রোহিঙ্গা সংকট: প্রত্যাবাসনের গোলকধাঁধা
বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় হুমকির নাম রোহিঙ্গা সংকট যেখানে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে করিডোর বিতর্ক এবং ভারতে নিবন্ধিত কিছু রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পুশ-ইন বা ঠেলে দেয়ার মতো ঘটনা। তার সঙ্গে গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তেনিও গুতেরেস এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজভূমি রাখাইনে প্রত্যাবাসনের যে আশার বাণী শুনিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এক লাখ ৮০ হাজার মানুষকে মিয়ানমারে ফেরত নেয়া হতে পারে এমন খবর প্রকাশিত হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এগুলো দূরাশায় পরিণত হয়। উপরন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ৯ মাসে অন্তত এক লাখ রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে এসেছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কাঁধে রোহিঙ্গাদের বোঝা যেমন ক্রমশই বাড়ছে তেমনি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুটি ঘুরপাক খাচ্ছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির গোলকধাঁধায় যেখান থেকে বাংলাদেশের আশু মুক্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
রোহিঙ্গা সংকটের ইতিহাস
ইতিহাস বলছে, ১৯৪২ সালে গণহত্যার সময় পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা তৎকালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। তারা কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নেয়। এরপর ১৯৫৮ সালে সরকারি মদদে মগ সেনা ও স্থানীয় মগ জনগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও বর্মী সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের বৈঠকের পর বর্মী সরকার পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে নেয়।
বার্মা সরকার ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪টি বড় রকমের অপারেশন চালায় আরাকান অর্থাৎ রাখাইন অঞ্চলে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিটিএফ অপারেশন (১৯৪৮), কম্বাইন্ড ইমিগ্রেশন অ্যান্ড আর্মি অপারেশন (১৯৫৫), শিউ কাই অপারেশন (১৯৬৬), নাগাজিন কা অপারেশন (১৯৬৭-৬৮), মাইয়াট মন অপারেশন (১৯৬৯-৭১), সেব অপারেশন (১৯৭৪), ড্রাগন অপারেশন (১৯৭৮)।
২০০৪ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টির এক রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘ড্রাগং কিং’ অপারেশনের কারণে ১৯৭৮ সালে দুই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি দেয়; কিন্তু বাস্তবতা হলো এরপরও রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। ফলে আবার রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে চলে আসে। এর মধ্যে ১৯৯১-৯২ সালে নতুন করে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালেও নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার্মাকে চরমপত্র দেন এবং এসব উদ্বাস্তুকে তখন ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় সে দেশের সরকার। ২০১২ সালেও সেখানে রাখাইনে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়। এখনো সেখানে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে, যারা এতদিন মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধন শিকার হলেও এখন তাদের জন্য নতুন আতঙ্কের নাম ‘আরাকান আর্মি’। রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ২০০৯ সাল থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসা আরাকান আর্মি এরই মধ্যে রাখাইনের বিরাট অংশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। এমনকি বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তও তাদের নিয়ন্ত্রণে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের স্টেট পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল (এসপিসিডি) রোহিঙ্গা নামের আলাদা জাতিসত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের ১৩৫টি জাতিসত্তার (ন্যাশনাল রেস) অংশ বলে মানে না। শত শত বছর ধরে পরিচিত মিয়ানমারের ‘আরাকান’ অঞ্চলের নাম বিলুপ্ত করে সেখানে ‘রাখাইন স্টেট’ নামকরণের মধ্যে রোহিঙ্গা জাতিসত্তাকে বিলুপ্ত করে রাখাইন জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা স্পষ্ট।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জায়গাজমি বাজেয়াপ্ত করে এবং তাদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উৎখাত করে। এজন্য কোনো ক্ষতিপূরণও রোহিঙ্গারা পায় না। বরং রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করে সেসব জায়গায় অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে পুনর্বাসিত করা হয়।
বাংলাদেশ কেন নিরীহ শিকার?
রাখাইনের নিকটততম প্রতিবেশী বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান। রাখাইন থেকে সাধারণত তিনটি পথে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রধানত নাফ নদী পার হয়ে তারা আসে। তবে এর বাইরে মিয়ানমারের উপকূলবর্তী এলাকা থেকে সবচেয়ে কাছের পয়েন্ট টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপেও তারা নৌকায় চলে আসে। এছাড়া পাহাড়ি পথ ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম, বাইশফাঁড়ি ও রুমা এলাকা দিয়ে অনেক সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
বছরের পর বছর ধরে তারা যে বাংলাদেশে ঢুকে যেতে পেরেছে তার প্রধান কারণ বাংলাদেশের মানবিক আচরণ। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি বা সরকারের অন্য কোনো বাহিনী রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে গিয়ে পুশ-ইন করে না বা ঠেলে দেয় না। যদি বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতিহত করতে চাইতো তাহলে এটি হতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পুশ-ইনের ঘটনা; কিন্তু বাংলাদেশ সেই পথে পা বাড়ায়নি। এখানে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষের শরণার্থী হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার অভিজ্ঞতাটি বাংলাদেশের মানুষ মনে রেখেছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গাদের প্রতি সেই মানবিক আচরণ দেখাতে গিয়ে বাংলাদেশে নিজেই এখন একটি প্রতিবেশী দেশের (মিয়ানমার) অভ্যন্তরীণ সংকটের ‘ইনোসেন্ট ভিকটিম’ বা ‘নিরীহ শিকার’।
রোহিঙ্গা সংকট শুধু একটি মানবিক ইস্যু নয়, বরং এটি বাংলাদেশে নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও পরিবেশের ওপর বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সামাজিক কাঠামো, আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান ও পরিবেশ চরম চাপের মুখে পড়েছে। একদিকে আন্তর্জাতিক অনুদান কমছে অন্যদিকে জনঅসন্তোষ বাড়ছে। এর ফলে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ, অস্ত্র ও মাদকের চোরাচালান এবং গ্যাং কালচারের বিস্তার সবই উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ঠেলে দিল ভারত!
শুধু রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধন এবং আরাকান আর্মির নির্যাতনই নয়, বরং সম্প্রতি ভারত সে দেশ থেকে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা-ইউএনএইচসিআরের নিবন্ধিত পাঁচ রোহিঙ্গা নাগরিককে বাংলাদেশে পুশ-ইন করেছে। বিজিবি তাদের আটক করার পর জানতে পারে যে, তারা একই পরিবারের সদস্য এবং আসামের মাটিয়া রিফিউজি ক্যাম্পে বসবাস করছিলেন। গত ৭ মে ভোর ছয়টার দিকে কুড়িগ্রাম জেলার চরভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ভাওয়ালকুড়ি সীমান্তবর্তী নতুনহাট বাজার এলাকায় ২২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের টহল দল তাদের আটক করে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ এবং রাখাইনে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার বাইরেও পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই জনগোষ্ঠীর আরও অনেক লোক বসবাস করে। কোথাও ক্যাম্পে শরণার্থী হিসেবে। কোথাও অভিবাসী হিসেবে। যেমন সৌদি আরবে ৪ লাখের বেশি, পাকিস্তানে ২ লাখের বেশি, মালয়েশিয়ায় দেড় লাখের বেশি, থাইল্যান্ডে প্রায় ১ লাখ, ভারতে প্রায় ৪০ হাজার, যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ এ মুহূর্তে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে যারা বাংলাদেশের নাগরিক নন। এমনকি মিয়ানমার সরকারও যাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। তার মানে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয়দানকারী দেশ; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই বোঝা বা এই মানবিকতার দায় বাংলাদেশ কত বছর বইবে?
প্রত্যাবাসনের গোলকধাঁধা
২০১৭ সালে যখন জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলো, সেই বছর থেকেই শোনা যাচ্ছে, মিয়ানমার সরকার ধাপে ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে; কিন্তু যে প্রশ্নটি একজন সাধারণ মানুষের মনেও ছিল বা এখনো আছে সেটি হলো, যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিকই মনে করে না এবং যাদের হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার মতো বীভৎস নাকরীয়তার মধ্য দিয়ে বাস্তচ্যুত করেছে তারা কেন সেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে? এটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?
তারা ফেরত নিতে পারে যদি তাদের বাধ্য করা যায়; কিন্তু কে তাদের বাধ্য করবে? জাতিসংঘ বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু মিয়ানমারের জান্তা সরকার জাতিসংঘ বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন কিংবা কোনো পরাশক্তিকেও পাত্তা দেয় বলে মনে হয় না। কেননা তারাও চীন ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তির বলয়ে রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ কিংবা জাতিসংঘ চাইলেই তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাবে বিষয়টা এত সহজ নয়।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করেছিল মিয়ানমার। চুক্তি সইয়ের দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর কথা ছিল। বাংলাদেশ ২০১৮-২০ সালে ছয় ধাপে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের তালিকাও দিয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে ১ হাজার ১০০ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর জন্য একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। সেটিও সফল হয়নি। প্রতি বছর বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং চীন বা আসিয়ানভুক্ত দেশের মধ্যস্থতার আশ্বাস মিললেও কোনো রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। সেই থেকে আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। কবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে- তা অনিশ্চিত। এমতাবস্থায় গত ১৪ মার্চ কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকালে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঈদ উদ্যাপন করতে পারেন, সে লক্ষ্যে তারা কাজ করবেন।
পরদিন ১৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে গুতেরেস বলেন, মিয়ানমারে লড়াই বন্ধ করা ও সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের সমস্ত প্রতিবেশী দেশের চাপ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। এর প্রথম ধাপ হবে সহিংসতা বন্ধ করা এবং একই সঙ্গে এমন কার্যকর ব্যবস্থা গঠন করা যা মিয়ানমারে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম করবে যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করবে। এ সময় তিনি রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন ও তাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপ জরুরি বলেও উল্লেখ করেন।
বস্তুত এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে স্বীকৃতি দিয়ে যান এর পাঁচ দিনের মাথায় ২০ মার্চ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের একটি প্রতিনিধি দলও রাখাইন রাজ্যের বিশাল অংশ নিয়ন্ত্রণকারী আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের কার্যকর যোগাযোগের পরামর্শ দেয়। এর এক মাসের মাথায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে আরাকান আর্মির সদস্যদের জলকেলি উৎসব করার একটি খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। ফলে এই ঘটনাটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি তৈরি করলো কি না সেই প্রশ্ন ওঠে।
সমাধান কী?
১. মিয়ানমার সরকার এবং আরও একাধিক পক্ষ যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় না, তার বড় প্রমাণ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে উখিয়ার কুতুপালংয়ে শরণার্থী শিবিরে গুলি করে হত্যা করা। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে শরণার্থীদের সংগঠিত করছিলেন। তাদের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য তিনি দেশে-বিদেশে কাজ করেছেন। বিদেশি রাষ্ট্র প্রধান ও নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমারের গণহত্যাবিরোধী মহাসমাবেশে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটান তিনি। ওই দিনটিকে তিনি ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেন। তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও তিনি কথা বলার সুযোগ পান; কিন্তু সেই মুহিবুল্লাহকেই পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। অনেকে মনে করেন, মিয়ানমার চায় না প্রত্যাবাসন আন্দোলন জোরদার হোক। ফলে তাদের গুপ্তচররাই হয়তো রোহিঙ্গাদের গ্রুপিং ও কোন্দল উসকে দিয়ে মুহিবুল্লাহর হত্যা করিয়েছে।
২. প্রত্যাবাসনের এই গোলকধাঁধা থেকে উত্তরণে কেবল কূটনৈতিক তৎপরতা নয়, প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য এবং আন্তর্জাতিক মহলের সমন্বিত চাপ। বাংলাদেশকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক ফোরামে আরও সক্রিয় হতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে না দেখে একটি জাতীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইস্যু হিসেবে মূল্যায়ন জরুরি। বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার কারণে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যদি বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয় তাহলে সেটি যেমন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চয়তায় ফেলবে, তেমনি রাখাইন রাজ্য যেহেতু এখন কার্যত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে, অতএব এই গোষ্ঠী না চাইলে রাখাইনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। যদি আরাকান আর্মি এখানে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তখন তাদের খাদ্য ও অন্যান্য সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীলতাকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব বলে অনেকে মনে করেন। হয়তো সে কারণেও আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ স্থাপন এবং করিডোরের আলোচনাটি সামনে আনা হয়েছে; কিন্তু এই করিডোর বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তার হুমকি তৈরি করবে কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন। যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা করছে। বিশেষ করে বিএনপি।
৩. রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলে সেখানে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো যায় কি না, এমন আলোচনাও আছে; কিন্তু জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান মানে সেখানে হয়তো শান্তিরক্ষা বাহিনীকে পাঠাতে হবে। রাখাইনে চীনের বিরাট বিনিয়োগ আছে। সুতরাং যেখানে চীনের বড় বিনিয়োগ তথা স্বার্থ আছে এবং পুরো অঞ্চলের নৌ ও সমুদ্রপথের ওপর চীন তার প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখতে চায়, সেখানে তারা শান্তিরক্ষা মিশনের উপস্থিতি মানবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে। তাহলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কোথায় হবে?
৪. বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো ভাগ ভাগ করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যেতে পারে এরকম একটি ধারণা আছে। যুক্তরাষ্ট্র ধাপে ধাপে কিছু রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যখন প্রথম ধাপে ২৪ জনের একটি দল সেখানে গেল তখন এই প্রশ্ন উঠেছিল যে, ১২ লাখ শরণার্থীর মধ্যে মাত্র ২৪ জনকে আশ্রয় দেয়া পুরো সংকট সমাধানে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলবে কি না? তখন বলা হয়েছিল, এর একটি প্রতীকী মূল্য রয়েছে। অর্থাৎ এই ধারাবাহিকতায় আয়তনে বড় এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী পাশ্চাত্যের দেশগুলো এমনকি সচ্ছল মুসলিম দেশগুলোও যদি রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে আশ্রয় দেয় তাহলে এই রাষ্ট্রহীন জাতির মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে।
৫. রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হিসেবে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন একটি সম্ভাব্য বিকল্প হলেও এটি সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান নয়। কেননা ১২-১৩ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেয়া যে কোনো দেশের জন্যই কঠিন। তাছাড়া প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা রয়েছে। যারা শরণার্থী হিসেবে মানুষকে আশ্রয় দেয় তাদের কিছু নীতিমালাও রয়েছে। শরণার্থী হিসেবে আশ্রিতদের নানাবিধ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হয়। তাদের যদি ওই দেশের মূল স্রোতধারায় মিশিয়ে দিয়ে কাজের সঙ্গে যুক্ত করা যায়, সেটি একটি ভালো সমাধান হতে পারে; কিন্তু এখানে সংকট হলো বিশ্বাস ও সংস্কৃতির।
৬. রোহিঙ্গাদের যে বিশ্বাস, সংস্কৃতি, রীতি ও অভ্যাস তার সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার সমাজের অনেক পার্থক্য। ফলে তাদের শুধুমাত্র শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় দিয়ে ক্যাম্পে রাখা হবে নাকি মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একত্র করা হবে, সেটি বিরাট প্রশ্ন। সম্ভবত এ কারণে আয়তনে বৃহৎ এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অনেক দেশও বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসনের বিষয়ে খুব আন্তরিক নয়। অর্থাৎ কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ার আগে তারা নিজ দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক সংহতির বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়।
৭. মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক স্বার্থের বৈচিত্র্য রয়েছে। এ কারণে কিছু দেশ শরণার্থী পুনর্বাসনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায় না, কারণ এতে তাদের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদিও সরাসরি পুনর্বাসনের কোনো বড় উদ্যোগ না নিলেও সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, এবং অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলো রোহিঙ্গাদের সহায়তায় অর্থ সহায়তা দিয়েছে। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তুলনায় সেটি খুব নগণ্য।
৮. রোহিঙ্গা সংকটের কার্যকর সমাধান হলো যে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করা হয়েছে; যেটি তাদের জন্মভূমি সেখানেই ফেরত পাঠানো এবং সেটি হতে হবে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে। এই ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে। তাদের বাধ্য করতে হবে। সেইসঙ্গে আরাকান আর্মি যদি রাখাইনে তাদের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়, তখন তাদের ওপরও চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গাদের নিজভূমিতে ফেরত পাঠাতে হবে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই অন্য দেশের লাখ লাখ মানুষকে অনন্তকাল আশ্রয় দেবে না। দিতে পারবে না।
৯. অনেকে মনে করেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র বা স্বায়ত্তশাসন একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে; কিন্তু সেটিও এখন বেশ কঠিন। কেননা রাখাইনে রোহিঙ্গারা নয়, বরং এখন আরাকান আর্মিই সেটির নিয়ন্ত্রণে। যে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বৈরী।
১০. বাংলাদেশ যে অস্ত্রের মুখে রোহিঙ্গাদের নাফ নদী পার করে মিয়ানমারে পুশ-ইন করবে বা ঠেলে দেবে সেটিও মানবিক নয়। বরং এই ধরনের কাজ করতে গেলে বাংলাদেশ সারা বিশ্বেই সমালোচনার মুখে পড়বে এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ সারা বিশ্বে যে মানবিকতার পরিচয় দিয়েছিল সেটি দারুণভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে।
১১. রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের উদ্যোগে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হওয়ার কথা। সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ইস্যুটি নতুন কোনো সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে আপাতত এই ‘আশায় বাঁধি খেলাঘর’।
পরিশেষে, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি জাতিগত সংখ্যালঘু এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা। সুতরাং এই সমস্যার দায় যেমন বাংলাদেশের নয়, তেমনি এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্বও বাংলাদেশের নয়। বাংলাদেশ মানবিক কারণে সেখান থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারের হাতেই। হয় মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে তাদের ফেরত নিতে হবে, না হয় রাখাইনে আলাদা রাষ্ট্র বা স্বায়ত্তশাসন এবং সেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ বসবাস এর বাইরে অন্য কোনো সমাধান টেকসই হবে না। তবে রাখাইনে নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তুলতে রোহিঙ্গারা হয়তো ভবিষ্যতে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মির সঙ্গে লড়াই করবে; কিন্তু সেই লড়াইয়ের পরিণতি কী হবে সেটি নির্ভর করবে চীন, ভারতসহ এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলো কাকে সমর্থন ও সহযোগিতা দেবে; যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে তার ওপর।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে