ধর্ষণ, ভিডিও ভাইরাল ও কয়েকটি প্রশ্ন
ভয়াবহ এক ভিডিও দেখে গতকাল রাতে অনেক বাংলাদেশিই ঠিক মতো ঘুমাতে পারেননি। ভিডিওটি এক ধর্ষিতা নারীর। তার আর্তনাদ সারা বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। যেন সমস্ত বাংলাদেশ নগ্ন হয়ে গেছে। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পরই সারা দেশের মানুষ জানতে পারল বর্বরোচিত এই ঘটনাটি ঘটেছে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায়। অথচ ঘটনাটি ঘটেছিল গত বৃহস্পতিবার ২৬ জুন রাতে। গত শুক্রবার দুপুরে ভুক্তভোগী নারী থানায় মামলা করলে পুলিশ অভিযানে নামে।
আজ রোববার (২৯ জুন) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এই ঘটনায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে মূল অভিযুক্ত ফজর আলীকে (৩৮) আজ ভোর ৫টার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই নারীকে নির্যাতনের ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে। তারা হলেন মো. সুমন, রমজান আলী, মো. আরিফ ও মো. অনিক। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বাড়ি মুরাদনগর উপজেলায়।
মামলার এজাহার ও ভুক্তভোগী ওই নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বী ওই নারী প্রায় ১৫ দিন আগে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে বাবার বাড়ির পাশে পূজা হচ্ছিল। পরিবারের সদস্যরা সেখানে গিয়েছিলেন; তিনি বাড়িতে একা ছিলেন। আনুমানিক ১০টার দিকে ফজর আলী নামে এক ব্যক্তি তার বাবার বাড়ি গিয়ে ঘরের দরজা খুলতে বলেন। এ সময় তিনি দরজা খুলতে অস্বীকৃতি জানান। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি ঘরের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করেন।
ঘটনার প্রাপ্ত তথ্য এতটুকুই। এখন কয়েকটি প্রশ্ন সামনে আনা যাক: একজন ব্যক্তি দরজা ভেঙে এক নারীর ঘরে প্রবেশের সাহস পায় কী করে? অভিযুক্ত ব্যক্তির রাজনৈতিক পরিচয় সামনে এসেছে। অনেকে বলছেন, ধর্ষকের পরিচয় কেবল ধর্ষক, তার রাজনৈতিক পরিচয় বড় না; কিন্তু এ-কথাও তো সত্য, রাজনৈতিক পরিচয়ও উক্ত ব্যক্তির এক শক্তি।
দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, স্থানীয় বাসিন্দারা চিৎকার শুনে ছুটে এসে প্রথমে কেন ভুক্তভোগী নারীকেই মারধর করলেন, ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের একটু সময় কেন তারা নিলেন না? এর মধ্যেই কয়েকজন কেন তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করতে শুরু করলেন? পুরো ব্যাপারটাই কি একটা অসুস্থতা না? এই ভিডিও তারা আবার কোন রুচিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন? আর তারা ছড়ানোর পর অসংখ্য-অজস্র মানুষ সেটা শেয়ার করে কেন ভাইরাল করে দিলেন?
ধর্ষকের কথা বাদ, ভিডিও ধারণকারীদের কথা বাদ, যারা ভিডিওটি শেয়ার করেছেন তারা ঠিক কী বুঝে শেয়ার করেছেন? এর মধ্য দিয়ে তারা কী বার্তা দিতে চেয়েছেন? আবার এমনও শোনা গেছে, ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি সেই ধর্ষিতা নারীর নয়। আরও চমকপ্রদ খবর হচ্ছে, আজ রোববার দুপুর থেকে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে সেই নারী সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন। সাংবাদিকদের তিনি বলছেন, এখন তিনি মামলা তুলে নিতে চাচ্ছেন। কেন তিনি মামলা তুলে নিতে চাচ্ছেন তাও তিনি স্পষ্ট জানাচ্ছেন না। তিনি জানিয়েছেন তার ওপর কারও প্রেসার নেই। সাংবাদিকরা এমনও জানিয়েছেন, অভিযুক্ত ধর্ষক ফজর আলীর সঙ্গে উক্ত ভুক্তভোগী নারীর পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল। সেই নারী তা অভিযোগ করেছেন।
বহু প্রশ্ন সামনে রেখে ঘটনাটির বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে আমরা এখনো নানারকম ধোঁয়াশার মধ্যে আছি। প্রশাসনকে অবশ্যই ঘটনাটি আরও সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করতে হবে। এখানে অভিযুক্ত ধর্ষক, ভুক্তভোগী নারী, ভিডিও ধারণকরা ব্যক্তি, সেই ভিডিও শেয়ার করা মানুষরা- কারা যে কার থেকে বেশি অপরাধী তাও এক প্রশ্ন রয়ে গেল।
তাই নারী ও শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে হবে নিরাপদ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা এবং নিপীড়নমুক্ত সমাজব্যবস্থ্যা। সেই সঙ্গে নারী ও শিশুর প্রতি আপনজনসহ সবাইকে মানবিক আচরণ করতে হবে এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে