সীমান্ত শাসক হিসেবে মিয়ানমারের জাতিগত জোটের উত্থান
প্রায় দুই বছর আগে মিয়ানমার-চীন সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করেছিল থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স (৩বিএইচএ)। তারা এখন কেবল সামরিক শক্তি নয়, বরং এক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেও নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে। মুসে ১০৫ মাইল ট্রেড জোন ও কিয়িন সান কিয়াওত সীমান্ত গেট এখন আর যুদ্ধকালীন অস্থায়ী সম্পদ নয়। এগুলো এই তিন মিত্রের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হয়েছে। তাদের আয়ের উৎস এখন এই দখলকৃত অঞ্চল। তাদের শাসনক্ষমতা কীভাবে প্রতিষ্ঠা হবে তার পরীক্ষাগার হয়ে উঠেছে এই সীমান্ত অঞ্চল।
২০২৩ সালের অক্টোবরে সামরিক অভিযান অপারেশন ১০২৭ পরিচালনা করে মুসে। এর কয়েক মাসের মধ্যেই মুসে ১০৫ মাইল ট্রেড জোন তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও আরাকান আর্মির সমন্বয়ে গঠিত এই জোট বর্তমানে দেশের অন্যতম শক্তিশালী জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে পরিণত হয়েছে।
ক্যু-এর আগে এই ট্রেড জোন বছরে প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সামলাত। এখন অস্থিরতার কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২.২ বিলিয়ন ডলারে। সীমান্ত হারানোতে সামরিক সরকারের রাজস্ব কমার পাশাপাশি মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, সেনারা শুধু ভূখণ্ডই হারায়নি, বরং নিজেদের যুদ্ধ চালানোর অর্থনৈতিক ভিত্তিও হারিয়েছে।
অর্থনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসেবায়ও পদক্ষেপ নিচ্ছে জোট। চলতি বছরের জুলাইয়ে মুসের নিকটবর্তী মং ইউ এলাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল চালু করেছে ৩বিএইচএ। রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, আল্ট্রাসাউন্ডসহ ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়া হচ্ছে এখানে। এটি সীমান্তে বসবাসকারী মানুষ ও শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের চাহিদা পূরণ করেছে।
তবে সীমান্ত পেরোনো ব্যবসায়ীদের কেবল এখানেই শেষ নয়। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী ও অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বিভিন্ন চেকপয়েন্টে আবারও অর্থ দিতে হয়। প্রতিবার ২ লাখ থেকে ৭ লাখ কিয়াত (প্রায় ৯৫ থেকে ৩৩০ মার্কিন ডলার) পর্যন্ত ‘সিকিউরিটি ফি’ বা চাঁদা দিতে বাধ্য হন পরিবহনকর্মীরা। যানবাহনের চালকরা বলেন, ‘এসব পথে চলতে এখন শুধু সীমান্ত নয়- রাস্তার পুরোটাজুড়েই চেকপয়েন্ট। অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের জন্য তারা পদে পদে টোল আদায় করে আর ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমাদের অতিরিক্ত টাকা নিয়ে বের হতে হয়।’
একটি চীনা লজিস্টিক কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে প্রতিদিন ৬০০টিরও বেশি যানবাহন মিয়ানমারে যাতায়াত করে। চীন-মিয়ানমার বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত প্রায় ৪০০টি লজিস্টিক কোম্পানি সীমান্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এতেই চেকপয়েন্টগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব বোঝা যায়।
এতে চীনের বাণিজ্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাণিজ্যের জন্য তাদের একটা স্থিতিশীল সীমান্ত দরকার। তাই তারা বাস্তববাদী অবস্থান নিয়েছে, যে পক্ষ স্থিতি দিতে পারে তাদের সঙ্গেই কাজ করছে। এখন সে পক্ষ হলো ৩বিএইচএ। এতে বাণিজ্য চলমান থাকছে, সেনাদের দুর্বলতা স্পষ্ট হচ্ছে আর চীন সীমান্তে প্রভাবশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারছে।
বাণিজ্য আরও সহজ করতে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এখন অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছে, যেখানে চীন-মিয়ানমার রপ্তানিকারক ও লজিস্টিকস প্রতিষ্ঠানগুলোকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এখানে মাল পরিবহনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ার বাইরে বিশেষ কোনো পূর্বশর্ত নেই। আবেদনকারীদের এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবসায়িক লাইসেন্স ও পরিচয়পত্রের কপিসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হবে যাচাইয়ের জন্য। অনুমোদিত কোম্পানিগুলো স্টেশনের কাস্টমস ট্যাক্স অ্যাকাউন্টে প্রবেশাধিকার পাবে, যার মাধ্যমে দ্রুত ও নিয়ম মেনে অনলাইনে ট্যাক্স ঘোষণা ও যানবাহন নিবন্ধন করা যাবে। দ্য ইরাবতিকে এক ট্রাক চালক বলেন, ‘প্রথম মাসে বিষয়টা বেশ কঠিন ছিল; কিন্তু এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। অনলাইনে টাকা জমা দিয়ে ট্রাকগুলো অনায়াসে পেরিয়ে যাচ্ছে। তাদের ট্যাক্স সংগ্রহের ব্যবস্থা খুব দ্রুত।’
সীমান্ত গেটের নিয়ন্ত্রণ জোটের জন্য শুধু অর্থনৈতিক সাফল্য নয়, বরং শাসনক্ষমতা প্রদর্শনের ক্ষেত্র। কর আদায় ও জনসেবা নিশ্চিত করে তারা নিজেদের এক কার্যকর প্রশাসনিক বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করছে। এটি ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক আলোচনায় তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করবে। মিয়ানমারের ভাঙাচোরা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রে মুসে সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ তাই কেবল বাণিজ্যের নয়, ক্ষমতার পালাবদলেরও প্রতীক হয়ে উঠেছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে