Views Bangladesh Logo

ধর্ষণ-সংস্কৃতির শিকড় সমাজেই

জকের বাংলাদেশে কিংবা উপমহাদেশের কোথাও ধর্ষণের ঘটনা শুনলে কেউ আর চমকে ওঠেন না। খবরের কাগজের পাতায় কিংবা টিভি স্ক্রলে লেখা থাকে- ‘ধর্ষণ’, ‘দলবদ্ধ ধর্ষণ’, ‘ধর্ষণের পর হত্যা’- এই শব্দগুলো যেন আমাদের চেনা অভিধানের অংশ হয়ে উঠেছে। একটা ধর্ষণ ঘটলে সরকারকে দোষ দেয়া হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাঠগড়ায় তোলা হয়, কেউ কেউ প্রশাসনের ওপর রাগ ঝাড়েন। এই দায় চাপানোর মধ্যে যেন এক ধরনের আত্মতুষ্টিও কাজ করে- ‘দেখো, আমরা প্রতিবাদ করছি’, ‘আমরা দায় নিচ্ছি না’।

কিন্তু সত্যি কথা হলো, শুধু সরকারকে গালমন্দ করে ধর্ষণ-সংস্কৃতি রোধ করা যায় না। কারণ ধর্ষণ শুধুই কোনো রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থার ফল নয়, এটি সমাজের দীর্ঘদিনের মানসিক কাঠামোর ফল- যেখানে নারীকে প্রতিনিয়ত ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখা হয়, আর পুরুষতান্ত্রিক দম্ভের প্রকাশ ঘটে নারীর শরীরের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।


আমরা ধর্ষণকে অনেক সময় ‘হঠাৎ ঘটেছে’, ‘উত্তেজনায় ঘটেছে’ এমনভাবে বোঝাতে চাই; কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, বাস্তবতা অন্যরকম। ধর্ষণ হয় ঠান্ডা মাথায়, সুচিন্তিতভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই ধর্ষণের আগে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, শিকারকে ফাঁদে ফেলা হয়, তার অসহায়তা নিশ্চিত করা হয়- তারপর সেই সময়কে ব্যবহার করে তার ওপর নিপীড়ন চালানো হয়। এই সময়, এই পরিকল্পনার পেছনে থাকে একটা আত্মবিশ্বাস- ‘আমাকে কেউ ধরবে না’, ‘আমার পরিচয় আছে’, ‘ক্ষমতা আছে’, ‘তুই কিছুই করতে পারবি না’।

এ আত্মবিশ্বাস রাষ্ট্র বা সরকার দেয় না, দেয় সমাজ। আমরা যেভাবে নারীকে দেখি, তাকে বিচার করি, সে অনুযায়ী কেউ ধর্ষণ করে আবার কেউ ধর্ষককে আড়াল করে।
ধর্ষণ-সংস্কৃতি শুধুমাত্র অপরাধীর ব্যক্তিগত বিকৃতি নয়। এটি একটি সামাজিক রীতি যা গড়ে উঠেছে প্রতিনিয়ত নারীবিদ্বেষী কথাবার্তা, হাস্যরস, গালি, কন্টেন্ট, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, গান এমনকি সাধারণ কথোপকথনের মধ্য দিয়ে।

যখন কোনো জনপ্রিয় নেতা বলেন- ‘দে, লাল করে দে’- তখন আমরা সামাজিক মাধ্যমে তালি দিই, লাইক-কমেন্টে মেতে উঠি। একই কথা যখন পাড়ার মোড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, স্কুলের আঙিনায় বলা হয়- তখন সেটা আর কানে লাগে না, বরং ‘মজা’ লাগে।

সেই গালিগুলো, যেগুলোর মূলেই থাকে নারী-অবমাননা, মা-বোনের যৌনাঙ্গকে ‘অস্ত্র’ করে তুলে ধরা, তা আমরা এমনভাবে রপ্ত করি, যেন তা না বললে আমরা আধুনিক নই, স্মার্ট নই। ফলে গালিগালাজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নারী-বিদ্বেষও হয়ে ওঠে ‘কুলনেস’।

আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়াই হয়ে উঠেছে নতুন সমাজ। সেখানে পুরুষতান্ত্রিক পুঁজিবাদ তার সবচেয়ে কৌশলী রূপে কাজ করছে। মেয়েরা সেখানে নিজেরাই নিজের শরীরকে ‘ব্র্যান্ড’ করছে, ‘ভিউ’, ‘কমেন্ট’, ‘সাবস্ক্রাইবার’ বা ‘মোনেটাইজেশন’-এর আশায়। তবে দোষ এককভাবে তাদের নয়। কারণ এই বাজার সেই শর্তেই তৈরি হয়েছে- যেখানে শরীর পুঁজি না করলে সাফল্য আসে না।

নারীরা ক্যাপশনে নিজের শরীর নিয়েই লিখছে- তাতে রসিকতা, যৌন উত্তেজক বার্তা, কিংবা স্পষ্ট আহ্বান। ফলত, নিচের মন্তব্যে চলে আসে ভিউয়ারদের মন্তব্য- ‘এমন বডি, ওয়াও!’, ‘তোর সাথে এক রাত চাই’, ‘ধরে ফেলব তো…’। সেই কমেন্টে মেয়েটি হয়তো ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দেয়, কারণ এটাই তার মার্কেটিং কৌশল। এই মন্তব্যের পেছনে যদিও থাকে প্রতিনিয়ত যৌন সহিংসতার বীজ।

এভাবে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টেই নারী হয়ে ওঠে পণ্য। এখানে সে নিজের নাম নয়, তার শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে চিহ্নিত হয়। এখানেই ধর্ষণ-সংস্কৃতির নতুন শাখা গজায়- যেখানে বাস্তবে ধর্ষণ না হলেও, কল্পনার ধর্ষণ হয় প্রতিটি স্ক্রলেই।

আমরা অনেক সময় পর্নোগ্রাফিকে ‘পছন্দের বিষয়’ বা ‘বয়সন্ধিকালের কৌতূহল’ হিসেবে ব্যাখ্যা করি; কিন্তু বাস্তবতা আরও ভয়াবহ। ভারতে ধর্ষণের ফুটেজ বিক্রি হয় ‘পর্নো’ নামে। কোভিডকালে শিশুদের যৌন নির্যাতনের ভিডিও চাহিদার তুঙ্গে ছিল। পর্নো হয়ে উঠেছে এমন এক বাজার, যেখানে যৌনতাই শুধু পণ্য নয়, সহিংসতা-ও বিকোয়।


এই সহিংসতাগুলোর জায়গা আছে ভিডিও গেমেও, রিলস-এও। ‘গার্লফ্রেন্ড অমান্য করলে কী করবে’- এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকে বানাচ্ছে রিল: ‘গালে থাপ্পড়, চুল ধরে টান, বুকে ঘুষি...’। এসব কন্টেন্ট হাজার হাজার মানুষ দেখে, শেয়ার করে, অনুকরণ করে।

এই পরিস্থিতিতে ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে যদি আমরা শুধু নির্দিষ্ট সরকার বা রাজনৈতিক আমলের ব্যর্থতা বলে দেখাই, তাহলে আমরা মূল কারণকে এড়িয়ে যাচ্ছি। কারণ রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সমাজের মনোভাব থেকে। আইন তৈরি হয় সেই সমাজের নৈতিক বোধকে ভিত্তি করে। আর যদি সেই সমাজই নারীকে দেখায় কেবল শরীর হিসেবে- তাহলে রাষ্ট্র কীভাবে নারীর সম্মান রক্ষা করবে?


ক্ষমতার প্রয়োগের অন্যতম পদ্ধতি ধর্ষণ- এটি বোঝার সময় এসেছে। ধর্ষণ শুধু যৌন লালসা নয়, এটি প্রতিশোধ, অপমান ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এক উপায়। কারও স্ত্রীকে ধর্ষণ করা মানে তার ‘সম্মান’ হরণ। এখানে নারী আবারও ভোগ্যবস্তু- একটা ট্রফি, যার ওপর দখল স্থাপন মানেই জয়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় আজ সেই কন্টেন্ট বেশি ভাইরাল হয়, যেখানে নারীর শরীর স্পষ্টভাবে দেখানো হয়, অথচ সেই নারী প্রায়শ বিবাহিত। ‘অন্যের সম্পত্তি’কে ভোগ করার মধ্যে যে ‘আনন্দ’, সেটা কেবল যৌনতায় থামে না। এখানে আছে অপমানের সুখ, ‘পরের স্ত্রীর প্রতি দখলদারি’- এটিও এক ধরনের ক্ষমতা চর্চা।

ধর্ষণ তাই একমাত্র শারীরিক ঘটনা নয়, এটি একটি প্রতীকী আগ্রাসন- যেখানে নারীকে তার অসম্মতিতে আঘাত করে দমিয়ে রাখা হয়। সেই চিন্তাধারাই সমাজে গেঁথে আছে যুগের পর যুগ ধরে।

রাষ্ট্র চাইলে ধর্ষণের ঘটনা কমাতে পারে- শাস্তি জোরদার করে, পুলিশকে সৎ করে, বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করে; কিন্তু ধর্ষণ-সংস্কৃতি নির্মূল করতে হলে মারাত্মকভাবে পরিবর্তন করতে হবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। যতদিন নারীকে দেখা হবে যৌনবস্তু হিসেবে, ততদিন ধর্ষণ হবে ‘স্বাভাবিক’।

এই কাজ শুরু করতে হবে নারীকেই- নিজেকে আত্মসম্মান ও সংবেদনশীলতার আলোয় চিনে নেয়ার মধ্য দিয়ে। হ্যাঁ, জীবনযুদ্ধে অনেক সময় শরীর ‘সম্পদ’ মনে হতে পারে; কিন্তু বারবার মনে রাখতে হবে- এই কাঁটাতেই কাঁটা বিঁধে। প্রতিদিনের অসহ্য ব্যথা যেন এতটাই স্থায়ী না হয়, যাতে আমরা ব্যথাটাকেই স্বাভাবিক ভেবে নিই।

আজ দরকার এক সংস্কৃতিক লড়াই, যেখানে নারী তার শরীর নয়, তার চিন্তা, কণ্ঠস্বর, স্বপ্ন আর অধিকার দিয়ে সমাজে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করবে। যেখানে মেয়ের শরীর ‘কন্টেন্ট’ হবে না, ‘প্রতিযোগিতা’ হবে না, হবে স্বাভাবিক শরীর- একটি মানুষী অস্তিত্বের অঙ্গ।

সেদিনই ধর্ষণ হয়ে উঠবে ‘অস্বাভাবিক’। সেদিনই সমাজ শিখবে, নারীর সম্মতি ছাড়া স্পর্শ তো দূরের কথা- চোখেও তাকে ভোগ করা যায় না।

লেখক: কলামিস্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ