Views Bangladesh Logo

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের রাজনৈতিক গুরুত্ব কী?

Amin Al  Rasheed

আমীন আল রশীদ

প্রায় দেড় যুগ পরে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে একজন রাজনৈতিক নেতা তো বটেই, যেকোনো সাধারণ মানুষেরও যে অনুভূতি হয়, তাতে জুতা মোজা খুলে খালি পায়ে মাটিতে হাঁটা, মাটির ঘ্রাণ নেয়া অস্বাভাবিক কোনো দৃশ্য নয়। সুতরাং, ১৭ বছর লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে নেমে তারেক রহমানের খালি পায়ে হাঁটার দৃশ্যটি মানুষেকে যতটা না আপ্লুত করেছে, তার চেয়ে বেশি দৃষ্টি কেড়েছে তিনশো ফুট এলাকায় সংবর্ধনা মঞ্চে বিশেষ চেয়ার সরিয়ে সাধারণ চেয়ারে বসা এবং ১৬ মিনিটের বক্তৃতায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে কোনো নেতিবচক মন্তব্য না করা, বিষোদ্গার না করা, আমিত্বের অহমিকা না দেখানো এবং মানুষকে আকাশকুসুম স্বপ্ন না দেখানো। সেইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত নাগরিক অধিকার নেতা, ধর্মযাজক ও অহিংস আন্দোলনের প্রতীক মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’-এর অনুকরণে ‘আই হ্যাভ অ্যা প্ল্যান’ (আমার একটি পরিকল্পনা আছে) বলার মধ্য দিয়ে তারেক রহমান যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বক্তৃতায় বাক্য ও শব্দচয়নে মিতব্যয়িতা প্রদর্শন করলেন, সেটি তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে হয়তো কিছুটা হলেও সহায়ক হবে।


দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পরে দেশে আসা একজন রাজনীতিবিদের কণ্ঠে যে অতিরিক্ত আবেগ কিংবা চোখে যে অশ্রু থাকবার কথা ছিল, বক্তৃতায় সেই আবেগও সংবরণ করেছেন তারেক রহমান। এই ছোটখাটো ঘটনাগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি হয়তো একটা নতুন ধরনের রাজনীতির বার্তা দিলেন। তবে আগামী দিনের রাজনীতিতে সত্যিই তিনি কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবেন, সেটি সময়ই বলে দেবে। তবে এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, এই মুহূর্তে তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু বিএনপির জন্য নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতার জন্যও জরুরি।


তারেক রহমান তার নাতিদীর্ঘ ভাষণে বলেন, ‘আজ বাংলাদেশের মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। বাংলাদেশের মানুষ চায়–তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী ন্যায্য অধিকার পাবে। প্রিয় ভাই-বোনেরা, আজ আমাদের সময় এসেছে সবাই মিলে দেশ গড়ার। এই দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছে এই দেশে একইভাবে সমতলের মানুষ আছে। এই দেশে মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। আমরা চাই সবাই মিলে এমন একটি বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যেই বাংলাদেশের স্বপ্ন একজন মা দেখেন।’ তারেক রহমানের ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ: ‘যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে এই দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। যেকোনো উসকানির মুখে আমাদেরকে ধীর-শান্ত থাকতে হবে।’


নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কারা সরকার গঠন করবে, তার চেয়ে জরুরি প্রশ্ন দেশ যে একটা অস্থিরতা ও অশান্তির ভেতর দিচ্ছে, তার অবসান হবে কী করে? এই প্রশ্নের ভেতরেই তারেক রহমানের ফিরে আসার গুরুত্ব নিহিত রয়েছে। কেননা, অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের গত প্রায় দেড় বছর ধরে দেশ যেরকম বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে; যেখানে একের পর এক মবসন্ত্রাস যেভাবে দেশকে অনিরাপদ করে তুলেছে; যেভাবে উগ্রপন্থীদের আস্ফালন বেড়েছে এবং ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বানচাল করার নানাবিধ উদ্যোগ ও ষড়যন্ত্র যেভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে, তাতে অনেকেই এটা বিশ্বাস করেন যে, তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে অনেকগুলো অশুভ শক্তি হয়তো দুর্বল হয়ে যাবে।


বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যেহেতু শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে অনুপস্থিত, ফলে দেশে থেকে সরাসরি দলের নির্বাচনি নেতৃত্ব কে দেবেন, এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছিলো। সেই বাস্তবতায় তারেক রহমানের দেশে ফেরা বিএনপির জন্যও হাফ ছেড়ে বাঁচা। বিএনপি এখন আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে নির্বাচনি লড়াইয়ে যেমন থাকতে পারবে, তেমনি প্রয়োজন হলে নির্বাচন বানচালকারী অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। এসব বিবেচনায় নিয়েই তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনকে ‘রাজনীতিতে নতুন আশার সঞ্চার’ বলে অভিহিত করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।


তবে তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তনকে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, তারেক রহমান তার একটি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। তার পরিকল্পনা শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না থেকে কীভাবে বাস্তবায়িত হয়, সেটিও পর্যবেক্ষণে রাখবেন তারা। শফিকুর রহমান বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঐক্যের ব্যাপারে তারেক রহমান কী ভূমিকা রাখেন, অথবা কী পরিকল্পনা আছে তার এবং বাস্তবায়ন কীভাবে করবেন এসব বিষয়ে জামায়াত নজর রাখবে।


তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে স্ট্যাটাস দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম লিখেছেন: ‘একজন বাংলাদেশি নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতার নিজ ভূমিতে ফেরার এই অধিকারটি পুনরুদ্ধার হওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক লড়াইয়েরই একটি ইতিবাচক প্রতিফলন।’ তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন দেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চাকে আরও সুসংহত করবে বলেও বিশ্বাস করেন নাহিদ ইসলাম। লিখেছেন, নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় সহাবস্থান এবং সুস্থ প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলাই এখন আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছিল। বিশেষ করে বিএনপির মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল সরাসরি নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত ছিল। তারেক রহমানের আগমনে সেই শূন্যতা অনেকটাই পূরণ হবে বলে তিনি মনে করেন।


তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের তাৎপর্য নিয়ে একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা। সেখানে বলা হয়েছে, তারেক রহমান যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন, সেখানে সবার দৃষ্টি এখন ভারতের সাথে তার সম্পর্কের সমীকরণ কী হবে সেদিকে। কেননা বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ঐতিহাসিকভাবে ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। প্রতিবেশী ভারত বরাবরই আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে, যেখানে বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল শীতল। তবে বৈরিতাপূর্ণ নয়।


দিল্লির পক্ষ থেকে অতীতে বিএনপি সরকারের সঙ্গে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করা হলেও বিএনপি বরাবরই বলে এসেছে, তারা সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক চায়, তবে তারা ভারত-বিরোধী নয়। বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির সাথে জামায়াতের জোট আর রাজনৈতিক চাপে ভারতের সাথে বিএনপির সম্পর্ক গতি হারিয়েছে। তবে এবার জামায়াত থেকে বিএনপির আলাদা হওয়ায় ভারতের সাথে সম্পর্কের সেই শীতলতা কাটতে পারে। বাংলাদেশে যখন কয়েকটি রাজনৈতিক দল ভারতের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে বিএনপি বেশ ভারসাম্য বজায় রেখেছে। যদিও তারেক রহমান সবার আগে বাংলাদেশকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।


আল জাজিরার বিশ্লেষণ বলছে, বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তারেক রহমানকেই এগিয়ে রাখা হয়েছে। তার প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা খানিকটা হলেও শান্ত করবে। গতি ফিরবে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায়।


তারেক রহমানের এই প্রত্যাবর্তন মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মনোবল বাড়াবে এবং দলের ঐক্য সুসংহত করবে বলে মনে করা হয়। সেইসাথে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে গতি আসবে, দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব সংকট ও দ্বৈততা অনেকটাই কাটতে পারে। বিএনপির রাজনীতিতে তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি মানে হলো দল আবারও একটি কেন্দ্রীয় ও একক নেতৃত্বের অধীনে সক্রিয়ভাবে রাজপথ ও নির্বাচনী রাজনীতিতে ফিরছে।


তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন সরাসরি আগামী জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা বিএনপির অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি আরও জোরালো ও সংগঠিত হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচন প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে নতুন মাত্রা যোগ হবে। সরকার ও প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ বাড়তে পারে।
বস্তুত তারেক রহমান কেবল অতীতের উত্তরাধিকার নন; তিনি বিএনপির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতীকও। তার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে তরুণ ও মধ্যবয়সী নেতৃত্বকে সামনে আনার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পরদিন সমকালের একটি সংবাদ শিরোনাম: ‘উনি আইছেন, এখন দেশটা ঠান্ডা হইয়া যাইব’। তিনশো ফুট এলাকায় তারেক রহমানের সংবর্ধনায় আসা মোজাক্কের হোসেন এক লোক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সোজাসাপটা উত্তর দেন: ‘উনি আইছেন, এখন দেখবেন দেশটা ঠান্ডা হইয়া যাইব।’
তারেক রহমানও তার বক্তব্যে বারবার দেশে শান্তি ফেরানো এবং উগ্রবাদে উসকানির বিরুদ্ধে ধীর ও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। সত্যিই তার এই প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশটা যদি ‘ঠান্ডা হইয়া’ যায় তাহলে একজন রাজনীতিবিদের জন্য এর চেয়ে বড় কোনো সাফল্য আর হতে পারে না। আর এই সাফল্যে ভর করেই তারেক রহমান হয়তো হয়ে উঠবেন আগামীর রাষ্ট্রনায়ক।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ