প্রাথমিক স্কুলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমান
প্রাথমিক শিক্ষার হার বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। প্রতি বছরই আগের বছরের চেয়ে অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হচ্ছে; কিন্তু এর বিপরীতে এক হতাশাজনক চিত্রও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। আর তা হলো ১৪ বছর পর এবার প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী প্রাথমিক স্কুল থেকেই ঝরে পড়তে শুরু করে; কিন্তু বিগত বছরগুলো সেই সংখ্যা কমানো গিয়েছিল। এ বছর হঠাৎ তা বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
গতকাল (৩১ আগস্ট) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার টানা ১৪ বছর কমতে থাকার পর গত বছর আবার বেড়েছে। সরকারি এক প্রতিবেদনে উঠে আসা এ তথ্যকে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের (ডিপিই) গত মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিসংখ্যান (এপিএসএস) ২০২৪’ অনুসারে ২০২৩ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মুদ্রাস্ফীতিজনিত আর্থিক চাপ এবং অল্প বয়সে শ্রমবাজারে প্রবেশসহ বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ার হার বেড়েছে।
ফলে অনেক পরিবার আর্থিক সংকটের কারণে সন্তানদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে অল্প বয়সেই শ্রমবাজারে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। এতে আরও বলা হয়, ছেলেদের ঝরে পড়ার হার মেয়েদের তুলনায় বেশি। ২০২৩ সালে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ছিল ১৪ দশমিক ১২ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ০২ শতাংশে। অন্যদিকে, মেয়েদের ঝরে পড়ার হার বেড়ে ১২ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে ১৩ দশমিক ৩৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশে বর্তমানে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬০৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৬০ লাখের বেশি শিশু পড়াশোনা করছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা যখন ওপরের শ্রেণিতে ওঠে তখন ঝরে পড়ার হার বেড়ে যায়। এতে বোঝা যায় যে, প্রাথমিক শিক্ষার ধাপে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে শিক্ষার্থীরা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির যে প্রকৃত মূল্য, তা কমে গেছে। ফলে অনেক পরিবার টিকে থাকার সন্তানের শিক্ষার চেয়ে জীবিকা নির্বাহকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। পারিবারিক সংকট এবং জলবায়ুজনিত দুর্ভোগ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই চাপকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ছেলেরা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে বেশি, কারণ তারা অল্প বয়সেই শ্রমবাজারে প্রবেশ করে বা শিক্ষানবিশ কাজে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, শিক্ষার্থী ধরে রাখার এই উল্টোদিকের প্রবণতা বাংলাদেশের সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ঝরে পড়া রোধ করতে বিশেষজ্ঞরা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উপবৃত্তি চালু করার এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রাথমিক স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার বিষয়টি নানা দিক থেকেই আতঙ্কজনক। এতে এক দিকে শিক্ষার সামগ্রিক দিকে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তেমনি শিশুশ্রম বেড়ে যাবে, বেকারত্ব বাড়বে, সমাজে নানা ধরনের অপরাধ-প্রবণতাও বাড়বে। অসংখ্য শিশু এতে নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক নিয়মশৃঙ্খলা থেকে বঞ্চিত হবে। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সামাজিক গবেষকদের উচিত ঝরে পড়ার কারণটি আরও খতিয়ে দেখা এবং তা রোধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
এ ব্যাপারে এখনই সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নেয়া উচিত। বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। পুরো বিষয়টিরই সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য অনেক সুদূরপ্রসারি। জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো ছাড়া, শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ উন্নত করা ছাড়া এ থেকে মুক্তির আর কোনো পথ খোলা নেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে