Views Bangladesh Logo

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ষষ্ঠ সাংবাদিক নিহত, কান্না-স্লোগানে ফিলিস্তিনিদের শেষ বিদায়

সরায়েলি বিমান হামলায় কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার পাঁচজন সংবাদকর্মীর সাথে নিহত হয়েছেন আরও একজন সাংবাদিক। মারা যাওয়া ষষ্ঠ সাংবাদিক সাহাত নিউজলেটে কর্মরত মোহাম্মদ আল-খালদি একটি ইউটিউব নিউজ চ্যানেলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

এদিকে গাজা উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে শেখ রাদওয়ান কবরস্থানে কান্নাজড়িত অন্তিম সম্মান ও বিক্ষুব্ধ স্লোগানে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত সাংবাদিকদের শেষ বিদায় জানিয়েছেন বহু সাংবাদিকসহ বিশাল জনতা।

রয়টার্স জানিয়েছে, গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে সাংবাদিকদের তাঁবুতে স্থানীয় সময় রোববার (১০ আগস্ট) সন্ধ্যার বোমা হামলায় নিহত মোট সাতজনের মধ্যে ছিলেন আল-খালদিও। সাংবাদিকদের অধিকার সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স  জানিয়েছে, তিনিও সহকর্মীদের সঙ্গে গাজা যুদ্ধ কাভার করে আসছিলেন।

গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের বরাতে তুরস্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু জানায়, ফিলিস্তিনি সাংবাদিক মোহাম্মদ আল-খালদি ইসরায়েলি বোমার আঘাতে হামলায় আহত হয়ে পরে হাসপাতালে মারা গেছেন।

হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত ২৮ বছর বয়সী আনাস আল শরীফ ছিলেন আল-জাজিরা আরবির পরিচিত মুখ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলি হামলা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবেদন করছিলেন। নিহত অন্য সংবাদকর্মীদের মধ্যে রয়েছেন আল-জাজিরার সংবাদদাতা মোহাম্মদ কুরেইকেহ, ক্যামেরা অপারেটর ইব্রাহিম জাহের ও মোয়ামেন আলিওয়া এবং তাদের সহকারী মোহাম্মদ নওফাল।

গাজা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েল এ নিয়ে ২৭০ জন সাংবাদিক ও মিডিয়াকর্মীকে হত্যা করেছে। তবে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও সুরক্ষায় কাজ করা কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) পরিসংখ্যান অনুসারে, নিহত ২৩৮ জন সংবাদকর্মীর মধ্যে কমপক্ষে ১৮৬ জনই সাংবাদিক।

রাতেই জানাজা শেষে শেখ রাদওয়ান কবরস্থানে দাফন করা হয় আগে নিহত আল জাজিরার পাঁচ কর্মীকে। জানাজাসহ তাদের কফিন নিয়ে শোক মিছিলে যোগ দেন বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য গাজাবাসী। তারা চোখের পানি মুছতে মুছতে একে অন্যকে আলিঙ্গন করে সান্ত্বনা দেন।

অনলাইনে শেয়ার করা মিছিলের ফুটেজে সাংবাদিকদের হত্যার নিন্দা জানিয়ে স্লোগান দিতে দেখা গেছে শোকাহতদের। নিহতদের সম্মান জানিয়ে ‘প্রেস’ ফ্ল্যাক জ্যাকেট উঁচিয়ে ধরেছিলেন অন্য একজন।

আল-জাজিরা ও আন্দোলুসহ আন্তর্জাতিক প্রায় সব গণমাধ্যম বলছে, গাজায় অন্যতম সাহসী সাংবাদিক শরীফ ও তার সহকর্মীদের হত্যার নির্দেশ উপত্যকাটি দখল ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বরকে নীরব করার মরিয়া প্রচেষ্টা। গাজায় চলমান গণহত্যার প্রমাণ মুছতে সংবাদকর্মীদের ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানোর অভিযোগও তুলেছে তারা।

এটি বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সব প্রাসঙ্গিক সংস্থাকে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে আল-জাজিরা। সিপিজে ও ফিলিস্তিনের জাতীয় প্রেসক্লাব ঘটনাটির তদন্ত ও জবাবদিহিতার আহ্বান জানিয়েছে এবং মিডিয়ার ওপর আরও আক্রমণ বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন করেছে ফ্রিডম অফ দ্য প্রেস ফাউন্ডেশনও।

ইসরায়েলি হামলায় নিজেদের পাঁচজন সংবাদকর্মীর একসঙ্গে নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে আল-জাজিরা আরও বলেছে, এটি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আরেকটি নগ্ন ও পূর্বপরিকল্পিত হামলা।

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার ভয়াবহ পরিণতির মধ্যেই এই আক্রমণ চালানো হয়েছে। গাজায় বেসামরিক মানুষদের অবিরাম ও নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। জোর করে অনাহারে রাখা হচ্ছে। পুরো সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে’।

শরীফ ও তার সহকর্মীদের ওপর ইসরায়েলি হামলার সময় ঘটনাস্থল থেকে মাত্র এক ব্লক দূরে ছিলেন আল-জাজিরা ইংরেজির সংবাদদাতা হানি মাহমুদ। তিনি বলেন, গত ২২ মাসের যুদ্ধে সহকর্মী শরীফের মৃত্যুর খবর প্রচার করা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ।

হানি মাহমুদ বলেন, ‘গাজার ফিলিস্তিনিদের অনাহার, অপুষ্টি ও দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি নিয়ে নিরলসভাবে প্রতিবেদন করায় সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে। এ অপরাধের সত্যতা সবার সামনে তুলে ধরে দখলদার ইসরায়েলের টার্গেটে পরিণত হচ্ছেন তারা’।

অন্যদিকে শরীফকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার কথা নিশ্চিত করে বিবৃতি দিয়েছে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ)। তাদের দাবি, হামাসের একটি সেলের প্রধান ছিলেন শরীফ। ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক ও সেনাদের ওপর রকেট হামলা পরিচালনায় জড়িত ছিলেন তিনি। আইডিএফের দাবি, তাদের কাছে ফিলিস্তিনি সংগঠনটির সঙ্গে শরীফের সম্পৃক্ততার সন্দেহাতীত প্রমাণ সম্বলিত নথি রয়েছে।

তবে মানবাধিকার সংস্থা ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের বিশ্লেষক মুহাম্মদ শেহাদা বলেন, ‘শরীফের সহিংস কার্যক্রেমে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করাই ছিল তার প্রতিদিনের রুটিন’।

ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসও আল জাজিরার সাংবাদিকদের হত্যার নিন্দা জানিয়ে একে ‘ফ্যাঁসিবাদ ও অপরাধের সব সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া নৃশংস অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে।

হামাস গাজা উপত্যকায় সাংবাদিকদের ইসরায়েলের ক্রমাগত লক্ষ্যবস্তু করাকে ‘আন্তর্জাতিক মূল্যবোধ ও আইনের সম্পূর্ণ পতনের ইঙ্গিতও’ বলে মনে করে। গাজার সরকারে থাকা গোষ্ঠিটির দাবি, আন্তর্জাতিক নীরবতায় ইসরায়েলি দখলদারিত্ব কোনও বাধা বা জবাবদিহিতা ছাড়াই সাংবাদিকদের হত্যা চালিয়ে যেতে উৎসাহিত করেছে’।

এটিকে গাজা সিটিকে সম্পূর্ণরূপে দখল করার ইসরায়েলি পরিকল্পনার একটি পূর্বসূরী ঘটনা বলে মন্তব্য করে গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেছেন, পরিকল্পিত ‘গণহত্যা’ লুকাতে সাংবাদিকদের হত্যা করছে ইসরায়েল।

তিনি আনাদোলু সংবাদ সংস্থাকে বলেন, ‘ইসরায়েল তাদের নৃশংসতার কভারেজ রোধে আল জাজিরার সাংবাদিকদের হত্যা করেছে। দখলদার বাহিনীটি গাজায় বড় গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা গাজা শহরের সর্বাধিক সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করতে চায়, কিন্তু এবার আনাস, মোহাম্মদ, আল জাজিরা এবং সমস্ত স্যাটেলাইট চ্যানেলের কণ্ঠস্বরের অনুপস্থিতিতে বা কোনো শব্দ বা চিত্র ছাড়াই’।

আল জাজিরার মতে, ইসরায়েল পুরো গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যার ফলে প্রায় দশ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার শঙ্কা রয়েছে।

নিহত হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই এক্সে (সাবেক টুইটার) সাংবাদিক শরীফও লিখেছিলেন, গাজা সিটির পূর্ব ও দক্ষিণ অংশে তীব্র ও লক্ষ্যকেন্দ্রিক বোমাবর্ষণ শুরু করেছে ইসরায়েল। এ ধরনের বোমাবর্ষণ ‘ফায়ার বেল্ট’ নামে পরিচিত।

শরীফের শেষ ভিডিওটি রাতের বেলা ধারণ করা। সেখানেও ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তীব্র আওয়াজ শোনা যায়। হামলার পর মুহূর্তে কমলা আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে গাজার রাতের আকাশ।

গত ৬ এপ্রিল শরীফ একটি ‘শেষ বার্তা’ লেখেন। মৃত্যুর পর প্রকাশের জন্য এই বার্তা রেখে গিয়েছিলেন তিনি।

বার্তায় শরীফ লিখেছিলেন, তিনি যন্ত্রণার প্রতিটি ক্ষুদ্রতম রূপ অনুভব করেছেন। বারবার দুঃখ ও ক্ষতির স্বাদ পেয়েছেন।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাই আল জাজিরার পাঁচ কর্মীকে হত্যার পর ইসরায়েলকে জবাবদিহির আওতায় আনতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

ইসরায়েল ‘ঠান্ডা মাথায়’ সাংবাদিকদের হত্যা করছে বলে অভিযোগ করে বাঘাই বলেন, ‘গণহত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে একটি প্রেসব্যাজ কোনো ঢাল নয়, যারা বিশ্ব তাদের নৃশংসতা দেখতে ভয় পায়’।

‘যেকোনো ভদ্র মানুষের জন্য কঠোর নিন্দা সর্বনিম্ন। তবে এই ভয়াবহ গণহত্যা বন্ধ করতে এবং অপরাধীদের জবাবদিহি করতে বিশ্বকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে’- বলেন তিনি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক কেন রথ এই হত্যাকে ইসরায়েলের ‘নৃশংসতার’ কভারেজ বন্ধের লক্ষ্যবস্তু প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।

মার্কিন কংগ্রেস সদস্য প্রমিলা জয়পাল হামলার পর বলেন, ‘এই গণহত্যার জন্য আমেরিকাকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে’।

গাজায় গণহত্যার জন্য ইসরায়েল তীব্র নিন্দার মুখোমুখি হচ্ছে, যেখানে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে তারা ৬১ হাজার ৪৩০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। আহত হয়েছেন আরও এক লাখ ৫৩ হাজার ২১৩ জন। ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে ছিটমহলটি ধ্বংস হয়ে গেছে, যা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। তাদের চাপিয়ে দেয়া অনাহারে এ পর্যন্ত ২২২ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছেন, যাদের ১০১ জনই শিশু।

গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে।উপত্যকাটিতে যুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলারও মুখোমুখি ইসরায়েল।



মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ