Views Bangladesh Logo

পুরোনো পরিবহন সিন্ডিকেটের অন্যায্য দাবি আমলে নেয়া সমীচীন হবে না

জুলাই অভ্যুত্থানের সূতিকাগার ছিল ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। রাজধানীতে দুইজন স্কুল শিক্ষার্থী বাসচাপায় নিহত হলে এই আন্দোলন শুরু হয় রাজধানীজুড়ে। সে সময়ের জাবালে নূর পরিবহন (বর্তমানে পরিস্থান পরিবহন) কোম্পানির দুই বাস পাল্লা দেয়ার সময় বিমান বন্দর সড়কের স্টাফরোড এলাকার ফুটপাতে উঠে যায় একটি বাস। এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত হন আর আহত হন আরও কয়েকজন। এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর সে সময়ের মন্ত্রী এবং পরিবহন খাতের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শাজাহান খানকে দুর্ঘটনার বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি হাসিমুখে জবাব দেন, ‘দুর্ঘটনা তো দুর্ঘটনাই’। দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মৃত্যু নিয়ে মন্ত্রী শাজাহান খানের তাচ্ছিল্যের কারণেই ফুঁসে ওঠেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজধানীর সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছিল। ছাত্রলীগের কুখ্যাত হেলমেট বাহিনী, পরিবহন খাতের সন্ত্রাসী গ্রুপের ক্যাডার এবং পুলিশ নির্মমভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিল স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের। সে সময় থেকেই মূলত শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হতে থাকেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। সেই সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন দমন করেই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকার সেই সময়ের স্কুল-কলেজ প্রজন্মের কাছে শত্রুতে পরিণত হন। একজন চরম বিতর্কিত পরিবহন নেতার দায়িত্ব নিতে গিয়ে পুরো আওয়ামী লীগকে একটি প্রজন্মের শত্রুতে পরিণত করেন শেখ হাসিনা। তারই চূড়ান্ত পরিণতি ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান।


তবে ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন দমনের পর নাগরিক সমাজের তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার শেষপর্যন্ত সড়ক পরিবহন আইনে কিছু সংস্কার নিয়ে আসতে বাধ্য হয়। যার ফলে সড়কে বেপরোয়া বাস-ট্রাক চালকদের চরম অরাজকতার লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরা সম্ভব হয়।

অতএব, ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের ফল হিসেবে সড়ক পরিবহন আইনে যে সংস্কার সেটাকে ‘ফ্যাসিস্ট সরকার প্রণীত’ আইন বলে উড়িয়ে দিয়ে বাতিলের যে দাবি তা বছরের পর বছর পরিবহন খাত জিম্মি করে রাখা সিন্ডিকেটের পরিবহন খাতে দুর্ঘটনা, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রাখার অপচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমরা দেখেছি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত খন্দকার এনায়েত উল্ল্যা ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব ছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর সাইফুল ইসলাম এনায়েত উল্ল্যার স্থলাভিষিক্ত হন। ২০০৯ সালে আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও এনায়েত উল্ল্যা আগের পদে ফিরে আসেন। ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর সাইফুল ইসলাম আবার এনায়েত উল্ল্যার স্থলাভিষিক্ত হন। অতএব, গত প্রায় দুই যুগ ধরে দেশের পরিবহন সিন্ডিকেট কীভাবে চলছে এবং কারা চালাচ্ছে তা বোঝা যায়।

২০১৮ সালে খন্দকার এনায়েত উল্ল্যা সড়ক পরিবহন আইন সংস্কারের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। সরকারকে হুমকি দিয়েছিলেন। মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নামে ধর্মঘট ডেকে জনজীবনকে জিম্মি করেছিলেন। ২০১৮ সালের সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের পর শাজাহান খান মন্ত্রিত্ব হারান। তবে তিনি খন্দকার এনায়েত উল্ল্যার সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা রোধে কঠোর আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করেন। তার দাবি ছিল দুর্ঘটনার জন্য চালক দায়ী হলেও তাকে সরাসরি দায়ী করা যাবে না, মামলা জামিনযোগ্য হতে হবে, দুর্ঘটনাকবলিত গাড়ি পুলিশ হেফাজতে না নিয়ে মালিকের কাছে দিয়ে দিতে হবে। নাগরিক সমাজ থেকে চালকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান, নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম পরার দাবি উঠলেও শাজাহান খান তা সরাসরি নাকচ করে দেন।

আজ সাইফুল ইসলামের কণ্ঠেও একই দাবি। একইভাবে পরিবহন ধর্মঘট ডেকে জনজীবন জিম্মি করে অন্যায্য দাবি আদায়ে শক্তি প্রদর্শন। দুর্ঘটনার কারণ বিবেচনায় চালকের বিরুদ্ধে মামলা হবে। এখন দুই বাসচালক রাস্তায় মরণরেস দিতে গিয়ে বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটালে সেটা অবশ্যই হত্যাকাণ্ডের পর্যায়ে পড়ে। এই বাসচালকের বিরুদ্ধে মামলা জামিনযোগ্য হতে পারে না।

বাংলাদেশে অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চালকদের বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের কারণে। সড়ক পরিবহন নিয়ে এ যাবৎকালে সংঘটিত সব ধরনের গবেষণায়ই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের বিষয়টি উঠে এসেছে; কিন্তু পরিবহন সিন্ডিকেট উল্টো সড়কে এই বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের স্বাধীনতাই চায়। কারণ ৯৫ শতাংশ বাস মালিক মাসিক বেতনে নিয়োগপত্র দিয়ে বাসচালক, চালকের সহকারী রাখেন না। তারা বাস চালান প্রতি ট্রিপ চুক্তি ভিত্তিতে। যত বেশি ট্রিপ তত আয়। ফলে দূরপাল্লার রুটে একজন চালক সপ্তাহে সাধারণভাবে ১০টি ট্রিপ দেয়ার কথা থাকলেও ওই চালককে দিয়ে ১৫ থেকে ২০টি ট্রিপ আদায় করা হয়। আর রাজধানীর সিটি সার্ভিসে মালিকরা আগাম জমার টাকা নিয়ে গাড়ি চালক-হেল্পারের হাতে তুলে দেন। সারাদিন রাস্তায় মরণরেস চলে জমার টাকা তুলে বাড়তি কিছু আয়ের জন্য। নিয়োগপত্র না দিয়ে গণপরিবহনে চালকদের অমানবিকভাবে পরিশ্রম করিয়ে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফার স্বার্থেই ২০১৮ সালের আইনের বিরোধিতা করছে পরিবহন সিন্ডিকেট, কোনো সন্দেহ নেই। কারণ আইন অনুযায়ী, নিয়ম মেনে গাড়ি চললে অধিক মুনাফা হয় না। অতিরিক্ত আয় না হলে মালিকরা সিন্ডিকেটকে চাঁদা দিতেও গড়িমসি করেন। এই সিন্ডিকেটে শুধু পরিবহন নেতা নামধারীরা নন, বরং সরকারি প্রশাসনের একটি দুর্নীতিবাজ অংশও সক্রিয়ভাবে জড়িত, সেটা এক অর্থে ওপেন সিক্রেট। এ সরকার বদলালেও পরিবহনের এই সিন্ডিকেট ভাঙে না, সিন্ডিকেটের চালকের আসনের ব্যক্তি বদল হয় মাত্র।

এই সিন্ডিকেটের নেতারা কখনই একজন চালকের জন্য নিয়োগপত্র, প্রশিক্ষণ, উন্নত জীবন চায় না। তাদের দাবিতে কখনই শ্রমিকদের জীবন মানোন্নয়নে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি থাকে না। তারা শ্রমিকদের মানবেতর জীবনে রেখে নিজেদের অবৈধ আয়ের পথকে সুরক্ষিত চায়। এ কারণেই তারা সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দুর্বল আইন চায়, যে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পরিবহন খাত তারা জিম্মি করতে পারবে, নিজেদের অবৈধ আয়ের পথ চালু রাখতে পারবে।

বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যত মৃত্যু হয়, সেটা অনেক যুদ্ধের চেয়েও বেশি। পঙ্গু হয় অসংখ্য মানুষ। এখন পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিকার পায় না। এ অবস্থায় বহু বছর ধরে চেপে বসা পরিবহন সিন্ডিকেটের অন্যায্য দাবি আমলে নেয়া সরকারের জন্য কোনোভাবেই সমীচীন হবে না বরং সড়ক ব্যবস্থাপনাকে সুশৃঙ্খল করতে আরও বেশি সুসংহত আইনি কাঠামো তৈরিতেও সরকারের নজর দেয়া উচিত।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ