Views Bangladesh Logo

রকিব হাসান: আমাদের কাছে যার মৃত্যু নেই

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

‘হ্যালো, কিশোর বন্ধুরা-
আমি কিশোর পাশা বলছি, আমেরিকার রকি বীচ থেকে।
জায়গাটা লস অ্যাঞ্জেলেসে, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে,
হলিউড থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে।
যারা এখনো আমাদের পরিচয় জানো না, তাদের বলছি,
আমরা তিন বন্ধু একটা গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছি, নাম
তিন গোয়েন্দা।’

ছোটবেলায় যখন ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের কোনো বই পড়তাম প্রতিবার বইয়ের শুরুতে লেখা এই পরিচিতিটা পড়তাম। পড়তে পড়তে মুখস্তই হয়ে গিয়েছিল। তাও সব সময় পড়তাম। পড়লেই শরীরে-মনে অন্যরকম এক শিহরণ হতো। নিজেকে ভাবতাম কিশোর পাশা। মুসা আমান আর রবিন মিলফোর্ডকেও ভালোবাসতাম; কিন্তু তিন গোয়েন্দাদের লিডার কিশোর পাশাই ছিল সবচেয়ে প্রিয়। গভীর চিন্তা করার সময় কিশোর পাশা নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতো, নিজের অজান্তেই এই অভ্যাসটা আমারও মুদ্রাদোষের মতো হয়ে গিয়েছিল।

সে এমন এক সময়, নব্বই দশকের মাঝামাঝি, মোবাইল ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না, ফেসবুক-ইউটিউব ছিল কল্পনার বাইরে। টেলিভিশন ছিল একটা- বিটিভি। সুতরাং আমাদের অবসর কাটানোর একটাই উপায় খেলাধুলা আর বই পড়া। খেলাধুলা তো আর সবসময় করা যায় না; কিন্তু বই তো সবসময়ই পড়া যায়। বিশেষ করে বৃষ্টির দিন যখন বাইরে যাওয়া বারণ তখন বই-ই ছিল একমাত্র সম্বল। হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার তখনো আমাদের হাতে আসেনি। আর ছোটদের জন্য বড়দের বই পড়া অনেকটা নিষিদ্ধই ছিল। পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আমাদের কিশোরদের হাতে হাতে তখন সেবা প্রকাশনীর বই। সেভেন-এইটে পড়ার সময় মাসুদ রানা সিরিজের বই তখনো পড়তে শুরু করিনি। নেশার মতো বুঁদ হয়ে পড়তাম তিন গোয়েন্দা। আর প্রতিটি বইয়ের কাভারে লেখা একজন লেখকের নাম রকিব হাসান!

কে এই রকিব হাসান! তখন তো আর গুগল নেই যে সার্চ করে ছবি দেখে নেব। পেপার-পত্রিকায়ও কখনো রকিব হাসানের ছবি দেখিনি। রকিব হাসানের ছবি দেখেছি অনেক বড় হয়ে, যখন প্রায় তিন গোয়েন্দা পড়া ছেড়ে দিয়েছি। তাও খুব শিহরিত হয়েছিলাম ছোটবেলার এই নায়ককে দেখে। আমরা সত্যিই ভাবতাম রকিব হাসান বাংলাদেশের মানুষ নন, বা এই গ্রহেরই মানুষ নন। কোনো ভিনগ্রহ থেকে যেন তিনি আমাদের সামনে হাজির করেন তিন গোয়েন্দার অদ্ভুত সব রহস্যময় গল্প।

রুপালি মাকড়সা, মমি, রত্নদানো, রক্তচক্ষু, সাগর সৈকত, জলদস্যু দ্বীপ-১, ২, হারানো তিমি, মৃত্যু রহস্য, কাকাতুয়া রহস্য- কী নাম একেকটা বইয়ের! নাম শুনলেই গা ছমছম করত! কোনো একটা বইয়ের গল্প যেন শেষ হয়েছিল কিশোরকে একদল গুন্ডা আটকে রেখেছে একটা কফিনের ভেতর, সেখানেই প্রথম খণ্ড শেষ। কেমনটা আগে। এখন দ্বিতীয় খণ্ড কবে হাতে পাব এই উত্তেজনায় বাকি দিনগুলো যেতে লাগল। কীভাবে মুক্তি পাবে কিশোর পাশা কফিনের ভেতর থেকে! এই অনুভূতি এখনকার ছেলেমেয়েদের কোনোভাবেই বোঝানো যাবে না যে তিন গোয়েন্দা আমাদের কাছে কী ছিল! পুরো দুনিয়া, পুরো জগৎই ছিল আমাদের তিন গোয়েন্দার রহস্যের ভেতর লুকানো!

তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টার একটি মোবাইল ভ্যানের ভেতর। কিশোর পাশার চাচা রাশেদ পাশা দীর্ঘদিন আগে কিনে এনেছিলেন। পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডে লোহালক্কড়ের স্তূপের নিচে পড়ে ছিল এই মোবাইল ভ্যান। রাশেদ পাশা পুরোনো লোহালক্কড় আর আসবাবপত্র কেনাবেচার ব্যবসা করেন। তার দুই ড্রাইভার, বোরিস আর রোভার, বিপুল শক্তির অধিকারী দুই ভাই, কোনো বিপদে-আপদে দুই ভাই তিন গোয়েন্দাকে সাহায্য করে। কী যে ভালোবাসতাম আমরা এই দুই ভাইকে! আর ভালোবাসতাম তিন গোয়েন্দার বন্ধু জিনাকে। কোনো গোপন বিষয়ের খোঁজ পেতে হলেই তিন গোয়েন্দা কাজে লাগিয়ে দিত জিনাকে। গোপন বিষয় অন্বেষণের তিন গোয়েন্দার একটা মজার নেটওয়ার্ক ছিল: ভূত থেকে ভূতে। অর্থাৎ এক বন্ধু আর কজন বন্ধুকে ফোন করে খবর নিত তাদের এলাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না খবর নেয়ার জন্য। এভাবে তারা পেয়ে যেত দূর-দূরান্তের গোপন খবর।

শুধু জিনাকে কেন, আমরা তো ভালোবাসতাম টেরিয়ার ডয়েলকেও, তিন গোয়েন্দার কাছে যে শুঁটকি টেরি নামে পরিচিত। মুসা তো তাকে দুই চোখে দেখতে পারত না। সে শুধু ঝামেলা লাগাতে ওস্তাদ; কিন্তু যে বইয়ে শুঁটকি টেরি থাকতো সে বইটা আমাদের কাছে অন্যরকম ভালো লাগত। জটিল কোনো ঝামেলায় পড়লে তিন গোয়েন্দাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন ভিক্টর সাইমন। তিনি একজন পেশাদার গোয়েন্দা। আর রকি বীচ পুলিশ চিফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার সবসময়ই তিন গোয়েন্দার নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। বারবার সাবধান করে দিতেন বিপজ্জনক কোনো প্রোজেক্ট হাতে নেয়ার জন্য; কিন্তু অদম্য সাহসী তিন গোয়েন্দা অনেক সময় তাকে না জানিয়েই ভয়ংকর সব রহস্য উন্মোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ত। পড়ে অবশ্য পুলিশ চিফের কাছে তারা আদুরে বকাও খেত। আর প্রতিটি জটিল রহস্য উন্মোচনের পরেই হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার খুঁটিখুঁটিয়ে তাদের কাছে সব রহস্যবৃত্তান্ত শুনতেন, কারণ তিনি এসব নিয়ে ছবি বানাতেন। ডেভিস ক্রিস্টোফার চরিত্রটি আসলে নির্মাণ করা হয়েছে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আলফ্রেড হিচককের ছায়া অবলম্বনে।

তিন গোয়েন্দা সিরিজের প্রথম কিছু গল্প লেখা হয়েছিল বিদেশি কিছু রহস্য গল্পের ছায়া অবলম্বনে, পরে রকিব হাসান নিজেই মৌলিক গল্প লিখেছিলেন। রকিব হাসান সম্ভবত শখানেকের ওপর তিন গোয়েন্দা লিখেন। পরে শামসুদ্দীন নওয়াবও কিছু লিখেন। মোট বোধহয় আড়াই-তিনশ বই বেরোয়। এর মধ্যে কিছু ছিল বেশ বড় উপন্যাস বাকিগুলো বড় গল্প। পেপারব্যাক বইগুলোর দাম একসময় ছিল ১৮-২০ টাকা, পরে ২৫-৩০ টাকা হয়। পরে বইগুলো ভলিউম আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। একেকটা ভলিউমে তিনটি করে গল্প। ভলিউমের মূল্য প্রথম দিকে ছিল ৩০-৪০ টাকা, পরে দাম বাড়তে বাড়তে ৫০ থেকে ৮০ টাকা হয়। টিফিনের টাকা বাঁচিয়েই বইগুলো কেনা যেত। আর হাতের কাছের লাইব্রেরি, বাস-ট্রেন স্টেশনের লাইব্রেরি এমনকি পত্রিকার দোকানেও পাওয়া যেত সেবা প্রকাশনীর বই। হাত ও সাধ্যের নাগালে থাকার কারণে সেবা প্রকাশনীর বই ছিল খুবই জনপ্রিয়।

তার মধ্যে তিন গোয়েন্দাই ছিল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিন গোয়েন্দা আর রহস্য পত্রিকা চকোলেট কেন, আইসক্রিমের চেয়েও প্রিয় ছিল। তিন গোয়েন্দার পাঠকরাই পরে মাসুদ রানার পাঠক হয়। এখানে একটা কথা বলি, অনেকে বড় হয়ে গল্প-উপন্যাস পড়তে শুরু করে। নব্বই দশকে যারা বড় হয়েছে কিন্তু তিন গোয়েন্দা পড়েনি; কিন্তু পরে হয়তো অনেক বই পড়েছে তাদের সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে আমরা তেমন মজা পেতাম না। কারণ, বড় হয়ে বই পড়তে শুরু করলে শুধু পাণ্ডিত্যটা হয়; কিন্তু পাঠ নিয়ে ওই যে ছেলেবেলার আনন্দ, স্মৃতিকাতরতা সেটা হয় না। কোথায় যেন সুরটা মিলে না।

এখনকার স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিন গোয়েন্দা হয়তো আর তত জনপ্রিয় নয়। আমার ভাগ্নী পুষ্প পড়ে ক্লাস এইটে। ও খুব ভালো স্টুডেন্ট, গল্পের বইও পড়ে কিছু কিছু; কিন্তু খুব বেছে বেছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, তিন গোয়েন্দার কয়টা বই পড়েছিস? ও বলল, একটা। আমি বললাম, কোনটা? ও বলল, কাকাতুয়া রহস্য। আমি বললাম, কেমন লাগল? ও বলল, ভালোই, একটু ভয়ের। আমি অবশ্য তেমন ভয় পাইনি। আর আমি কাকাতুয়া রহস্য পড়েছিলাম শীতের রাতে লেপের নিচে লুকিয়ে! এই অনুভূতি এখনকার প্রজন্মকে আসলেই বোঝানো যাবে না। বাস্তব দুনিয়ার চেয়ে আমাদের কাছে কল্পনার জগৎই ছিল অনেক বিশাল ও বিস্ময়ের!

আমার ছেলেবেলার কল্পনাকে বিস্তৃত করে দিয়েছিল তিন গোয়েন্দা! আমরা কখনো ভাবিনি এসব গল্প মিথ্যা, বানোয়াট, ভাবতাম সত্যিই বোধহয় আমেরিকায় তিন গোয়েন্দা বাস করে। আমরা রহস্য পত্রিকার ঠিকানায় তখন চিঠিও লিখতাম। সেইসব চিঠি পড়াও ছিল তখন এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। আজ তিন গোয়েন্দার স্রষ্টা রকিব হাসান চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। দীর্ঘদিন কিডনি রোগে ভুগছিলেন। রকিব হাসানের ছেলে রাহিদ হাসান সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ডায়ালাইসিসের জন্য আজ দুপুরে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন। ডায়ালাইসিসের পরপরই তিনি মারা যান। রকিব হাসানের বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর; কিন্তু আমাদের কাছে তো তিনি চিরনবীনই থাকবেন। আমাদের কাছে তার মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের ছেলেবেলার নায়ক।

রকিব হাসান যেমন আমাদের মনে আমৃত্যু বেঁচে থাকবেন, বেঁচে থাকবে তার তিন গোয়েন্দা- কিশোর পাশা, রকিব হাসান, আর মুসা আমানও। তারাও তো কোনোদিন বড় হবে না। যতবার তিন গোয়েন্দা সিরিজের কোনো বই হাতে নেব আমরাও আর বড় হব না। আবার যদি কোনো অলস দুপুরে, কোনো নির্জন রাতে, যখন আর কোনো কাজে-পড়ায় মন বসবে না, হয়তো মনের খেয়ালে তিন গোয়েন্দা সিরিজের কোনো বই হাতে নেব, জীবনের সব গ্লানি ভুলে আমরা ফিরে যাব আমাদের সেই রহস্যময় ছেলেবেলায়- আমেরিকার রকি বীচে, তিন গোয়েন্দার সঙ্গে কোনো জটিল রহস্য উন্মোচনে। রকিব হাসানও কি তখন থাকবেন না আমাদের সঙ্গে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ