পাবলো নেরুদা, যিনি প্রতিটি শব্দে রক্ত ঝরাতে পারেন
নোবেলজয়ী কবি ও বিপ্লবী পাবলো নেরুদা বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী লেখক। আজ ২৩ সেপ্টেম্বর এই বিশ্ববিখ্যাত কীর্তিমানের ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী। বিশ্বনন্দিত শিল্পী পাবলো পিকাসো এবং প্রখ্যাত চেক সাহিত্যিক জাঁ নেরুদা এ দুজনের কাছ থেকেই তিনি নিজের নাম গ্রহণ করেন ‘পাবলো নেরুদা।’
কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ একদা নেরুদাকে ‘বিংশ শতাব্দীর সব ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি’ বলে বর্ণনা করেন। ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতে ‘তিনি মহান কবি, যিনি প্রতিটি শব্দে রক্ত ঝরাতে পারেন’ পাবলো নেরুদা ঠিক সেই ধরনেরই সৈনিক-কবি, যিনি আজীবন মুখ চেয়ে মুমূর্ষু সমাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।’
কবি লরকা পাবলো নেরুদা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘রুবেন দারিওর মৃত্যুর পর পাবলো নেরুদা হলেন আমেরিকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবি।’
নেরুদার সারা জীবনের সাহিত্য কৃতীজুড়ে রয়েছে সেসব অগণিত নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ, যারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছেন কিংবা শান্তির জন্য বুকে বুক দিয়ে আজও লড়ছেন। তিনি প্রেমের কবি, মানবতার কবি, বিপ্লবের কবি, সমাজতান্ত্রিক চেতনার কবি। সুন্দর পৃথিবীর জন্য এক লড়াকু সৈনিক রাজনৈতিক নেতা এবং কবি। সব গুণেই তাকে গুণান্বিত করা যায়।
অথচ আশ্চর্যের কথা নেরুদার বাবা কোনোদিন চাননি ছেলে কবি হোক এবং ছাইপাশ লিখে নিজের পড়াশোনা এবং ভবিষ্যৎ নষ্ট করুক। বাবা দেখে যেতে পারেননি ছাইপাশের মধ্যে থেকে জেগে ওঠা এক বিশ্ব কবিকে।
নেরুদা ঘাতকের হাতে প্রাণ দেন স্বদেশেই। কমিউনিজমের আদর্শ ছিল তার জীবনব্রত এবং তার জন্যই তার জীবননাশ। যৌবনে আত্মগোপনে, দেশান্তরে তার কেটেছে অনেকদিন। কষ্ট ভোগ করেছেন; কিন্তু কলম কখনও ক্লান্ত হয়নি। তার কাব্যে বেজেছে নবজীবনের গান; প্রতিবাদ, আশা ও আশ্বাসের সংগীত। লিখতেন সবুজ কালি দিয়ে যা ছিল অপরিমেয় আশার প্রতীক, যৌবন ও প্রত্যয়ের প্রতীক। লিখেছেন ঐতিহাসিক মহাকাব্য, প্রকাশ্য রাজনৈতিক ইশতেহার, গদ্য আত্মজীবনী এবং ভালোবাসার কবিতা।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার কবি পরিচিতি লাভ এবং তারপর আমৃত্যু ছিল কবিতার সঙ্গে তার সহবাস। নেরুদা মজা করে বলতেন, তার জীবনের সব অন্তরঙ্গ সংলাপ কবিতার সঙ্গেই। ১৯৭১ সালে নোবেল পুরস্কার তাকে বিশ্ব স্বীকৃতি এনে দিলেও আন্তর্জাতিক পরিচিতি তার অনেক আগেই ঘটেছে।
কবিতা থেকে সম্পূর্ণ ছুটি না নিয়েও নেরুদা তার জীবদ্দশায় নানাবিধ সামাজিক এবং রাজনৈতিক দায়িত্ব সামলেছেন। কূটনীতিক পদ গ্ৰহণ করে একাধিক দেশে তিনি চিলির ভাবমূর্তি তুলে ধরেছেন। চিলীয় কমিউনিস্ট পার্টির সিনেটর হিসেবে একটি পূর্ণ মেয়াদ জনপ্রতিনিধিত্বও করেছেন। তার সাফল্যের নিদর্শন ১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার এবং ১৯৫৩-এ লেনিন শান্তি পুরস্কার লাভ।
চিলির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আলেন্দেকে পিনোচেতের দস্যুবাহিনী হত্যা করার পর দেশজুড়ে কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রীদের খুঁজে বের করে দণ্ডদান ও নিধন শুরু হয়। নেরুদা সে সময়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে শয্যাশায়ী। ঘটনার পাঁচদিন পর তাকে নতুন সরকারের নির্দেশে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়। আদেশপ্রাপ্ত চিকিৎসক সেদিনই তার পাকস্থলীতে একটি ইনজেকশন দেন যার ৬ ঘণ্টা পর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তখন তার ৬৯ বছর। তার অপরাধ তিনি সমাজতন্ত্রের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ে বিশ্বাসী ছিলেন এবং আলেন্দের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা ছিলেন। স্টকহোম থেকে নোবেল পুরস্কার নিয়ে চিলিতে ফিরে আসার পর আলেন্দের উদ্যোগে তাকে রাষ্ট্রীয় বীরের সংবর্ধনা দেয়া হয়। ৭০ হাজার উদগ্ৰীব শ্রোতার সামনে তাকে বই পড়ে শোনাতে আমন্ত্রণ জানান আলেন্দে ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
জীবন্ত কিংবদন্তি নেরুদার মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রপতি পিনোচেট নেরুদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জনসমক্ষে অনুষ্ঠিত করার অনুমতি দেননি। যদিও হাজার হাজার শোকাহত চিলিয়ান সেদিন কারফিউ ভেঙে পথে ভিড় জমান। পথ উজাড় করা ভিড় ছড়িয়ে পড়ে সমাধিস্থল পর্যন্ত। নেরুদার অন্ত্যেষ্টি পরিণত হয় চিলির সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম গণপ্রতিবাদে।
তবুও যেন থামেনি তার যাত্রা। নেরুদার মৃত্যুর পরে ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনী তার দুটি বাসগৃহ লুটপাট করে। তার অমূল্য সব সম্পদ, সংগৃহীত পুরোনো বই, নথিপত্র, পাণ্ডুলিপি, পাবলো পিকাসোর দেয়া ছবি ইত্যাদি সব কিছু নষ্ট করে ফেলা হয়। এরপর বাড়িতে পানির সব কল খুলে রেখে সমস্ত কিছু জলে ভাসিয়ে দেয়া হয়। যাতে সব কিছু ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়; কিন্তু ব্যর্থ সেই চেষ্টা। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নেরুদাকে মোছা সম্ভব হয়নি।
শাহাদাত হোসেন তৌহিদ: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে