Views Bangladesh Logo

পপি বীজ: মাদক নাকি মশলা

 VB  Desk

ভিবি ডেস্ক

পাকিস্তান থেকে পাখির খাবার আমদানির আড়ালে বাংলাদেশে আনা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ পপি বীজ। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তারা গোপন তথ্যের ভিত্তিতে ২৫ টন পপি বীজসহ দুই কনটেইনার জব্দ করেছেন।


বৃহস্পতিবার এই খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পপি বীজ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই বলেন, পপি বীজ মানেই মাদক; আবার অনেকেই বলেন এটি রান্নার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসর্গ। প্রশ্ন উঠে—পপি বীজ কি মাদক নাকি মশলা?


পপি বীজ বা পোস্তদানা কী

পপি বীজ বা পোস্তদানা হলো আফিম গাছের শুকনো বীজ। আফিম গাছের ফুল থেকে যে ফল হয়, সেই ফল পরিপক্ব হলে তা সংগ্রহ করে রোদে শুকানো হয়। এ শুকনো ফলের ভেতরের বীজই হলো পপি বীজ বা পোস্তদানা।

তবে মনে রাখতে হবে, সব পপি ফুল থেকে মাদক জাতীয় আফিম উৎপন্ন হয় না। বিশেষ এক ধরনের পপি গাছ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Papaver somniferum, সেখান থেকেই আফিম তৈরি হয়। এই গাছের ফুল ফোটার পর যে সবুজ ফলের শুটি তৈরি হয়, তার ভেতরে দুধের মতো কষ থাকে। সেই কষ থেকেই তৈরি হয় আফিম, যা থেকে পরবর্তীতে মরফিন, কোডিন, হেরোইন ইত্যাদি মাদক পদার্থ তৈরি করা হয়।

কিন্তু ফলটি যখন পুরোপুরি শুকিয়ে বীজ পরিপক্ব হয়, তখন সেই বীজে মাদকের উপাদান থাকে না বা থাকে অতি অল্প মাত্রায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। তাই এই শুকনো বীজ (পোস্তদানা) অনেক দেশে বৈধভাবে ব্যবহার করা হয় খাদ্যপণ্যে বা মশলা হিসেবে।


পোস্তদানার ব্যবহার

এই বীজগুলো অনেক দেশে, বিশেষ করে মধ্য ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। বৈধভাবে জন্মানো ও প্রক্রিয়াজাত করা হলে এটি খাদ্য পণ্যে ব্যবহারের উপযোগী এবং দোকানে বিক্রি করা যায়।

অপর দিকে, যখন এই ফল অপরিপক্ব বা কাঁচা অবস্থায় থাকে, তখন তার কষ থেকে সংগৃহীত উপাদানই মূলত মাদক। ঐতিহ্যগতভাবে, আফিম সংগ্রহ করা হয় যখন বীজের শুটি সবুজ থাকে এবং তাতে প্রচুর কষ জমে। তখনই গাছটিকে চেরা দিয়ে সেই কষ বের করা হয়।


ইতিহাসে পোস্তদানার উল্লেখ

অনেক প্রাচীন সভ্যতার চিকিৎসা শাস্ত্রে পোস্তদানার উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ সালে রচিত মিশরীয় এবার্স প্যাপিরাসে পোস্তদানাকে প্রশান্তিদায়ক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রোঞ্জ যুগের ক্রিট দ্বীপের মিনোয়ান সভ্যতার লোকেরা এই বীজ চাষ করতো এবং দুধ, আফিম ও মধুর মিশ্রণ কান্নাকাটি করা বাচ্চাদের শান্ত করতে ব্যবহার করতো।


পুষ্টিগুণ ও রান্নায় ব্যবহার

পোস্তদানা একটি উচ্চ পুষ্টি উপাদানসমৃদ্ধ মশলা। এতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়ামসহ নানা খনিজ উপাদান।

ভারত, ইরান এবং তুরস্কে পোস্তদানা ‘খাসখাস’ বা ‘হাশাশ’ নামে পরিচিত এবং এটি অত্যন্ত পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হিসেবে বিবেচিত। সাদা পাউরুটির ময়দা মাখানোর সময় এটি মেশানো হয়, এবং গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারী মায়েদের এটি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ভারতীয় রান্নায় সাদা পোস্তদানা খাবারের ঘনত্ব, গঠন ও সুগন্ধের জন্য ব্যবহার করা হয়। কোর্মা বা বিভিন্ন তরকারিতে পোস্তদানার গুঁড়ো, নারিকেল ও অন্যান্য মশলার মিশ্রণ রান্নার শেষের দিকে যোগ করা হয়। বাংলায় (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে) পোস্তো নামে পরিচিত এই বীজের সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ হলো আলু পোস্তো।


স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তা

পোস্তদানা খুবই পুষ্টিকর এবং অন্যান্য বীজ বা বাদামের তুলনায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। অ্যালার্জি বা হাইপারসেনসিটিভিটি খুবই বিরল। তবে যাদের এমন প্রবণতা আছে, তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—কাঁচা বা অপরিশোধিত পপি বীজে সামান্য আফিম-জাত উপাদান থেকে যেতে পারে, যা অতিরিক্ত গ্রহণে ডোপ টেস্টে প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী খাদ্যগ্রেড পোস্তদানা ব্যবহারের আগে ধোয়া ও প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে জব্দ হওয়া পপি বীজ 'Papaver somniferum' প্রজাতির ছিল কিনা, বা খাদ্যগ্রেড কি ছিল — এসব তথ্য এখনো নিশ্চিত করেনি কর্তৃপক্ষ। তাই বিষয়টি নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াসা।


বাংলাদেশে পপি চাষ ও আইন

বাংলাদেশে বৈধভাবে পপি ফুলের চাষ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
১৯৭৪ সালের 'Narcotics Control Act' অনুযায়ী, আফিম উৎপাদন বা পপি চাষকে মাদক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অতীতে কিছু পাহাড়ি অঞ্চলে সীমিতভাবে গোপন চাষের খবর পাওয়া গেলেও বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর নজরদারি রাখে।

তবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যগ্রেড পোস্তদানা আমদানি করা যায়, যেমন ভারত, তুরস্ক বা ইরান থেকে। এই বীজগুলো খাদ্যশিল্পে বা রান্নার মশলা হিসেবে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত।

মূলত সব পপি গাছ মাদক উৎপন্ন করে না। Papaver somniferum নামের নির্দিষ্ট পপি প্রজাতি থেকে পাওয়া কাঁচা কষই আফিম ও অন্যান্য মাদক তৈরির মূল উপাদান। অন্যদিকে, পরিপক্ব ও শুকনো বীজ অর্থাৎ পোস্তদানা মূলত একটি খাদ্য মশলা, যার মধ্যে কার্যকর মাদক উপাদান থাকে না।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ