Views Bangladesh Logo

কাগজে স্বাধীনতা, বাস্তবে নিয়ন্ত্রণ?

টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ খসড়া ২০২৫ এর বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া জনমতের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়েছে এ খসড়ায়। সেখানে বলা হয়েছে, এমন একটি 'আধুনিক' টেলিকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই আইন যা ডিজিটাল যুগের বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দেয়। রেডিও স্পেকট্রাম এবং সাবমেরিন ক্যাবল থেকে শুরু করে OTT, AI এবং IoT পর্যন্ত সবকিছুই আইনের ধারায়, উপ ধারায় বিস্তৃত আছে। কিন্তু একটু গভীরভাবে পর্য়বেক্ষণ করলে এই অধ্যাদেশ ঘিরে তিনটি বড় প্রশ্ন সামনে আসে। প্রশ্নগুলো হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি প্রকৃতপক্ষে কতটা স্বাধীন হবে, মন্ত্রণালয় বাস্তবিকভাবে কতটা তত্ত্বাবধান করতে পারবে, এবং লাইসেন্সিং ঠিক কোথায় শেষ হবে এবং নজরদারির নতুন অধ্যায় শুরু হবে ?

যদি এই প্রশ্নগুলির উত্তর এখনই স্পষ্টভাবে দেওয়া না হয়, তাহলে এই আইন সমগ্র ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের উপর ক্ষমতা কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে পারে, যখন নিয়ন্ত্রককে শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে নথি-পত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করবে। উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবন এবং প্রচেষ্টা মূল্যহীন হয়ে যাবে এবং এই আইন তাদের শুধুমাত্র লাইসেন্স-প্রার্থীতে পরিণত করবে।

'স্বাধীন' বিটিআরসি – নাকি শুধু একটি প্রযুক্তিগত সচিবালয়?

আইনের ৩৩ ধারায় বিটিআরসিকে লাইসেন্স, পারমিট এবং অনুমতি প্রদানের ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, “তবে, 'জাতীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ লাইসেন্স'-এর জন্য মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীদের নিয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হবে, এবং এই ধরনের লাইসেন্সের সিদ্ধান্ত সেই কমিটির পর্যায়ে নেওয়া হবে – কমিশন শুধুমাত্র সুপারিশ এবং প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন প্রস্তুত করার জন্য সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য লাইসেন্সের সিদ্ধান্ত বিটিআরসি একাই নিতে পারবে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের প্রয়োজন ছাড়াই (যেমনটি ২০০১ সালের আইনের ২০১০ সংশোধনীর পর থেকে ছিল), কিন্তু খসড়াটি স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করে না কোন লাইসেন্সগুলিকে 'জাতীয় পর্যায়ে তাৎপর্যপূর্ণ' হিসাবে বিবেচনা করা হবে।


টেলিকমের মতো একটি খাতে, প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকিছুই জাতীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ: মোবাইল অপারেটর, আইএসপি, ইন্টারকানেকশন অপারেটর, অবকাঠামো অপারেটর, স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশন, সাবমেরিন ক্যাবল, গুরুত্বপূর্ণ ডেটা সেন্টার, বড় কন্টেন্ট ডেলিভারি নেটওয়ার্ক। যদি এগুলো এই অসংজ্ঞায়িত শ্রেণীর অধীনে পড়ে, তাহলে প্রতিটি বড় বাজারে প্রবেশ, নবায়ন, একীভূতকরণ বা অধিগ্রহণের জন্য কার্যত রাজনৈতিক অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। এর তিনিটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

প্রথমত, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি’র স্বাধীনতা খর্ব হবে । বিটিআরসি অনুশীলনে একটি প্রযুক্তিগত সচিবালয়ে পরিণত হয় যা ফাইল উপরে পাঠায়, একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সংস্থা যা তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রক পছন্দের জন্য সরাসরি জবাবদিহিমূলক হতে পারে তার পরিবর্তে। দ্বিতীয়ত, যে কোন লাইসেন্সের ক্ষেত্রে নীতি সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি থাকে। লাইসেন্স এবং একীভূতকরণ সিদ্ধান্তগুলি স্বচ্ছ, জনসাধারণের জানা মানদণ্ডের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদী রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ, দলীয় বিরোধ বা লবিং দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তৃতীয়ত, বিনিয়োগকারী এবং সেবা প্রদানকারীদের অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়। যদি বড় সিদ্ধান্তগুলো একটি বিশেষায়িত নিয়ন্ত্রক সংস্থার পরিবর্তে মন্ত্রীদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আবর্তে ঘুরপাক খায়, তাহলে অবশ্যই বড় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রাও উচ্চতর হবে। প্রতিটি নতুন বিনিয়োগই আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতায় পড়তে পারে।

যদি উদ্দেশ্য হয় সত্যিকার অর্থে কয়েকটি কৌশলগত লাইসেন্সকে রাজনৈতিক স্তরে রাখা, তাহলে আইনের সংজ্ঞাতেই সেটা স্পষ্ট করা উচিত। বিশেষ করে “জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ” বলতে কী বোঝায়— বাজার শেয়ার, অবকাঠামোর ধরন বা ঝুঁকির ভিত্তিতে, তা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা জরুরি। অন্যথায়, এ আইনের মাধ্যমে বিটিআরসির স্বাধীনতা শুধু কাগজে স্বাধীনতা হয়ে যাবে।


সাধারণ কর্মীদের নিয়ে একটি সুপার-মন্ত্রণালয়!

এই খসড়ার তিন নম্বর ধারা শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভূখণ্ড এবং আন্তঃসীমান্ত টেলিকম সেবার জন্য প্রযোজ্য করে না, বরং স্পষ্টভাবে 'অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ওভার-দ্য-টপ (OTT) সেবা এবং সমস্ত ডিজিটাল কন্টেন্ট সেবা, সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কিংবা বিদেশের প্রতিষ্ঠান হোক, সবার ক্ষেত্রিই প্রযোজ্য বিবেচিত হয়। এ ছাড়া 'টেলিকম সেবা'-র সংজ্ঞা সম্প্রসারিত করে বর্তমান বিশ্বের উন্নততর প্রযুক্তি যেমন, Gov-Tech, Agro-Tech, Ed-Tech, Fin-Tech, AI এবং Generative AI, IoT প্রায় সবগুলোকেই অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। অতএর প্রকৃতপক্ষে এর অর্থ হচ্ছে, প্রস্তাবিত অধ্যাদেশ জারি হলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ (PTD) নিজেকে নীচের সবগুলো সেবার মূল সমন্বয়কারী এবং একঅর্থে নিয়ন্ত্রকও হবে।

• সোশ্যাল মিডিয়া এবং কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম
• OTT যোগাযোগ এবং স্ট্রিমিং সেবা
• AI এবং জেনারেটিভ AI অ্যাপ্লিকেশন
• IoT এবং মেশিন-টু-মেশিন সিস্টেম
• GovTech এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ভেতরে কাজের ডিজিটালকরণ
• ডেটা স্থানীয়করণ এবং 'ডেটা সার্বভৌমত্ব'।
এ কারনে অধ্যাদেশের তিন নম্বর ধারা কার্যকরভাবেডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ কে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের মূল সমন্বয়কারী পরিণত করবে। অথচ খসড়ায় কিছুই ব্যাখ্যা করা হয়নি যে এই সুপার-মন্ত্রণালয় তার বর্তমান জনবল দিয়ে এত বিশাল এবং বিশেষায়িত কার্যক্রম কীভাবে পরিচালনা করবে। কারন এই বিভাগটি মূলত কয়েকজন আমলাতান্ত্রিক কর্মী দিয়ে পরিচালিত হয়, যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্রিপ্টোগ্রাফি, সাইবার-নিরাপত্তা, প্ল্যাটফর্ম শাসন বা ডিজিটাল বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ নয়। সীমিত বিশেষজ্ঞ সক্ষমতা সহ একটি অতিরিক্ত সম্প্রসারিত মন্ত্রণালয় দুটি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়।

• প্রথমত, অন্যান্য আমলতান্ত্রিক দপ্তরের মতই এই বিভাগও উন্নত প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র-নির্ভর নিয়ন্ত্রণ চালু করবে, বাস্তব অবস্থা মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারের অন্যান্য দপ্তরগুলোর সঙ্গে যেমন আইসিটি বিভাগ, ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রকট হবে। অতএব এই পরিস্থিতি এড়াতে দু’টি বিষয় নিশ্চিত করা খুবই প্রয়োজন। (১) পরিষ্কার দায়িত্ব-বণ্টন, (২) বাস্তবসম্মত সমন্বয় কাঠামো। এটা না হলে এই আইন নিয়ন্ত্রণের বদলে অকার্যকর জটিলতা তৈরি করবে।

তথ্যপ্রযুক্তির সবকিছু একটি টেলিকম সেবা এবং প্রত্যেকটির জন্য লাইসেন্স দরকার

ধারা ৩৫ এ বলা হয়েছে, টেলিকম এবং ইন্টারনেট সেবার জন্য, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স বা, যেখানে প্রযোজ্য, একটি সার্টিফিকেট ছাড়া এই ধরনের সেবা প্রদান করতে পারবে না – শুধুমাত্র উপ-ধারা (৩)-এ সীমিত ব্যতিক্রম সাপেক্ষে। অর্থাৎ কেউ লাইসেন্স বা সার্টিফিকেট ছাড়া টেলিকম বা ইন্টারনেট ভিত্তিক কোন ধরনের সেবাই দিতে পারবে না, একেবারে সীমিত কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
এখন যখন ধারা ৩ এর বিস্তৃত পরিসীমার সাথে মিলিয়ে পড়লে দেখা যায়, এই অধ্যাদেশ জারির পর যে কেউ যদিএকটি অ্যাপ বা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালায়, কনটেন্ট সরবরাহ করে যা বাংলাদেশ থেকে অ্যাক্সেস করা যায় অথবা এই অ্যাকসেস বা কনটেন্ট IoT ব্যবহার করে কোন সিস্টেম পরিচালনা করে,তবে তাকে বিটিআরসি থেকে লাইসেন্স নিতে হতে পারে। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, ছোট স্টার্টআপগুলোকেও কি পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় যেতে হবে, বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলো কি শুধু বাংলাদেশের ব্যবহারকারী আছে বলে লাইসেন্স নিতে বাধ্য হবে এবং তারা যদি লাইসেন্স না নেয়, তাহলে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্লাটফরম ফেসবুক, গুগল, টিকটক যে কোন সময় খেয়াল-খুশীমত বন্ধ বা ব্লক করা হবে? কারন আইনে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগকে কার্যত সেই ক্ষমতাই দেওয়া হচ্ছে।


এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী বেকায়দায় পড়বেন দেশের ছোট ছোট উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপরা। এমনকি অর্থাৎ, আপনি একটি ফেসবুক পেজ খুললেও আপনাকে বিটিআরসি’র কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে, ধারা তিন এবং ৩৫ সেটাই বলে দিচ্ছে। এ কারনেই কিছু জটিল প্রশ্ন সামনে চলে আসে। প্রথমত, “প্রতিটি ছোট স্থানীয় অ্যাপ, SaaS স্টার্টআপ, YouTube-স্টাইল কন্টেন্ট প্ল্যাটফর্ম বা গবেষণা IoT পাইলট কি একটি সম্পূর্ণ লাইসেন্স প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে?” দ্বিতীয়ত, ”বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মগুলির কী হবে যাদের সেবা বাংলাদেশে অ্যাক্সেসযোগ্য হয় – তাদের কি শুধুমাত্র এখানে ব্যবহারকারীরা লগ ইন করতে পারে বলে বিটিআরসি লাইসেন্স নিতে বলা হতে পারে?” এবং তৃতীয়ত, “যদি তাই হয়, তারা না করলে কী হবে? অ্যাক্সেস কি ব্লক করা হবে? স্থানীয় ব্যবহারকারীরা কি 'লাইসেন্সবিহীন' ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করার জন্য অপরাধীকরণ করা হবে?

মনে রাখতে হবে লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া দেশের শিল্প ও বানিজ্যখাতে সরকারের একটি শক্তিশালী ভারী অস্ত্র। এ কারনেই এটি সবকিছুর কেত্ষত্রে বাধ্যতামূলক করলে তা দুর্বল হয়ে যাবে। লাইসেন্সিং শুধুমাত্র যে কোন সেবার মূল ও কেন্দ্রীয় স্তরে যেমন যারা সীমিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেতার তরঙ্গ, জাতীয় পর্যায়ে বৃহত্তম বানিজ্যিক সেবা, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো (জাতীয় নেটওয়ার্ক, গেটওয়ে) এ ধরনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। এটি প্রতিটি ওয়েব সেবা, AI মডেল বা OTT অ্যাপের জন্য বাধ্যতামূলক করা কখনই বাস্তবসম্মত নয় এবং অবশ্যই এ ধরনের লাইসেন্সিং পুরো ডিজিটাল সেবাকেই সীমাবদ্ধ করবে এবং এ খাতে নতুন উদ্ভাবন বন্ধ হয়ে যাবে।

এ জন্য খসড়ায় কয়েকটি স্তরের লাইসেন্স কাঠামো সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, নেটওয়ার্ক অপারেটর এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর জন্য সম্পূর্ণ লাইসেন্স, দ্বিতীয়ত, উল্লেখযোগ্য স্থানীয় প্রভাব সহ নির্দিষ্ট বড় প্ল্যাটফর্মের জন্য নিবন্ধন ব্যস্থা রাখা এবং এই নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বা যোগাযোগের সংস্থা সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত, যেমন বিটিআরসি। তৃতীয়ত, অ-বাণিজ্যিক ব্যবহার, ছোট উদ্যোক্তা, শেষ-ব্যবহারকারী কন্টেন্ট এবং ন্যূনতম স্থানীয় সংযোগ সহ সম্পূর্ণ বিদেশী সেবার বিষয়টি উন্মুক্ত রাখা। এই তিনটি বিষয়ে নজর না দেওয়া হলে ধারা ৩৫ দেশের পুরো ইন্টারনেটক ব্যবস্থাকে জটিল লাইসেন্সিং ব্যবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে এবং এর ফলে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিচ্ছিন্ন করে দেবে।

নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক, আইনসম্মত বাধা: এনটিএমসি’র নাম বদলে ‘ক্লিপ’ হচ্ছে?

অধ্যাদেশের ধারা ৯৭(ক) ধারা “ল’ফুল ইন্টারসেপশন” প্রক্রিয়াকে সংজ্ঞায়িত করেছে, এটি আইনগতভাবে ইতিবাচক। আইনে আগের এনটিএমসি’র বদলে CLIP (Central Lawful Interception Platform) স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।এক্ষেত্রে
“বর্তমানে LEA-গুলোর হাতে থাকা ইন্টারসেপশন সরঞ্জাম CLIP-এ হস্তান্তরের” কথা বলা হয়েছে, যা স্পষ্ট নয়। এ কারনে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ক্ষেত্রে প্রোটোকল কীভাবে প্রযোজ্য হবে, সেটিও স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। বেশীরভাগ নিষেধাজ্ঞাকে প্রতীকী বলা হলেও একই সঙ্গে অধ্যাদেশের ৯৭ ধারা নেটওয়ার্কে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা কিংবা ইন্টারনেটের গতি সীমিত করার সিদ্ধান্ত দিলেও তার প্রকৃত কার্যকারিতা নির্ভর করবে স্বচ্ছ ও কঠোর প্রোটোকলের ওপর। প্রটোকলে থাকা উচিত, সীমিত ও স্পষ্ট কারন , লিখিত মেয়াদ ও সীমাবদ্ধ নির্দেশ, ভৌগলিক ও প্রযুক্তিগত সীমা নির্ধারন এবং ঘটনার পর প্রকাশ্য ব্যাখা। এই ধরনের প্রোটোকলের মাধ্যমে বাস্তবতা স্বীকার করে যে কিছু জরুরি অবস্থায় লক্ষ্যযুক্ত হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে, যখন নাগরিক এবং ব্যবসাকে স্বেচ্ছাচারী বা রাজনৈতিকভাবে অশুভ উদ্দেশ্য থেকে রক্ষা করবে।
প্রকৃতপক্ষে ধারা ৯৭(ক), নেটওয়ার্কে 'আইনসম্মত বাধা'-র (ল ফুল ইন্টারসেপশন) বিধানের পুনঃপ্রবর্তন। এবং এটাও স্পষ্ট নয় কেন আগের NTMC ভেঙে দিয়ে CLIP দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। তবে এই উপ-ধারার খসড়া নাগরিকদের কিছু আশ্বাস দেয় যে তারা কেবল কারো কাছে প্রযুক্তি থাকার কারণে অদ্ভুত নজরদারির শিকার হবেন না।

তবে এখানে দু’টি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, এর আগে বেশিরভাগ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা/তদন্ত সংস্থা এলআইসি সরঞ্জাম ক্রয় করেছে এবং এখনও ব্যবহার করছে। এটি স্পষ্ট নয় তাদের সেই সরঞ্জাম এবং সক্ষমতাগুলো কিভাবে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা হবে। খসড়ায় বিষয়টি স্পষ্ট নয় এবং অবশ্যই অধ্যাদেশ চূড়ান্ত করার সময় এটি স্পষ্ট করা উচিত। এটি স্পষ্ট করার বিষয়ে বিবেচনা করতে পারে।

উপসংহার

২০০১ সালে টেলিযোগাযোগি আইনকে ওটিটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগের সঙ্গে সমন্বয় করে আধুনিক করার উদ্যেগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু যদি তিনটি মূল বিষয় ঠিক না করা হয় অর্থাৎ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত না করা হয়, সংশ্লিস্ট বিভাগের বাস্তবসম্মত প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব, নিশ্চিত না করা হয় লাইসেন্সিং ব্যবস্থাকে সুনির্দিষ্ট ও বাস্তবতা বিবেচনায় সীমারেখার মধ্যে না রাখা হয় তাহলে এই অধ্যাদেশ বাংলাদেশ এমন একটি ডিজিটাল শাসন ব্যবস্থা তৈরি করেবে যা হবে নিয়ন্ত্রণে ভারী এবং আস্থায় হালকা।অতএব সরকার এ অধ্যাদেশ জারির আগে পরামর্শের সংশিক্ষপ্ত জানালা আরও সম্প্রসারিত করলে সেটাই উত্তম হবে। এত জটিল একটি আইনের বিষয়ে নাগরিক মতামত গ্রহনের সময়সীমা কমপক্ষে এক মাস হওয়া উচিত। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।


আবু নাজম ম তানভীর হোসেন: পাবলিক পলিসি অ্যাডভোকেট

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ