৬ মরদেহ পোড়ানোর দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়া করছে স্বজনদের
ঠিক এক বছর আগের কথা, ৫ আগস্ট ২০২৪। সাভারের আশুলিয়ার আকাশ সেদিন কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল; কিন্তু সেই মেঘে ছিল না বৃষ্টি, ছিল কেবল বারুদের গন্ধ আর স্বজন হারানোর হাহাকার। একদিকে বিজয়ের আনন্দ অন্যদিকে শোক। সেই দিনটি যেন ছিল আশুলিয়ার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়, যখন পুলিশের নির্বিচার গুলি এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের হামলায় অসংখ্য ছাত্র-জনতার জীবন প্রদীপ নিভে গিয়েছিল।
সেদিনের তৎকালীন প্রশাসনের বর্বরতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত ছিল ছয়টি মৃতদেহ পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা। দীর্ঘ এক বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ভয়াবহ কথা মনে করে আজও এলাকার মানুষ আঁতকে উঠেন মাঝে মধ্যেই। আজও চোখ বুজলে তাদের সামনে ভেসে ওঠে লাশের সারি, আহতদের আর্তনাদ আর স্বজনদের আহাজারি।
পুলিশের এমন বর্বরতায় দেশজুড়ে উঠেছিল তীব্র প্রতিবাদের ঝড়। সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো একযোগে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার দাবি করেছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিবাদের উত্তাপ কমে গেলেও, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর মনের আগুন আজও জ্বলছে। তারা আজও সম্মান, স্বীকৃতি এবং ন্যায়বিচারের আশায় পথ চেয়ে আছেন।
সেসময় বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৭৭ জন এবং আহত অসংখ্য। এরকম একজন আহত জুলাই যোদ্ধা মুকুল হোসেনের (ছদ্মনাম)। পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। সেদিনের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমরা ভাবতেই পারিনি এমন ঘটনা ঘটবে। চারিদিক থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আসছিল। অনেকে চোখের সামনে লুটিয়ে পড়েছেন। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে কোনোরকমে বাঁচি। পরে দেখি আমার পায়ে ও ঘাড়ে গুলি লেগেছে। কীভাবে বেঁচে গেছি আল্লাহ জানেন।’
৫ আগস্ট মাঠপর্যায়ে সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন সোহাগ হাওলাদার। খুব কাছ থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিলেন আশুলিয়া থানা এলাকার বিভিন্ন মুহূর্ত। জানান সেদিনের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ‘আমরা ৫ আগস্ট সকাল থেকে বাইপাইল ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সেদিন সকালে আমাদের কোনোপক্ষকেই ভিডিও বা ছবি তুলতে দেয়নি। প্রথমে কিছু শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে আসলেও স্থানীয় এমপির লোকজন দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে আরও সংগঠিত হয়ে তারা ফিরে আসে ও এমপির লোকদের ধাওয়া দিয়ে সড়িয়ে দেয়। এর মধ্যেই ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দেয় পোশাক শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন। এতে পিছু হটে আওয়ামী লীগের লোকজন। তবে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন বেশ কিছু আন্দোলনকারী।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর মাঝে যখন খবর আসে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে তখন বিজয় মিছিল বের করে ছাত্র-জনতা। তখন তারা মিছিল নিয়ে থানা ঘেরাও করতে যায়, তাদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি করে আইনশৃঙ্ঘলা বাহিনীর সদস্যরা। চোখের সামনে অসংখ্য মানুষকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেখেছি। পরবর্তীতে খবর আসে গুলি করে পিকআপ ভ্যানে উঠানো হয়েছে নিহতদের মরদেহ। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে ঘটনাস্থলে সামনে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না।’
সেই দিনের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আজও শিউরে উঠেন অনেকেই। বাইপাইল এলাকার আরেকজন স্থানীয় মোসা বানু কেঁদে বলেন, ‘আমি সেদিন মেইন রাস্তার মসজিদের সামেন দাঁড়িয়ে ছিলাম। কয়েকবার পুলিশ ও ছোট ছোট পোলাপাইনের ধাক্কাধাক্কি লেগেছে। এসব ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যেই ১২টার দিকে একবার অনেক গোলাগুলি হয়। ওই সময় চোখের সামনে অনেকে পড়ে যান। কেমনে যে পোলাপাইনগুলা মরলো। চোখের সামনে কিছুই করতে পারলাম না।’
তিনি আরও বলেন, সেদিনে কে গুলি করেছে দেখেননি তিনি। তবে যখন পুলিশ ধাওয়া দেয় তখনই ছিল গুলির শব্দ। পরে কয়েকজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
সেদিন পুলিশ আগুন দিয়ে ঝলসে দেয় বায়েজীদের মরদেহ। তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন আশুলিয়ার একটি ভাড়া বাসায়। এক বছরের ছোট্ট ছেলে রাফী আব্দুল্লাহ ও স্ত্রী রিনা আক্তার ছিলেন তার অনুপ্রেরণা। ৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়েছিলেন তাদের না জানিয়ে। বলে এসছিলেন শুধু নিজের জন্য নয় দেশের লাখ লাখ পরিবার বাঁচাতে লড়তে হবে তাকে। এ কথাগুলো বলছিলেন বায়েজীদের স্ত্রী রিনা আক্তার।
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী দেশের মানুষের জন্য জীবন দিয়েছে; কিন্তু কয়টা মানুষ আমার স্বামীর নাম জানে? সরকারি কাগজে-কলমে তার নাম আছে; কিন্তু তার জীবনের বিনিময়ে আমরা অবহেলিত। কোনো অনুষ্ঠান হলে মাঝে মধ্যে আমাদের খোঁজে বক্তব্য দেয়ার জন্য তাছাড়া আমাদের খোঁজ কেউ রাখে না। কিছু টাকা-পয়সা পেয়েছি; কিন্তু এই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
সেদিন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আস সাবুরের মরদেহ। কথা হয় আস সাবুরের মা রাহিমা জান্নাত ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যেভাবে আবু সাঈদ, মুগ্ধর কথা বলা হয় সেভাবে আমার ছেলের নাম কিন্তু বলা হয় না। আমার ছেলেকে খুব নির্মমভাবে মারা হয়েছে। তার মৃত্যুর পর আমাদের আশুলিয়া ছেড়ে আসতে হয়েছে। বড় ছেলেকে বাহিরে কোথাও যেতে দেই না এখনো; কিন্তু এভাবে আগস্ট আসলে আমার ছেলের নামটা আসে; কিন্তু আমাদের তো ইচ্ছে হয় যেন আবু সাঈদ বা মুগ্ধর মতো আমার ছেলের নামটা দেখানো হয়।’
পুলিশের গুলিতে নিহত আরেক শহীদ সজলের মা শাহিনা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে সেদিন মিছিলে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে আর পাইনি। সেদিন অনেকেই নিখোঁজ হয়েছিল। শুনেছি, পুলিশ লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে, যাতে তাদের কোনো পরিচয় না থাকে। আমার বুকটা আজও ফেটে যায়, যখন জানতে পারি পুড়িয়ে দেয়া লাশের মধ্যে আমার ছেলেও একজন। আমি এক বছর ধরে কান্না করছি কোনো বিচার পাইনি। কে করবে বিচার।’
পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আশুলিয়া থানায় মামলা হয়েছিল ৮০টি, বর্তমানে তদন্ত চলছে ৭০টি মামলার। এর মধ্যে ৪৩টি হত্যা এবং ২৭টি হত্যাচেষ্টা মামলা। এর বিপরীতে আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে ৫৮০ জনের বেশি (জুলাই মাসের হিসাব অনুযায়ী)। তবে মূল আসামিদের অনেকেই এখনো রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এ ব্যাপারে আশুলিয়া থানার পরিদর্শক (ওসি অপারেশন) সাইফুল ইসলাম সুমন বলেন, ‘আমাদের অনেকগুলো মামলার তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমাদের খুব তাড়াতাড়ি সেগুলোর রিপোর্ট দিয়ে দিব। এছাড়া এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০০ মতো আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। ভবিষ্যতে কাজের গতি আরও বাড়বে।’
এই ছয়জন আন্দোলনকারীর মৃতদেহ পোড়ানোর ঘটনায় হওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মোট ১৬ জন আসামি। এর মধ্যে আট আসামি গ্রেপ্তার আছেন। ২৮ জুলাই তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) উত্তরের সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপপরিদর্শক আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, কামরুল হাসান ও শেখ আবজালুল হক এবং সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার।
এই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে ৭ আগস্ট শুনানি হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে