নির্বাচিত হলে রিভিউ এর ঘোষণা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর
টেলিযোগাযোগ খাতের নতুন নীতিমালা প্রত্যাখান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্টজনদের
দেশীয় বিনিয়োগকারীদের অস্তিত্বহীন করে দেয়, অন্তবর্তী সরকারের আমলে প্রণীত এমত টেলিকম নীতিমালা প্রত্যাখান করার ঘোষণা দিয়েছেন বিশিষ্টজন ও রাজনৈতিক নেতারা। গত ২২ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে টেলিযোগাযোগ টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ(টিআরএনবি) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় তারা এ ঘোষণা দেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় টেলিযোগাযোগ নীতিমালা অত্যন্ত ক্রিটিক্যাল। এ ধরনের নীতিমালা কোনভাবেই দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারবে না, এমন নীতিমালা হওয়া উচিত নয়। আগামীতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে এই টেলিকম-সহ সব নীতিমালা রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) করবে।
'আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের চ্যালেঞ্জ: টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি খাতের দেশিয় এদ্যাক্তাদের ভবিষ্যত' শিরোনামে আয়োজিত এ সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব আব্দুন নূর তুষার, সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল, রাশেদ মেহেদী, শাহেদ আলম, দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বৃহত্তম ট্রান্সমিশন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ফাইবার অ্যাট হোম চেয়ারম্যান মইনুল হক সিদ্দিকী, আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম, টেলিযোগাযোগ খাত নীতি গবেষক আবু নজম তানভীর হোসাইন, এআইওবি সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান ও বাহন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী রাশেদ আমিন বিদ্যুৎ। আলোচনায় মুল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশেষজ্ঞ ও ফাইবার অ্যাট হোমের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুমন আহমেদ সাবির। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন টিআরএনবি সভাপতি সমীর কুমার দে এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারন সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যে কোন বিচারে টেলিকম নীতিমালা ক্রিটিক্যাল। এ কারনে স্টেক হোল্ডারদের মতামত নিয়েই এসব নীতিমালা করতে হবে। গত ১৫ বছরে টেলিযোগাযোগ খাতে যেভাবে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, আইন সংশোধনের নামে বিটিআরসির স্বাধীনতা ধ্বংস করা হয়েছে, সেখানে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার। যে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেশিয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ এবং ডিজিটাল সিকউরিটিকে সুরক্ষা দিতে হবে। যে খাতে এত প্রোফিট, সেখানে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে পারবে না কেন? 'বেস্ট, ফাস্ট অ্যান্ড সিকিউরড' নেটওয়ার্ক তৈরিতে নতুন টেলিকম নীতিমালায় দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের মধ্যে কোনও বৈষম্য রাখা যাবে না, নীতিমালা করার সময় এগুলো মাথায় রাখতে হবে।
তিনি উপস্থিত টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন স্তরের দেশীয় উদ্যেক্তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, টেলিকম সেক্টরকে সুরক্ষা করার দায়িত্ব আগামী দিনে যারা নির্বাচিত হবে, তাদের। অনির্বাচিত সরকার যে নীতিমালা করছে, টেলিকম-সহ সব নীতিমালা নির্বাচিত সরকার অবশ্যই রিভিউ করবে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, জবাবদিহিতা বিহীন নীতিমালা হতে পারে না। নীতিমালার ক্ষেত্রে আজ ও আগামীকালের বাস্তবতা বিবেচনা করে ডিজিটাল সভরেন্টি (সার্বভৌমত্ব) নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। নীতিমালায় ডিজিটাল সিকউরিটিটি কনফার্ম হয় কিনা সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নীতিমালা দরকার। কিন্তু যে নীতিমালা দেখা যাচ্ছে সেখানে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের ব্যবসা দেশীয় কোম্পানির হাতে যাতে না থাকে, বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে যায়- এমন নীতিমালা করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বন্দরের ক্ষেত্রেও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতে দেশীয় উদ্যেক্তাদের বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করবে, খাতের ৫-৭ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে, এমন নীতিমালা গ্রহনযোগ্য নয়, এটা প্রত্যাখান করা হচ্ছে।
বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ডা. আবদুন নূর তুষার বলেন, যদি ব্যবসায় বৈষম্য দূর করা না যায় তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এসে ব্যবসা করবে। কিন্তু আমাদের দেশীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসার সুযোগ রাখতে হবে। আমাদের ব্যবসায়ীদের স্বাধীন রাখার চেষ্টা করেন।
সাংবাদিক মাসুদ কামাল বলেন, জবাবদিহিতা বিহীন একটি সরকারের কাছেই মানুষ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। এই অবস্থাটাই এখন বাংলাদেশে চলছে। এ সরকারের কারও কাছে কোন জবাবদিহিতা নাই। তাদের যা খুশি তাই করছেন। ফলে আগামীতে যে নির্বাচিত সরকার আসছে তাদের জন্যও এই অন্তবর্তী সরকারের আমলে খেয়াল-খুশি মত তৈরি করা এমন অনেক নীতিমালা বড় ধরনের বোঝা হয়ে যাবে।
সাংবাদিক রাশেদ মেহেদী বলেন, এখন একটি দূরদর্শী নীতিমালা দরকার, যেটি আগামী দিনে তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত রূপান্তরের সঙ্গে দেশকে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করবে। আগামী দিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আইওটি,’র প্রযুক্তির বিপুল বিকাশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজস্ব ক্লাউড, নিজস্ব ডিজিটাল প্লাটফর্ম স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের ডাটা প্রবাহের সক্ষমতা না বাড়লে টিকে থাকা মুশকিল হবে। কিন্তু এখন যে নীতিমালা হয়েছে তা বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় বিদেশী কিছু কোম্পানির হাতে জিম্মি করবে। টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে জাতীয় নিরাপত্তা এবং রাজস্ব আদায় দুটোই বিদেশী কোম্পানির কাছে কুক্ষিগত হয়ে পড়বে।
সাংবাদিক শাহেদ আলম বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ খুব দ্রুত হচ্ছে। আগে ভিডিও কল চিন্তাই করা যেত না। এখন ভিডিও কল খুব সাধারন ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। এখন নীতিমালা হওয়া উচিত কিভাবে তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা সাধারন মানুষের কাছে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে দেশীয় উদ্যেক্তাদের স্বার্থ রক্ষা করেই বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে।
ফাইবার অ্যাট হোমের চেয়ারম্যান মইনুল হক সিদ্দিকী বলেন, টেলিযোগাযোগ খাতের দেশীয় ট্রান্সমিশন কোম্পানিগুলো প্রায় দুই লাখ কিলোমিটার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। ঢাকার সঙ্গে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের ইন্টারনেট স্পিডে সমতা এনেছে। আপনারা গ্রামে গেলে এর প্রমাণ পাবেন। দেশীয় কোম্পানিগুলো ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপন করার আগে ইন্টারনেট সুবিধা ঢাকাসহ কয়েকটি শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো দেশজুড়ে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার পর এখন উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড এবং মোবাইল ইন্টারনেট দুটোই শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সব মানুষের কাছে সহজলভ্য ও সুলভ হয়েছে। এর প্রমাণ চোখের সামনেই আছে। অথচ টেলিকম নীতিমালায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হচ্ছে না। বরং এ নীতিমালা আবারও ইন্টারনেটের দাম বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি এ খাতে কর্মসংস্থান কমে যাওয়ারও বড় উদ্বেগ তৈরি করেছে।
ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবি সভাপতি আমিনুল হাকিম বলেন, গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত আমাদের আইএসপিরা সেবা দেয়। এই খাতে আড়াই হাজার ব্যবসায়ী, আমাদের সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। টেলিকম নীতিমালার বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক দল সংবাদ সম্মেলন করেছিল- আমরা আশাবাদী যে সরকার নীতিমালা বাতিল করবে। কিন্তু করা হয়নি। আপনারা (বিএনপি) আগামীতে সরকার গঠন করবেন, মানুষ মেরে ফেলার পলিসির বিষয়ে আপনারা ভাববেন বলে আমরা আশা করি।
টেলিযোগাযোগ নীতি বিশেষজ্ঞ আবু নজম তানভীর হোসাইন বলেন, কোন জাতীয় নীতিমালা এত তড়িঘড়ি করে তৈরি করা যায় না। আজকের অবস্থা কি, আগামীকাল কি করতে হবে, কিভাবে দেশীয় বিনিয়োগ ও সক্ষমতা বাড়ানো যাবে, যেখানে বিদেশী বিনিয়োগ প্রয়োজন সেখানে কোন ধরনের নীতি সুবিধার মাধ্যমে তা আকর্ষণ করা হবে, এসব বিষয় ভাবতে হয়। কিন্তু তড়িঘড়ি করে একের পর এক নীতিমালা হলে যুক্তিসঙ্গতভাবেই সেটা একটা ভাল নীতিমালা হয়না, একই সঙ্গে গ্রহনযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে