকে কবির প্রবাসজীবন শুরু হয়। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালে তিনি ‘পরিক্রমা’ শিরোনামে তার প্রথম কবিতা রচনা করেন; যা মহিউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘স্পন্দন’ কাগজে ছাপা হয়েছিল। পঁচিশ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে ছাপা হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উত্তরাধিকার।’ এরপর ১৯৭৪ সালে ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’, ১৯৭৮ সালে ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’ এবং প্রবাসে থাকাকালে রচিত কবিতা নিয়ে ২০০৯ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ প্রকাশিত হয়।
২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট নিউইয়র্কের নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে ৭৪ বছর বয়সে কবি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে রইল অবারিত শ্রদ্ধা।
শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: তরুণ লেখক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে