কারাগারে কয়েদির সংখ্যা ও খরচ কমাতে পারে প্রযুক্তির ব্যবহার
‘ন্যাশনাল মুভমেন্ট ফর সোশ্যাল জাস্টিস’ কিছুদিন আগে একটা ওয়েবিনারের আয়োজন করেছিল। বিষয় ছিল- বিচার-বহির্ভূতভাবে কয়েদিদের আটক বা রিমান্ড প্রথা নিয়ে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনার সূচনা হয়েছিল একজন নিউরোলজিস্ট এবং তার মেয়েকে রিমান্ডে পাঠানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহেকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তাই প্রশ্নটি আবার নতুন করে সামনে এসেছে- প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারাগারে কয়েদির সংখ্যা ও খরচ কীভাবে কমানো যায়।
কারাগারে কয়েদির বাড়তি সংখ্যার কারণ
ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফ অনুযায়ী, ২০২৫ সালে শ্রীলঙ্কার কারাগারগুলোতে সর্বমোট বন্দি ধারণক্ষমতা ছিল ১৩ হাজার ২৪১ জন; কিন্তু কারাগারগুলোতে রাখা হয়েছিল ৩২ হাজার ৭৪৭ জনকে। বাস্তবিক অর্থেই এটি একটি অকল্পনীয় অমানবিক পরিস্থিতি। তার চেয়েও খারাপ, এই বন্দিদের দুই-তৃতীয়াংশেরই কোনো অপরাধ প্রমাণিত হয়নি। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাদের বন্দি করা হয়েছিল। এমনি কি রিমান্ডেও পাঠানো হয়েছিল। বিচার প্রক্রিয়া ছাড়াই শ্রীলঙ্কায় বন্দি রাখার হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি।
শ্রীলঙ্কার মানবাধিকার কমিশনের ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্য, স্যানিটেশন এবং নিরাপত্তা কারাগারগুলোতে খুবই খুম। কারাগারগুলোতে অতিরিক্ত কয়েদি থাকার কারণে বন্দিদের পালাক্রমে ঘুমাতে হয় অথবা শৌচাগারের ভেতরে ঘুমাতে হয়। কারণ তাদের শোয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কারাগারগুলোতে মাদকের ব্যবহারও ব্যাপক। ফলে সহিংসতা বাড়ছে, যা বন্দিদের বিপদের মুখে ফেলে দেয়। কারাগারগুলোতে অসহনীয় গরম, অসংখ্য ইঁদুর। বিছানাগুলো পোকামাকড়ে ভরা।
এ কারণেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ রিমান্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কারাগারের হাসপাতালেও স্থানান্তর করা হয়। আর তার জন্য দরকার হয় প্রভূত পরিমাণ ঘুষ। কারাগার-হাসপাতালের সঙ্গে ঘুষের কী সম্পর্ক- এটা এ ক্ষেত্রে বোঝা যেতে পারে। (কেন সাবেক উপ-পরিচালক বর্তমানে রিমান্ডে আছেন তাও এতে বোঝা যেতে পারে)। বিচারক যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য-প্রমাণ ছাড়া অতিরিক্ত বন্দিদের আটক করা থামানোর কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে কারাগার ব্যবস্থার দুর্নীতি কিছুটা কমতে পারে। ফলে সৃষ্ট দুর্নীতিও কিছুটা কমতে পারে। তা না হলে, প্রযুক্তিগত কোনো সমাধানের পথ নিয়েও ভাবা যেতে পারে।
ইলেকট্রনিক পর্যবেক্ষণ বা ডিজিটাল নজরদারি
যারা হলিউডের সিনেমা দেখেন তারা হয়তো বিচারের অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের পায়ে ইলেকট্রনিক অ্যাঙ্কলেট বাঁধা দেখেছেন। বিচারের অপেক্ষায় থাকা ব্যক্তিদের ইলেকট্রনিক অ্যাঙ্কলেট পরার বিষয়টি সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমেও উঠে এসেছে। ব্রাজিলের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জাইর বলসানারো, যিনি উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিচারের অপেক্ষায় আছেন এবং তার উত্তরসূরিকে হত্যার পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাকে অ্যাঙ্কলেট পরার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ইলেকট্রনিক মনিটরিং হলো এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে একটি ডিভাইস ব্যক্তির পা বা কব্জিতে লাগানো হয়, যাতে তার অবস্থান ট্র্যাক করা যায়। সে নির্ধারিত এলাকার মধ্যে না থাকে, যেমন তার বাড়ির মধ্যে, তাহলে কর্তৃপক্ষ দ্রুত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এর ফলে সরকারকে আর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলখানায় বন্দি রাখতে হয় না। কয়েদিদের খাওয়ানো, পাহারা দেয়া, থাকার ব্যবস্থার হাত থেকে কারা কর্তৃপক্ষ মুক্তি পায়। সরকারকে কেবল দূরবর্তী অবস্থান থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং শর্ত লঙ্ঘন করা হলে সাড়া দিতে হবে। ব্যয়বহুল কারাগারগুলোতে নিয়ম লঙ্ঘনকারী দোষী এবং রিমান্ডে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ইলেকট্রনিক মনিটরিং ব্যবহার করা যেতে পারে।
অনেক দেশেই এর মধ্যে ইলেকট্রনিক মনিটরিং কার্যকর করা হয়েছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, ব্রাজিল এবং থাইল্যান্ড রয়েছে। ভিয়েতনাম শিগগির এটি কার্যকর করার পরিকল্পনা করছে। দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের নজরদারির জন্য ইলেকট্রনিক মনিটরিং প্রথম চালু করা হয় ব্রাজিলে, ২০১০ সালে। প্রক্রিয়ার আগে বন্দিদের দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ২০১১ সাল থেকে এটি বিচার ব্যবহার করা হচ্ছে। ব্রাজিলে ২০১৯ সালের মধ্যে সক্রিয় ডিভাইসের সংখ্যা ছিল ৬০ হাজার ৩৪৭টি। দেশটির কারাগারে বন্দিদের তুলনায় তা ৯ শতাংশেরও কম। কভিড-১৯ মহামারির সময় ইলেকট্রনিক মনিটরিংয়ের ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল। ভাইরাসের বিস্তার রোধে এটি সহায়ক ছিল। এর ফলে মহামারির সময় কারাগারে মৃত্যুহার মাত্র ০.৪১ শতাংশ। যা দেশটির বর্তমান ২ দশমিক ৫৬ শতাংশের তুলনায় অনেক কম।
আইন অনুযায়ী, যাকে মনিটর করা হচ্ছে তাকে সব সময় অ্যাঙ্কলেট পরতে হবে এবং তা চার্জড রাখতে হবে। যদি তা না হয়, মনিটরিং সেন্টার সতর্ক হবে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সেখানে পৌঁছাবে। অ্যাঙ্কলেট পরিধানকারীদের অবশ্যই বাড়িতে থাকতে হবে বা পূর্বনির্ধারিত স্থানগুলো এড়াতে হবে এবং নির্ধারিত সময়ে বাড়ি ফিরে আসতে হবে। যদি এই শর্তগুলো ভঙ্গ করা হয়, তবে তাকে কারাগারে রাখা হতে পারে। ব্রাজিলে ব্যবহৃত অ্যাঙ্কলেটগুলো পরিচালনা করে ‘স্পেসকম’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা এর জন্য যা জিপিএস এবং সেলুলার টাওয়ার ব্যবহার করে। এতে দুটি সিম কার্ড থাকে, একটি ইন্টারনেটে সংযুক্ত থাকে এবং অপরটি জিওলোকেশন ডেটা ট্র্যাকিং সেন্টারে পাঠায়।
খরচ
২০২৪ সালে ব্রাজিলে একটি ইলেকট্রনিক ব্রেসলেটের দাম ছিল প্রায় ২০০ ব্রাজিলিয়ান রিয়াল (১০ হাজার ৮০০ টাকা)। ইম-এর মাধ্যমে একজন বন্দির পর্যবেক্ষণের খরচ শারীরিক কারাবাসের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম বলে জানা গেছে। শ্রীলঙ্কায় একজন বন্দির রক্ষণাবেক্ষণের খরচের হিসাব করা হয়েছে কারা বিভাগের ২০২৪ সালের সংশোধিত পুনরাবৃত্ত ব্যয়কে শ্রীলঙ্কার মোট কারাগারের জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করে। মোট পুনরাবৃত্ত ব্যয় ১৫.৬ বিলিয়ন টাকা। প্রতি বন্দির বার্ষিক খরচ ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭১০ টাকা। এখানে কেবল কার্যক্রমমূলক পুনরাবৃত্ত ব্যয় ধরা হয়েছে, যেমন খাদ্য এবং কর্মচারীদের বেতন।
দেশের পুলিশ স্টেশনগুলোকে ইএম-এর সৃষ্ট সতর্কবার্তায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য সক্ষম হতে হবে। যেহেতু ভিআইপি নিরাপত্তার জন্য যে জনবল নিযুক্ত থাকে তার সংখ্যা কমে গেছে, অতিরিক্ত খরচ প্রয়োজন হবে না। বিচার-বহির্ভূত বন্দির সংখ্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার কারণে কারাগারে যে সমস্যার সৃষ্টি হয় তার বাস্তবসম্মত সমাধান ইলেকট্রনিক অ্যাঙ্কলেটের ব্যবহার বাড়ানো। এতে খরচ অনেক কমে যাবে। বন্দিরাও নিজের বাড়িতে সুস্থভাবে বাঁচবে। এভাবে আটক রাখার উদ্দেশ্য হলো এটা নিশ্চিত করা যে তারা আদালতে যথাসময়ে হাজির হবে। তদন্তে বাধা সৃষ্টি করবে না।
প্রযুক্তির সহযোগিতায় এই দুটি লক্ষ্য খুবই সহজেই অর্জন করা সম্ভব। এই সমাধান গ্রহণ না করলে বিচারের আগেই কারাগারে আটক রাখা ও রিমান্ডে রাখার বিষয়টিকে আগের মতোই দাবি করা হবে যে, মূলত শাস্তি প্রক্রিয়া হিসেবেই সরকার তাদের কয়েদি হিসেবে রেখেছে। এতে বিচারিক প্রক্রিয়ার অদক্ষতাই প্রমাণ হবে। সরকাররেও এতে মানহানি হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে এটা সমাধান করা গেলে সরকার অনেক অভিযোগ থেকে বাঁচবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে