Views Bangladesh Logo

বিটিআরসিকে বেকায়দায় ফেলে ৮০০ কোটি টাকার ‘ফন্দি’

বিনামূল্যে নেয়া স্পেকট্রাম ‘কৌশলে’ আটকে রেখে ৮০০ কোটি টাকা নেয়ার পাঁয়তারা করছে এক আইএসপি। ২০০৭ সালে বিনামূল্যে যে স্পেকট্রাম নিয়েছিল অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক নামে ওই আইএসপি, সে স্পেকট্রাম ছেড়ে দিতে এখন ৮০০ কোটি টাকা চাইছে তারা। দেশে ডিজিটাল বিভাজন দূর করা, গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির মোবাইল ব্রডব্যান্ড সেবা পৌঁছানো, ভবিষ্যতে ৫জির প্রয়োজনীয়তা, সরকারের বিপুল রাজস্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটে ৭০০ ব্যান্ডের ওই স্পেকট্রাম এখন রাষ্ট্রীয় স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। বিটিআরসি প্রায় ১ যুগ আগে ওই আইএসপিকে বিকল্প ৫ গিগাহার্জ ব্যান্ড হতে প্রয়োজনীয় স্পেকট্রাম নেয়ার প্রস্তাবও দেয়; কিন্তু তারা তা শোনেনি।

রাষ্ট্রীয় স্বার্থে বিটিআরসি ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর আইএসপিটির ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ওই স্পেকট্রাম বরাদ্দ বাতিলও করে দেয়। আইএসপিটি স্পেকট্রাম বরাদ্দ বাতিলের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন করে। ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বিটিআরসি ওই মামলায় হেরে যায়। এরপর আপিল করে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। বিটিআরসি বলছে, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই স্পেকট্রাম পুনর্বিন্যাস একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশেও এর দৃষ্টান্ত রয়েছে- যেমন ২০২০ সালে অনেক আইএসপি থেকে স্পেকট্রাম ফিরিয়ে নিয়ে ৫জি সেবার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়।

নিয়ন্ত্রণ সংস্থাটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘এই আইএসপির কোনো রেডিও নেটওয়ার্ক নেই। কোনো গ্রাহক নেই। ৭০০ মেগাহার্জ ব্যান্ডে আইএসপি সেবার জন্য বিশ্ববাজারে এখন আর কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় না। ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিশ্ব রেডিও কমিউনিকেশন কনফারেন্স (ডব্লিউআরসি-২০০৭) এ এই স্পেকট্রাম আইএমটির জন্য নির্ধারণ করা হয় এবং পরে এশিয়া-প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি (এপিটি) ব্যান্ডটির পরিকল্পনা তৈরি করে। বিটিআরসি বলছে, আইএসপিটি আইটিইউ নীতির ভুল ব্যাখ্যা করছে। আইটিইউর নীতিতে বিদ্যমান ব্যবহারকারীর অধিকার অক্ষুণ্ন রাখা বাধ্যতামূলক; কিন্তু এটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্পেকট্রাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, জাতীয় পর্যায়ের স্পেকট্রাম পুনর্বিন্যাসে নয়।

বছরের পর বছর যায়, শুনানি হয় না
টেলিযোগাযোগ বিভাগ ও বিটিআরসি বলছে, অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক নামের আইএসপির সঙ্গে বিটিআরসির চলমান ওই মামলার শুনানি ‘অদৃশ্য’ কোনো কারণে বারবার পিছিয়ে যায়। তারা জানান, শুরুর দিকে এই মামলা তালিকায় ছিল ৩৫ নম্বরে, সেবার শুনানি হলো ২৯ পর্যন্ত। এরপর তালিকায় মামলাটি পিছিয়ে হলো ৪৫, যা শুনানি পর্যন্ত আসেনি। তারপর চলে গেল ৬৫ নম্বরে, এরপর ১০০ ছাড়িয়ে ২০০তে। এক পর্যায়ে তা তালিকার বাইরেই চলে গেল। চলতি বছরের এপ্রিলের দিকেও তালিকা এক হতে ৪০-এর মধ্যে ওঠানামা করে কিন্তু শুনানি আর হয় না।

বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. এমদাদ উল বারী (অব.) বলেন, ‘অদৃশ্য’ এক কারণে এই মামলার শুনানি বারবার পিছিয়ে যায়। বিষয়টি অদ্ভুত। ‘এটি নিয়ে তিনি নিজে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে আলাপ করেছেন, যেন দ্রুত শুনানি করা যায়।’ উল্লেখ করেন তিনি। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘কে বা কারা বারবার এই শুনানি পিছিয়ে দিচ্ছে।’ অথচ আরও প্রায় চার মাস আগে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। তখন আলাপ করেছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হকের সঙ্গেও। সর্বশেষে গত সপ্তাহেও তিনি এই শুনানি নিয়ে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ পর্যায়ে কথা বলেছেন বলে জানান তিনি।

বিটিআরসির কাছে ৮০০ কোটি টাকার দফারফার প্রস্তাব
অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক ২০২০ সালের অক্টোবরে তাদের এই স্পেকট্রাম বাতিলের জন্য বিটিআরসির কাছে ৮০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে চিঠি দেয়। বিটিআরসি আইএসপির ওমন কাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৪ সালে তাদের স্পেকট্রাম বাতিলের সময় যদি তাদের নেটওয়ার্ক যন্ত্রপাতি বা সেবা থাকেও তার জন্য প্রতিষ্ঠানটির ক্যাটাগরি অনুযায়ী’ ৮০০ কোটি ক্ষতিপূরণ’- এটা অবিশ্বাস্য। ‘যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য তো বিটিআরসির কাছ হতেই ছাড়পত্র নিতে হয়, বিটিএস বসানো কিংবা সেবা সবকিছুর জন্যই বিটিআরসির অনুমোদন লাগে’ তাদের তো প্রমাণ করতে হবে যে, তারা কি কি যন্ত্রপাতি এনেছেন, কী সেবা দিচ্ছিলেন, তারা সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন,’ বলছিলেন বিটিআরসির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা।

জটিলতা যেভাবে
২০০৭ সালে ২১ মার্চে অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেড আইএসপিকে ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ৭০৪-৭১০ ও ৭৩৪-৭৪০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। ওই সময় এই ব্যান্ডে আইএমটি (ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন) এর জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকম ইউনিয়নের (আইটিইউ) কোনো পরিকল্পনা দেয়া ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কমিউনিকেশন কমিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ককে ওই বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল।

এরপর ২০০৭ সালের নভেম্বরে বিশ্ব রেডিও কমিউনিকেশন কনফারেন্স (ডব্লিউআরসি-২০০৭) এ এই স্পেকট্রাম আইএমটির জন্য নির্ধারণ করা হয় এবং পরে এশিয়া-প্যাসিফিক টেলিকমিউনিটি (এপিটি) ব্যান্ডটির পরিকল্পনা তৈরি করে। সেখানে দেখা যায়, অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ককে দেয়া ৭০৪-৭১০ ও ৭৩৪-৭৪০ স্পেকট্রাম এমন অবস্থানে রয়েছে, যা আইটিইউর পরিকল্পনার ৭০৩-৭৪৮ ও ৭৫৮-৮০৩ এর ৭০৩-৭৪৮ এর মাঝখানে পড়েছে। এখন মোবাইল ফোন অপারেটরদের দাবি অনুযায়ী পুরো ৪৫ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম নিয়ে এই ব্যান্ডে নিলাম করতে গেলে এই আইএসপির কারণে আটকা ২০ মেগাহার্টজও লাগবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ